মতামত

সমসাময়িক জীবনছন্দ

জীবনের বাঁক কি কখনও সহজ হয় না?- এমন প্রশ্নের জবাবে একেকজন একেকভাবে বলবেন হাজারটা উত্তর। কিন্তু একটা সহজ কথা কি মানা যায়! জীবন যেখানে যেমন তাকে সেখানে সেভাবেই গ্রাহ্য করে চলা উচিত। এটাও হয়তো অনেকের মানতে কষ্ট হবে। তাদের যুক্তি হবে, না, পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে নিয়ে চলার নামই জীবন। তাই নিজের জীবনকে অন্যের মতো করে নয়, নিজের মতো করেই সাজাতে হয়। হ্যাঁ

Advertisement

এটা ঠিক। কিন্তু আমরা কি শুধু নিজের জন্য বাঁচি, অন্যের জন্যও তো বাঁচি! এমন প্রশ্নে একদল বলেন যে - হ্যাঁ, একটা সময় ছিল, যে সময়টাতে প্রতিটি মানুষ মানুষের জন্যই ছিল। ছিল হৃদ্যতা, আর ভালবাসার বন্ধন। কিন্তু সময়ের দ্রুততায় এসব এখন ধোঁয়া তোলা কথা। তাদের সাফ উত্তর - এসব ভাববার সময় কোথায়?

আসলেই কি এখন দ্রুতগতির সময়! কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ করার সময়ের বড় অভাব? চারপাশে একটু দৃষ্টি ফিরাই। কালের আবর্তে দেখছি, সত্যিকার অর্থেই সভ্যতার অগ্রগতির দোহাই দিয়ে সবাই ছুটছে তো ছুটছেই। কি এক অজানা মোহে মত্ত হয়ে, অদম্য নেশায় ছুটছে। সবাই শেখরে পৌঁছতে চায়। কিন্তু আমার মতন অনেকেই হয়তো জানে না কিসের শিখর, কত উচ্চে তা। কতটা সিঁড়ি পেরুলে একটা মানুষের উচ্চ হওয়ার বা উপরে উঠার বাসনা পূর্ণ হবে! কেউ কি তা বলতে পারে! উচ্চাসনের সত্যিকারের মাপকাঠিটা কি?

অজানারে জানার আজন্ম ক্ষুধা মানুষের, তাই অনেকে থাকেন আবিষ্কারের নেশায় মত্ত। কিন্তু রহস্যময় এই পৃথিবীর কতটা রহস্য উদঘাটন করা একটা মানুষের এক জীবনে সম্ভব? যারা এই নেশায় নেশাগ্রস্ত তারা কি এই প্রশ্নটা নিজেকে একবারও করে দেখেছেন! এখন প্রশ্ন হতে পারে, মানুষ কি তাহলে জানার আগ্রহ অবদমন করবে? সে কি গৃহকোণে আবদ্ধ হয়ে পড়বে, কিংবা বিশ্ব যেখানে এখন হাতের মুঠোয়, সেখানে আমরা কি গন্ডি ছোট করে ফেলবো? না, তা কেন। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ, নান্দনিকতায় তুলনাহীন। সে-ই তো জানতে চাইবে, জানবে, শিখবে, শেখাবে। কবির ভাষার মতো, ছুটে চলবে দেশ হতে দেশান্তরে। রহস্য উদঘাটনের নেশায় ঘুরবে জগৎ জুড়ে। কিন্তু তারও তো একটি সীমারেখা আছে।

Advertisement

মনীষীরা বলেন, সীমা অতিক্রম করা ভাল না। এই 'ভাল না' কাজটাই এখন অনেক ভাল'তে পরিণত হয়েছে। কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, অনেকেই নিজের অধিকার, স্বাধীনতার মাত্রাজ্ঞানে নিজের অজান্তেই মাত্রা অতিক্রম করে ফেলেন। আর সেটাই যারা করেন না, তাদেরকে মাত্রা অতিক্রমণকারীরা, বেয়াকুফ বা নির্বোধ বলে নির্ণয় করেন। নিজেকে জাহির করতে গিয়ে এমন সবজান্তা সেজে বসেন যে, তারা ছাড়া আর কেউ জ্ঞানের 'গ'-ও জানেন না।

আরো একটু লক্ষ্যণীয় যে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান দান-এর বালাই-ই নেই এখন। আমরা যারা নিজেদের তরুণ, যুবক মনে করি; যারা দাবি করি - আমরাই পারি সমাজকে বদলে দিতে, দেশের জন্য লড়তে। সেই তারাই, নিজের উন্নতি আর আত্মতুষ্টি ছাড়া বাকি কিছুতেই কর্ণপাত করছি না বা দৃষ্টি দিচ্ছি না। তাহলে প্রশ্ন তো উঠতেই পারে- নতুন প্রজন্ম কি শিখছে, কি শেখাচ্ছি আমরা তাদের?

