জাতীয়

মাছ-মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ

মাছ-মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। রোববার সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ এ তথ্য জানান।

Advertisement

তিনি বলেন, ‘মৎস্য অধিদফতরের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪০ লাখ ৫০ হাজার টন। ওই অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৪১ লাখ ৩৪ হাজার টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮৪ হাজার টন বেশি।’

মৎস্যমন্ত্রী বলেন, ‘খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যৌথভাবে প্রকাশিত জাতীয় খাদ্যগ্রহণ নির্দেশিকা-২০১৫ অনুযায়ী দৈনিক মাথাপিছু মাছ গ্রহণের পরিমাণ ৬০ গ্রাম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী জনপ্রতি প্রতিদিন মাছ গ্রহণের পরিমাণ ৬২ দশমিক ৫৮ গ্রাম, যা দৈনিক মাথাপিছু মাছ চাহিদার চেয়ে বেশি। ফলে মাথাপিছু চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে।’

নারায়ণ চন্দ্র আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের লাইভ স্টক রিসোর্স ইন বাংলাদেশ-১৯৯৫ গবেষণা পুস্তিকা অনুসারে জনপ্রতি প্রতিদিন ১২০ গ্রাম মাংসের দরকার। মাংসের এ চাহিদা পূরণে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট মাংস উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ৭১ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন, যার বিপরীতে মোট মাংস উৎপাদন হয়েছে ৭১ লাখ ৫৪ হাজার টন।’

Advertisement

‘সে হিসাবে দেশে দৈনিক মাথাপিছু মাংসের প্রাপ্যতা ১২১ দশমিক ৭৪ গ্রাম, যা চাহিদার তুলনায় বেশি। ফলে জনপ্রতি চাহিদা অনুযায়ী মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে’ বলেন প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী।

মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকারের নানা পদক্ষেপ তুলে ধরে মৎস্য মন্ত্রী বলেন, ‘বদ্ধ জলাশয়ে মৎস্য চাষ নিবিড়করণ, পোনা অবমুক্তি কার্যক্রম ও বিল নার্সারি স্থাপন, মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপন ও সমাজভিত্তিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা, পরিবেশবান্ধব চিংড়ি ও মৎস্য চাষ সম্প্রসারণ, মাছের আবাসস্থল পুনরুদ্ধার ও উন্নয়ন, প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র সংরক্ষণ, সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা, প্রজননক্ষম মাছের কৌলিতাত্তিক উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার ফলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।’

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে মৎস্য আহরণে চতুর্থ ও মৎস্য চাষে পঞ্চম জানিয়ে নারায়ণ চন্দ্র বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইতোমধ্যেই রুই জাতীয় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি পাঙ্গাস, তেলাপিয়া, কৈ, পাবদা, গুলশা ও শিং-মাগুর মাছের উৎপাদনের ক্ষেত্রে এক নীরব বিপ্লব সাধিত হয়েছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর নিকট সস্তা ও সহজলভ্য হওয়ায় সিলভার কার্প, পাঙ্গাস, তেলাপিয়া এবং কৈ মাছ এখন প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।’

‘আর ভি মীন সন্ধানী নামের গবেষণা ও জরিপ জাহাজের মাধ্যমে ১৫৭ প্রজাতির মাছ, ১৬ প্রজাতির চিংড়ি, ১১ প্রজাতির ক্রাস্টেসিয়ান ও ৬ প্রজাতির মোলাস্ক চিহ্নিত করা হয়েছে। আশা করা যায়, চলমান এ জরিপ কার্যক্রমের মাধ্যমে ভাসমান ও তল-দেশীয় সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের পূর্ণাঙ্গ জরিপ সম্পন্ন হবে।’ মৎস্য মন্ত্রী বলেন, ‘অর্থনৈতিক এলাকায় ২০০ মিটার গভীরতার বাইরে এবং আন্তর্জাতিক জলসীমায় টুনা ও টুনাজাতীয় মাছ আহরণের জন্য ৪টি লং লাইনার প্রকৃতির নৌযানের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। তাছাড়া আরও ৯টি লং লাইনার ও ৭টি পার্স সাইনার প্রকৃতির মৎস্য নৌযান লাইসেন্স দেয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’

