ওয়ানডেতে এখনো তিনি বাংলাদেশের তিন নম্বর উইকেট শিকারি। তবে ম্যাচ পিছুৃ উইকেট শিকারকে মানদন্ড ধরলে একদিনের সীমিত ওভারের খেলায় আব্দুর রাজ্জাক রাজের ক্যারিয়ার মাশরাফি আর সাকিব আল হাসানের চেয়েও সমৃদ্ধ।
Advertisement
১৮৫টি একদিনের খেলায় মাশরাফির উইকেট যেখানে ২৩৭, সমান ম্যাচে সাকিব যেখানে ২৩৫ উইকেট শিকারি; সেখানে ১৫৩ খেলায় আব্দুর রাজ্জাকের উইকেট ২০৭টি। অর্থাৎ তার চেয়ে ৩২ ম্যাচ বেশি খেলা মাশরাফির চেয়ে মাত্র ৩০ উইকেট কম। আর মাশরাফির সমান ম্যাচ খেলা সাকিবের উইকেট রাজ্জাকের চেয়ে মোটে ২৮ টি বেশি।
তার সাফল্যের ফিরিস্তি সেখানেই শেষ নয়। বাংলাদেশের বোলারদের মধ্যে সবার আগে ২০০ উইকেট শিকারি খুলনার এ বাঁহাতি স্পিনার। কিন্তু বিস্ময়করভাবে সেই রাজ্জাকের টেস্ট পরিসংখ্যান মোটেই সমৃদ্ধ নয়। উইকেট শিকারকে সাফল্যের নিয়ামক বা মানদন্ড ধরলে ‘খারাপ।’
তার চেয়ে অনেক কম বয়সী তাইজুল ইসলাম (১৮ টেস্টে ৬২ উইকেট) আর মেহেদি হাসান মিরাজের ( ১২ টেস্টে ৪৬ উইকেট) সাফল্য বেশি। পরিসংখ্যানও রাজ্জাকের চেয়ে সমৃদ্ধ।
Advertisement
১২ টেস্টে রাজ্জাকের উইকেট সংখ্যা মোটে ২৩। বাঁহাতি তাইজুলের যেখানে ইনিংসে আট উইকেট আছে (৮/৩৯), মিরাজ যেখানে অভিষেক সিরিজেই এক টেস্টে ১২ উইকেট (৬/৭৭ , ৬/৮২) শিকারি; সেখানে আজ শ্রীলঙ্কার সাথে চার বছরের বেশির সময় পর ফেরার আগে পর্যন্ত রাজ্জাক কোন ম্যাচে ৪ উইকেটও পাননি। তার সেরা বোলিং ফিগার ছিল ৩/৯৩!
তাই সাকিবের সঙ্গী হিসেবে বাঁহাতি তাইজুল আর অফস্পিনার মিরাজই প্রথম পছন্দ হিসেবে গণ্য হয়ে আসছেন। সাফল্যের পাল্লা কম ভারি বলে রাজ্জাক দীর্ঘ দিন টেস্টে স্পিনারের কোটায় জায়গা পাননি।
এ সিরিজে তার ডাক পাওয়া হঠাৎ করেই। ২৭ জানুয়ারি ঘরের মাঠে তিন জাতি ক্রিকেটের ফাইনালে চোট পেয়ে সাকিব ছিটকে পড়ায় তাইজুল, মিরাজ, সানজামুল আর তানবীর হায়দারেরর সঙ্গে রাজ্জাককেও শেষ মুহূর্তে ডাকা হয়।
ভাবা হচ্ছিল, সাকিব যেহেতু নেই, তাই মধ্য তিরিশের ও অভিজ্ঞ রাজ্জাককেই হয়তো বিকল্প হিসেবে চিন্তা করবেন টিম ম্যানেজমেন্ট ও নির্বাচকরা। মনে হচ্ছিল চট্টগ্রামে প্রথম টেস্টে দেখা যাবে রাজ্জাককে। কিন্তু দীর্ঘ দিন পর দলে ফেরা রাজ্জাককে নেটে তেমন মনে ধরেনি টিম ম্যানেজমেন্ট ও নির্বাচকদের। তার চেয়ে বরং আরেক বাঁহাতি সানজামুলকেই ভালো লেগেছে টিম ম্যানেজমেন্টর। তাইতো সানজামুলের অভিষেক হলেও চট্টগ্রামে একাদশে জায়গা পাননি রাজ্জাক।
Advertisement
জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের শতভাগ ব্যাটিং সহায় পিচে সুবিধা করতে চরম ব্যর্থ বাংলাদেশের বোলাররা। রাজ্জাকের জায়গায় দলে সুযোগ পাওয়া সানজামুল কিছুই করতে পারেননি। ৪৫ ওভার বল করে ১৫৩ রানে মোটে একটি উইকেট শিকার তার।
এদিকে আগেই জানা গিয়েছিল, ঢাকার উইকেট হবে ‘স্পিন ফ্রেন্ডলি।’ এই স্পিন সহায় পিচেই গত ১৭ মাসে প্রথমে ইংল্যান্ড (১০৮ রানের বড় জয়) আর পরে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে (২০ রানে) দু'দুটি স্মরণীয় জয়ের রেকর্ড । তাই এবার আর ভুল হয়নি। ঠিক রাজ্জাককে ১১ জনে রেখেই সাজানো হয়েছে দল।
