খেলাধুলা

‘এমন টার্নিং উইকেটে কখনো খেলিনি’

প্রশ্ন উঠলো, ‘আপনার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে (যদিও টেস্ট মোটে ১২টি , শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আজ শুরু হওয়া এই টেস্ট বাদে) এমন টার্নিং উইকেট মানে স্পিন বান্ধব পিচে কি আগে কখনো খেলেছেন? আবদুর রাজ্জাকের সহজ সরল স্বীকারোক্তি, ‘নাহ, এ ধরনের উইকেটে (টার্নিং) এই প্রথম খেললাম।’

Advertisement

প্রথম দিনের খেলা শেষে মিডিয়ার সামনে রাজ্জাকের একটি সংলাপই বলে দিচ্ছে, শেরে বাংলার উইকেট কেমন টার্নিং।

বৃহস্পতিবার প্রথম দিন স্পিন জাদুতে লঙ্কান ব্যাটসম্যানদের বশ করা এ বাঁহাতি স্পিনার দিনের খেলা শেষে মিডিয়ার সাথে কথা বলতে এসে আরও কিছু কথা বলেছেন, যার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনেক।

কথা প্রসঙ্গে রাজ্জাক জানিয়ে দিলেন, আসলে উইকেট একটা বড় ফ্যাক্টর। তিনি যে সময়টায় টেস্ট খেলেছেন, সেটা দেশের বাইরে হলে তো কথাই নেই। ঘরের মাঠেও তখন তখন নিজেদের শক্তি, সামর্থ্য সম্পর্কে স্বচ্ছ ও ভালো ধারণা ছিল না বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট ও থিঙ্ক ট্যাঙ্কের।

Advertisement

ব্যাটসম্যানরা যতই ভাল খেলে রান করুন না কেন, বোলাররা দুই বার প্রতিপক্ষকে অলআউট করতে না পারলে কিছুতেই টেস্ট জেতা সম্ভব না। এই কঠিন সত্য উপলব্ধিটাই এসেছে অনেক দেরিতে। আর বাংলাদেশের বোলিংয়ের মূল অস্ত্র কারা? পেসার নাকি স্পিনার, তা বুঝতে ও জানতেও লেগেছে দীর্ঘ সময়।

এক সময় গিয়ে উপলব্ধি হয়েছে, ঘরের মাঠে স্পিনাররাই হতে পারেন মূল বোলিং অস্ত্র। কিন্তু তাদের মানে স্পিনারদের উপযোগী কন্ডিশন তৈরি করার সামর্থ্য জন্মেছে আরও পরে।

তার আগে বাংলাদেশের ঘরের উইকেট মানেই ছিল ‘ব্যাটিং বান্ধব পিচ।’ যেখানে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা আর অস্ট্রেলিয়ার বড় বড় ব্যাটসম্যানরা এসে রানের পাহাড় সাজাতেন। আর বাংলাদশ সেই রান পাহাড়ের নিচে চাপা পড়তো।

এভাবে এক যুগের বেশি সময় কেটে যাবার পর অবশেষে স্পিন সহায় উইকেট তৈরি হচ্ছে। যে টার্নিং পিচে ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার মত বিশ্বসেরা দলকেও নাকানি চুবানি খাওয়ানো সম্ভব হচ্ছে। এমন পিচ যেখানে আনকোরা অফস্পিনার মেহেদি হাসান মিরাজ ইংল্যান্ডের মত বিশ্বমানের দলের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্টে ১২ উইকেট দখল করে জয়ের নায়ক হবার পাশাপাশি ম্যাচ সেরার পুরস্কার জেতেন। তাইজুল ইসলামকে খেলতে ঘেমে নেয়ে ওঠেন অস্ট্রেলিয়ার নামি ব্যাটসম্যানরাও।

Advertisement

এই যে সহায়ক কন্ডিশন বা উইকেট, এটাই আসলে সাফল্যের পূর্ব ও প্রথম শর্ত। যা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন রাজ্জাক। হাতের আঙ্গুলের কারিশমায় বল ঘোরাতে না পারলেও উইকেটের সহায়তায় যে বল বাড়তি টার্ন করে, সেই টার্নিং পিচে জায়গামত বল ফেললে সাফল্য মেলে; আজ সে সত্যর দেখা পেয়েছেন রাজ্জাক।

আগের ১২ টেস্টে যার উইকেট মোট ২৩ টি, যিনি জীবনে কখনো চার উইকেটও পাননি, সেই তিনিই ক্যারিয়ারের স্বর্ণ সময় পিছনে ফেলে মধ্য তিরিশে পা দিয়েও আজ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে রীতিমত প্রতিপক্ষকে নাকানি চুবানি খাইয়েছেন, দখল করেছেন চার উইকেট। তাইতো রাজ্জাকের সরল স্বীকারোক্তি, ‘আগে তো নিজেদের শক্তি দেখে শুনে খেলার সুযোগ ছিলো না। এখন তা হয়েছে।’