Advertisement

গভীর সমুদ্রে টুনা ও সম-জাতীয় পেলাজিক মাছ আহরণের জন্য একটি পাইলট প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তাছাড়া ব্লু-ইকোনমির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজের বিষয়ে আরেকটি প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়নের ফসল আজকের মাংস উৎপাদনে এ সাফল্য বলে মনে করেন প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘মাংস উৎপাদনে দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জনের পাশাপাশি বিগত বছরে গরু হৃষ্টপুষ্টকরণ কার্যক্রম ও বেসরকারি পর্যায়ে বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক পোল্ট্রি উৎপাদনের পরিপ্রেক্ষিতে মাংসের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে।’

এছাড়া প্রধানমন্ত্রী খামারীদের বকনা পালনে ৫ শতাংশ সুদে ঋণদান, অধিক মাংস উৎপাদনশীল ব্রহমা জাতের গরুর সংযোজন, কৃত্রিম প্রজনন সম্প্রসারণ, প্রুভেন বুল ঘোষণা, মহিষের কৃত্রিম প্রজনন এবং সর্বোপরি ব্যাপকহারে বাণিজ্যিকভাবে গরু হৃষ্টপুষ্টকরণের ফলে এ অর্জন সম্ভব হয়েছে বলেও দাবি করেন মন্ত্রী।

গত দু’বছরে দেশীয় গবাদি পশু দিয়েই কোরবানীর চাহিদা করা হয়েছে জানিয়ে নারায়ণ চন্দ্র বলেন, ‘প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের চলমান প্রকল্পসমূহের পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৪ হাজার কোটি টাকায় প্রস্তাবিত লাইভ স্টক ডেভেলপমেন্ট-বেইজ ডেইরি রেভুলেশন অ্যান্ড মিট প্রোডাকশন প্রকল্প বস্তবায়িত হলে অদূর ভবিষ্যতে ডিম ও দুধ উৎপাদনেও বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে বলে আশা করা যায়।’

মাংস ও ইলিশ মাছের দাম মানুষের নাগালের মধ্যে রাখতে সরকারের কি উদ্যোগ আছে- জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘মাংস ও ইলিশ মাছের দাম মানুষের নাগালের মধ্যে রাখতে সরকারের বিভিন্ন চেষ্টা রয়েছে। মুক্তবাজারকে নিয়ন্ত্রণে রাখাটা ডিফিকাল্ট।’

এর আগে ইলিশ রফতানির কথা জানিয়েছিলেন, সেই বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতির হয়েছি কি-না, জানতে চাইলে নারায়ণ চন্দ্র বলেন, ‘আমাদের যদি চাহিদার চেয়ে বেশি থাকে তবে আমরা রফতানির উদ্যোগ নেব। এখনই রফতানি করব আমরা সেই সিদ্ধান্তে যাইনি।’

মাংস ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন চাঁদাবাজি রোধসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলে মাংসের দাম ৩০০ টাকার নিচে নেমে আসবে। আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে আপনি জানিয়েছিলেন। সেই উদ্যোগ কতদূর- এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণি সম্পদমন্ত্রী বলেন, ‘যেটা আমি বলেছি সেটা অনতিবিলম্বে করব। সচিবও নতুন, আমরা এখনও গুছিয়ে উঠতে পারিনি। আশা করি ১৫ মার্চের মধ্যে আমরা এ পদক্ষেপ নেব। এ পদক্ষেপে মাংসের দাম কমাতে পারব।’

এ সময় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব রইছ-উল আলম মণ্ডল, মৎস্য অধিদফতরের মহা-পরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক আইনুল হকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

আরএমএম/এমবিআর/জেআইএম