এমন প্রশ্নে আমার অগ্রজরা বলেন, অবাক হওয়ার কিছুই নেই। তারা বলেন, তাদের প্রজন্ম পর্যন্ত মুখে মুখে হলেও নৈতিকতার ব্যবহার করেছেন, আর আমরা নীতিকথা আওড়াচ্ছি, কিন্তু কাজে তার ব্যবহার করছি না। তাহলে প্রশ্ন উঠে যে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মরা আমাদের কাছ থেকে ভালো কিছু কি করে পাবে! আর আমরাই বা তাদেরকে তথাকথিত প্রতিযোগিতা ছাড়া আর কি শেখাতে পারছি!

আমার সাথে অনেকেই একমত হবেন যে, পারছি না, তেমন কিছুই শেখাতে পারছি না। কারণ এখনকার সমাজে বেশিরভাগ মানুষই ক্ষুদ্র স্বার্থে দৌড়াচ্ছি। আর ছেলে-মেয়েদেরও তাই শেখাচ্ছি যে, তুমি দৌড়াও, প্রয়োজনে অন্যকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়ে দৌড়াও। কারণ সমাজের উচ্চাসনটা তোমার। ওটা তোমাকে ছুঁতেই হবে।

Advertisement

এই শিক্ষার মধ্যে যদি আপনি সেই বাল্যশিক্ষার নীতিকথা শেখাতে যান, সেটা কি ধোপে টিকবে! না টেকারই কথা। কেননা এখন আর উচ্চস্বরে কণ্ঠ সাধা হয় না, কিন্তু উচ্চ কণ্ঠে নিজের কর্মযজ্ঞ তুলে ধরার আওয়াজ হয়; আর সৎ পথে ধন-দৌলত অর্জন ও তা জনকল্যাণে বিলানোর সুর তোলা হয় না, হয় নিজের সমৃদ্ধির গান। আত্মতৃপ্ত উচ্চমার্গীয় এসব মানুষের কাতারে যদি আপনি মিশতে না পারেন, তাহলেই কক্ষপথচ্যুত হয়ে (যোগ্যতা থাকা স্বত্বেও) মুখ থুবড়ে পড়বেন।

কি ব্যবসাক্ষেত্র, কি চাকরির বাজার, এমনকি শিক্ষা ক্ষেত্রে-সর্বত্র একই চিত্র। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তো এ পরিস্থিতি প্রকট। আর নিজে যখন কাছ থেকে বিষয়গুলো দেখি তখন আর কার বলার অপেক্ষায় থাকবো বলুন। প্রথমে বাবা-ভাই, পরে স্বামীর ব্যবসায়িক পরিসরে দেখেছি নীতি-নৈতিকতা দিয়ে ব্যবসা করা কতটা দুরূহ। দিন দিন তা আরও দুষ্কর হয়ে উঠছে। আর নিজের চাকরির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। এসব দেখে গ্রামীণ একটা প্রবাদ প্রায়ই মনে হয় - আমের চেয়ে আঁটি বড়' হলে যা হয় আরকি। অস্থিরতার এই দৌড়ে যারা মিশতে না পারছেন, নিজেকে যারা শো-আপ নীতিতে তুলে ধরতে না পারছেন, তারাই যোগ্যতা থাকা স্বত্বেও পিছিয়ে পড়ছেন। তারপরও কেউ কেউ এগুচ্ছেন, আর এটাকে এখনকার যুগে ব্যতিক্রম হিসেবে দেখাটাই ভাল।

আমরা প্রাচীনপন্থী মতাদর্শে জানি- আপনার ঘট যদি বিদ্যা-বুদ্ধি আর জ্ঞানের ভাণ্ডার হয়, তবে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে, সাফল্যের মালা আপনার গলেই শোভা পাবে। এই মতাদর্শের অবলম্বনে, আমরা প্রত্যাশা করতে পারি যে, আমাদের বর্তমানের ক্রান্তিকাল উত্তরণের একটি অন্যতম পথ এই প্রবাদটিই হোক।

লেখক : সিনিয়র নিউজরুম এডিটর, বাংলাভিশন।

এইচআর/এমএস