বলার অপেক্ষা রাখেনা, নিজেদের শক্তি দেখে শুনে খেলার সুযোগ ছিল না বলতে রাজ্জাক উইকেটের কথাই বুঝিয়েছেন। তার মানে তার ক্যারিয়ারের আসল সময়টায় ঘরের মাঠেও স্পিন সহায় উইকেট পাননি। মিরাজ ও তাইজুলরা ক্যারিয়ারের শুরুতে অমন স্পিন সহায় উইকেটে খেলার সুযোগ পেয়েই কিন্তু বল ঘোরাচ্ছেন। চার বছরের বেশি সময় পর টেস্ট খেলতে নেমে অমন স্পিন সহায় উইকেটে রাজ্জাক যেন দেখিয়ে দিলেন, ‘সময় থাকতে এমন উইকেট পেলে আমিও অনেক কিছু করে দেখাতে পারতাম।’

আজ আরও একটি সত্য প্রতিষ্ঠিত হলো, তা হলো- আসলে বাংলাদেশে ফিঙ্গার স্পিনার বা আঙ্গুলের টানে বল ঘোরানো স্পিনার খুব কম। বেশির ভাগ স্পিনার লাইন ও লেন্থের ওপর ভর করেই চলেন। উইকেটে বাড়তি টার্ন থাকলেই তারা জ্বলে ওঠেন। রাজ্জাকও ওই ক্যাটাগরির স্পিনার।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ২০০৬ সালে এপ্রিলে অস্ট্রেলিয়ার সাথে চট্টগ্রামে টেস্ট অভিষেকের পর আট বছরে মাত্র ১২টি টেস্ট খেলার সুযোগ পেলেন, যার মধ্যে গত এক যুগে এই টেস্ট সহ ঘরের মাঠে মোটে ১০টি। যার মধ্যে আগের নয় টেস্ট ছিল শতভাগ ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি পিচে। যেখানে নিজেকে মেলা ধরা ছিল খুব কঠিন। আজ যে পিচে খেলা হয়েছে; রাজ্জাক কেন, তার পূর্বসূরী মোহাম্মদ রফিকও পাননি। পেলে রফিকের টেস্ট পরিসংখ্যান হয়তো আরও সমৃদ্ধ থাকতো।

এখন ঘরের মাঠে স্পিন সহায় টার্নিং পিচ তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে এবং তাতে নিয়মিত খেলাও হচ্ছে। আজকের চমক জাগানো বোলিং এবং উইকেটের সহায়তায় নিঁখুত লাইন ও লেন্থের সাথে বাড়তি টার্ন আদায় করা রাজ্জাক আগামীতে দলে থাকার দাবিদার হতেই পারেন।

বয়স নিয়ে ভাবনা? ইতিহাস কিন্তু তার আশার খোরাক জোগাচ্ছে। ভারতের দিলীপ দোশি , নিউজিল্যান্ডের ড্যানিয়েল ভেট্টোরি আর পাকিস্তানের ইকবাল কাসিমের মতো বিশ্বের অনেক নামধারী বাঁহাতি স্পিনার মধ্য তিরিশ পেড়িয়েও টেস্ট খেলেছেন। ওই সময়েও তাদের সাফল্য আছে বেশ।

১৯৪৭ সালে জন্ম নেয়া দোশি ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত মানে ৩৬ বছর বয়সেও টেস্ট খেলেছেন। একইভাবে নিউজিল্যান্ডের ড্যানিয়েল ভেট্টোরিও (১৯৭৯ সালে জন্ম আর শেষ টেস্ট খেলেছেন ২০১৪ সালে) ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত টেস্ট খেলেছেন। টেস্ট ফরমেটে মধ্য তিরিশে বল ঘুরানোর রেকর্ড আছে পাকিস্তানের ইকবাল কাশিমেরও (১৯৫৩ সালে জন্ম, শেষ টেস্ট খেলেছেন ১৯৮৮ সালে)।

রাজ্জাকের বর্তমান বয়স ৩৫ বছর ২৩৮ দিন। তার পক্ষে কি আরও কিছু দিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা সম্ভব? বাঁহাতি এই স্পিনার নিজে ভীষণ আত্মবিশ্বাসী। বললেন, ‘আমি রণে ভঙ্গ দিতে রাজি নই। চেষ্টা করে যাব। যতদিন সম্ভব আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা যায়।’

এআরবি/এমএমআর/আইআই