প্রায় চার বছর পর টেস্ট খেলতে নেমে রাজ্জাকও নিরাশ করেননি। বল হাতে জ্বলে উঠে লঙ্কান প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যানদের নাকানি চুবানি খাইয়ে ছেড়েছেন। তার ঝুলিতে তাইজুলের সমান চার উইকেট জমা পড়লেও লঙ্কান ফ্রন্ট ও মিডল অর্ডার ব্যাটিংয়ে ফাটল ও কাঁপন ধরানোর কাজটি করেছেন রাজ্জাকই।
কেউ কেউ তার এ ফেরাকে বলছেন ‘ রাজকীয় প্রত্যাবর্তন।’ আবার কারো অনুযোগমাখা উচ্চারণ, রাজ্জাককে আরও আগেই বিবেচনায় আনা উচিত ছিল।
এর কোনো যুক্তিই ফেলনা নয়। রাজ্জাক যে ভাল বোলার, তাতে সন্দেহ নেই কারোরই। স্পিনার হিসেবে ফেলনা হলে কোনো ভাবেই ওয়ানডেতে ২০০ উইকেট শিকারি হতে পারতেন না। বলা হয় তার বলে টার্ন কম। শুধু লাইন ও লেন্থটাই বড় অস্ত্র। যা দিয়ে টেস্টে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানকে বিব্রত করা ও উইকেট আদায় কঠিন।
বোঝাই যায়, নির্বাচকরা এবং টিম ম্যানেজমেন্টও অমনটাই ভাবতেন। তাদের ধারণা ছিল, রাজ্জাককে দিয়ে টেস্ট হবে না। আর এখন তো বয়স হয়ে গেছে। মধ্য তিরিশে পৌঁছে গেছেন। সব বিবেচনায় দীর্ঘ দিন রাজ্জাক ছিলেন দলের বাইরে।
এবার সাকিববিহীন অনভিজ্ঞ স্পিন তরীর মাঝি হিসেবে ডাক পাওয়া রাজ্জাক দেখিয়ে দিলেন, বয়স কোনো ব্যাপার নয়। বাধাও নয়। বলে টার্ন কম, সেটাও খুব বেশি অন্তরায় নয়। উইকেটে টার্ন থাকলেই চলে। আজ শেরে বাংলায় যে উইকেটে টেস্ট শুরু হলো, তা যে স্পিনারদের স্বর্গ!
টেস্টে প্রথম দিনের উইকেটে এমন বড় বড় টার্ন, সচরাচর দেখা যায় না। আজ সকাল থেকেই বল লাটিমের মত ঘুরেছে। লঙ্কান ব্যাটসম্যানরা বার বার সেই স্পিনে হয়েছেন পরাস্ত।
লঙ্কান ওপেনার করুণারত্নে আর অধিনায়ক দিনেশ চান্দিমাল রাজ্জাকের টার্নেই আউট। বাঁহাতি করুনাত্নে ফ্লিক করতে গিয়ে লেগস্টাম্পের ঠিক বাইরে বাড়তি টার্নকে ব্যাটে আনতে ব্যর্থ হয়ে স্টাম্পড। আর চান্দিমাল আউট হলেন দারুণ এক ডেলিভারিতে। লেগ মিডলে পিচ করা গুডলেন্থ ডেলিভারিকে মাথা নিচু করে ফরোয়ার্ড ডিফেন্স করতে গিয়েও পারলেন না লঙ্কান অধিনায়ক। বল তার প্রত্যাশার চেয়ে বেশি স্পিন করে আঘাত হানলো অফস্টাম্পে।
প্রায় একই ধরণের ডেলিভারিতে বোল্ড লঙ্কান প্রথম ইনিংসের টপ স্কোরার (৬৮) কুশল মেন্ডিস। তিনিও ব্যাড প্যাড একসাথে নিয়ে ডিফেন্স করতে গিয়ে রাজ্জাকের টার্নে বোল্ড। এছাড়া তাকে অফসাইডে মারতে গিয়ে মুশফিকুর রহিমের দৃষ্টিনন্দন ক্যাচের শিকার গুনাথিলাকা।
এক কথায় সাকিব বিহীন স্পিন ডিপার্টমেন্টকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য টিম ম্যানেজমেন্ট অভিজ্ঞ রাজ্জাকের ওপর আস্থা রেখেছিলেন। রাজ্জাক সে আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন।
লাল বল হাতে নিয়ে মিরাজের সাথে এক প্রান্তে শুধু বোলিংয়ের সূচনাই করেননি, শুরু থেকেই লঙ্কান ব্যাটসম্যানদের টুঁটি চেপে ধরার কাজটিও দারুণ দক্ষতার সঙ্গে করেছেন রাজ্জাক। বলতে গেলে তার মাপা বোলিং ও বাড়তি টার্নের মুখেই ভেস্তে যায় লঙ্কানদের প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার সব চেষ্টা। তাই তো ২২২ রানের বেশি এগোতে পারেনি চান্দিমাল বাহিনী।
এআরবি/এমএমআর/আইআই