একটা উৎকণ্ঠিত দিন গেলো দেশের। কিন্তু শেষাবধি বড় কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই দিনটি পার হলো। আদালত বিএনপি চেয়ারপার্সন এবং তিন বারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের সাজা দিয়েছে। এই সাজা প্রদান আইনের বরখেলাপ হলো কি হলো না আইনজ্ঞরা বলতে পারবেন। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষ এই রায় থেকে এই কথাটিই বুঝতে পেরেছে যে, এদেশে আসলে আইনের শাসন ক্রমশঃ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, জেল হত্যাকাণ্ড, বিডিআর হত্যাকাণ্ডসহ ভয়ঙ্কর রক্তকাণ্ডের বিচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এদেশের কিছু অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান হওয়া প্রয়োজন ছিল।
Advertisement
যার মধ্যে পারিবারিক রাজনীতির ও রাজনৈতিক দলকে ব্যবহার করে, ক্ষমতাকে ব্যবহার করে রাষ্ট্র ও আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যাচ্ছে তাই করা এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদকে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা। জেনারেল জিয়াউর রহমান এই মৌরসি পাট্টার অশুভারম্ভ ঘটিয়েছিলেন যা ক্রমশঃ সমাজ ও রাষ্ট্রে নিরাময়-অযোগ্য ব্যাধিতে পরিণত হয়েছিল। আজকের রায় এই ভয়ঙ্কর দুর্নীতি নামক ব্যাধির জন্য ‘এন্টিবায়োটিক’ হিসেবে কাজ করবে এবং ভবিষ্যতে যে কোনো দুর্নীতিবাজের মনে এই রায় যে কোনো দুষ্কর্ম থেকে একটু হলেও দূরে সরিয়ে রাখার মতো ভয় সৃষ্টি করবে। এদেশের বিচার বিভাগও আজকের রায়ের মধ্য দিয়ে অন্য এক উচ্চতায় উঠে গেলো বলে তাৎক্ষণিকভাবে আমার মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রতিটি যোগ্যতার মাপকাঠিতেই সামান্য হলেও ওপরের দিকে উঠছে। পর পর পাঁচবার দুর্নীতিতে প্রথম হওয়ার মতো ভয়াবহ দুরবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই বেরিয়ে আসাটা হোঁচট খাচ্ছে সমাজের কিছু উচ্চাভিলাষি, ক্ষমতাদর্পী মানুষের কারণে। তারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে নিজেদের আখের গোছানোর কাজটিতো করছেই সেই সঙ্গে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি করেছে রাষ্ট্রের। আজকে নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রের এই ক্ষতিকারক ব্যক্তিবর্গের জন্য একটি দিকনির্দেশনামূলক দিন। কারণ এতোদিন একথাই সকলে বলেছেন বা বুঝেছেন যে, ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ যাদের রয়েছে তাদের কোনো কিছুই হবে না, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে তারা আইনকে নিজের পকেটে পুরে রাখবে।
একটা ‘মিথ’-এর মতো এই সত্য সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মিথ যে ভাঙে, সত্যও যে বদলায় তা বাংলাদেশ আজ দেখেছে। বেগম জিয়ার মতো ধরা-ছোঁয়ার উর্ধ্বে থাকা রাজনীতিবিদ, যার সঙ্গে এদেশের একটি বিরাট রাজনৈতিক শক্তি যেমন রয়েছে তেমনই রয়েছে বিদেশি শক্তিও, তার বিরুদ্ধেও যখন আদালত কারাদণ্ড দিতে পারছে, তার অর্থ হচ্ছে এদেশের ভবিষ্যতে যারা একই ভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার, রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজের মতো করে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে একটু হলেও সতর্ক হবেন, যে কথা আগেই বলেছি।
Advertisement
বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া এতিমখানা দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণার তারিখ ধার্য হওয়ার পর থেকেই আমরা লক্ষ্য করেছি যে, এদেশের গণমাধ্যম পরিণত হয়েছিল মিথ্যাচারের একটি কারখানায়। যে যার মতো করে আইন ও আদালতকে ব্যাখ্যা করতে শুরু করেছিলেন। বিশেষ করে বেগম জিয়ার দলীয় নেতাকর্মী ও বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীরা কুৎসিৎ মিথ্যা যুক্তি দিয়ে বার বার বলছিলেন যে, বেগম জিয়া ব্যাক্তিগত ভাবে কোনো অর্থ আত্মসাত করেননি, কুয়েত থেকে (যদিও টাকা এসেছে সৌদি আরব থেকে) আসা সাহায্য বেড়ে কয়েকগুণ হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
অথচ জেনেশুনে তারা এই সত্যটি গোপন করছিলেন যে, মামলাটি টাকা তসরুপের কারণে হয়নি, হয়েছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় থেকে প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে আসা সাহায্যের অর্থ নয়-ছয় হওয়ার কারণে, অর্থাৎ ক্ষমতার অপব্যবহারের সঙ্গে রাষ্ট্রের সঙ্গে চাতুরি করার দায়ে, যা দুর্নীতির ধারায় বিচারযোগ্য। প্রমাণ হয়েছে যে, মিথ্যাচার দিয়ে আইনের ধারাকে থামিয়ে রাখা যায় না, সম্ভব নয়।
একটু আগেই লিখেছি যে, দেশ সকল দিক থেকেই এগিয়ে যাচ্ছে। এই এগিয়ে যাওয়ার মূল্যও এদেশকে দিতে হচ্ছে। রাতারাতি দেশের মানুষের মন-মানসিকতা বদলে যাবে সেটা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। ফলে এখনও সেই সনাতন ও সামন্তবাদী মানসিকতার বশবর্তী হয়ে রাষ্ট্রের অনেক খাতেই দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা চলছে। যেহেতু আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায় আছে ফলে তাদেরকে বেগম জিয়ার এই রায় থেকে সবচেয়ে বড় শিক্ষাটি নিতে হবে। শিক্ষাটি আর কিছুই নয়, ভবিষ্যতে যেনো আওয়ামী লীগকে কোনোদিন আজকের এই দূরবস্থায় পড়তে না হয়, তার জন্য আগে থেকেই সাবধান হয়ে যাওয়া।
ইতিহাস নিজে নিজেই তার পুনরাবৃত্তি ঘটায়, সুযোগ খুঁজতে থাকে মানুষের অপকর্মের। এমন যেনো না হয় আজকে যে লেখাটি বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে দেওয়া রায়ের পরে প্রতিক্রিয়া হিসেবে লিখছি সেই একই লেখা একদিন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লিখতে হয়। ইতোমধ্যে ঘটে যাওয়া দুর্নীতি ও অপকর্মসমূহের সঠিক বিচার করে দলটি সরকার পরিচালনায় নতুন নজির সৃষ্টি করবে এই আস্থা আমরা রাখতে চাই।
Advertisement
সর্বাত্মক ভাবে বিশ্বাস করি যে, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা শক্ত হাতে দলকে সামলে রাখবেন, প্রশাসনকে জনবান্ধব করবেন এবং করবেন দুর্নীতিমুক্ত। তিনি দেশবাসীর সামনে উদাহরণ সৃষ্টি করবেন সফেদ রাজনৈতিক চরিত্রের, নেতাকর্মীদের এবং সামগ্রিক ভাবে দলের। আজকের দিনে এর বেশি কিছু চাওয়ার নেই। সামনে একটি দুর্নীতিমুক্ত সতেজ বাংলাদেশকে দেখতে চাই তাহলেই আজকের রায়ের বৈধতা আরো প্রতিষ্ঠিত হবে নাহলে অল্পদিনের মধ্যেই জনগণ বলতে শুরু করবে যে, বেগম জিয়ার শাস্তি হলো কিন্তু সরকারি দল কেন পার পেয়ে যাচ্ছে? ইতোমধ্যেই এই প্রশ্ন উঠেছে। সুতরাং, এই প্রশ্নকে আর বাড়তে দেওয়া ঠিক হবে না, দেশ ও দেশের ভবিষ্যতের স্বার্থেই এই প্রশ্ন নিরসনে সরাকারকে দৃঢ় হাতে দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ করতে হবে। রাষ্ট্রের শরীর থেকে দুর্নীতি দূর করা গেলে বাকি সবকিছুকে জনগণ এমনিতেই বৈধতা দেবে।
ঢাকা ৮ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার ২০১৮
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.com
এইচঅার/পিআর