১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্ত্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক ব্যাপ্তি লাভ করে। যদিও এর আগে ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের ৩০তম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আরও পেছনে ফিরে গেলে রবীন্দ্রনাথের নোবেল কিংবা সত্যজিৎ রায়ের অস্কার জয়ের কথা বলতে হয়। তবে মূলত গত এক দশক ধরে বাংলাদেশে ও বিদেশে থাকা বাংলাদেশীদের মধ্যে বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার দাবিটি জোরালো হচ্ছে। এই দাবি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আলোচনার আগে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষাগুলো সম্পর্কে একটু আলোচনা করতে চাই।
Advertisement
বর্তমানে জাতিসংঘে মোট ছয়টি দাপ্তরিক ভাষা রয়েছে। ইংরেজি, চাইনিজ মান্দারিন, রুশ,স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ ও আরবি। ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ, রুশ ও চাইনিজ ভাষা ১৯৪৬ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়; একই বছর ২৪ জুন শুধু ইংলিশ ও ফ্রেঞ্চ ভাষা নিরাপত্তা পরিষদের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়। অন্যদিকে রুশ এবং স্প্যানিশ ভাষা নিরাপত্তা পরিষদের ভাষা হিসেবে স্থান পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২২ জানুয়ারি ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত। চীনাদের মান্দারিন ভাষা নিরাপত্তা পরিষদের ভাষা হিসেবে ব্যবহার শুরু হয় ১৯৭৪ সাল থেকে। সবশেষে আরবি ভাষা জাতিসংঘের ষষ্ঠ দাপ্তরিক ভাষার তালিকাভুক্ত হয় ১৯৭৩ সালে আর নিরাপত্তা পরিষদের ভাষা হিসেবে কার্যক্রম শুরু হয় ২১ ডিসেম্বর ১৯৮২ সালে।
জাতিসংঘে ব্যবহৃত এই ছয়টি ভাষা অন্তর্ভুক্তির ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে রুশ ও স্প্যানিশ ভাষাকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে গিয়ে ২৩ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। অন্যদিকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির ৯ বছর পর আরবি ভাষা নিরাপত্তা পরিষদের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
পাঠকের মনে কৌতূহল জাগতে পারে জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভাষাগত অবস্থান বিবেচনায় হিন্দির অবস্থান ৪র্থ হলেও কেন এটি সপ্তম ভাষা হিসেবে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হবে না? আবার ৬ষ্ঠ স্থানে থাকা বাংলা ভাষা ও ৭ম স্থানে থাকা পর্তুগিজ ভাষাকে বাদ দিয়ে ৮ম স্থানে থাকা রুশ ভাষা কিভাবে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা পেয়ে গেলো? সমীকরণ মিলাতে গেলে আরো গভীর বিশ্লেষণ করতে হবে, মূলত হিন্দি ভাষাভাষীর সংখ্যা আরবির চেয়ে বেশি হলেও ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে ইংরেজি ভাষা ব্যবহৃত হয়। সেই অর্থে হিন্দি ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী বেশি হলেও প্রায়োগিক অর্থে হিন্দি ভাষার ব্যবহার আরবির চেয়ে কম। ভারতের মোট জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশ হিন্দি ভাষায় কথা বলে এবং ভারতে কোনো ভাষাই জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃত নয়। হিন্দিকে ভারতে বলা হয় দাপ্তরিক ভাষা আর ইংরেজি দ্বিতীয় দাপ্তরিক ভাষা। বাংলা ভাষার অবস্থান বিশ্বে ৬ষ্ঠ হলেও এই ভাষাটি মাত্র ৩টি দেশের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, অন্যদিকে রুশ ভাষার অবস্থান ৮ম হলেও বিশ্বের ৩৮ টি দেশের দাপ্তরিক ভাষা রুশ।
Advertisement
তবে একটা বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন। বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার প্রস্তুতি নিলেই হবে না, এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখে বাংলা ভাষাকে নিরাপত্তা পরিষদের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এই প্রক্রিয়াটি অনেক দীর্ঘ ও জটিল হলেও অসম্ভব নয়। জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার প্রতিযোগিতায় হিন্দি, বাংলা ভাষার প্রতিদ্বন্দ্বী নয় কারণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও ভারতের কোনো রাষ্ট্র ভাষা নেই। ভারতে ২২ টি ভাষাই দাপ্তরিক। বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন ভাষা ''অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ'' হিসেবে ব্যবহৃত হয় আবার অনেক রাজ্যে ইংরেজি ভাষা ব্যবহৃত হয়। সেই অর্থে ভারত জাতিসংঘে সপ্তম ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার দৌড়ে পিছিয়ে থাকবে।
তবে বাংলার সাথে প্রতিযোগিতায় সমান দাবি করতে পারে পর্তুগীজ ভাষা। জনসংখ্যার বিবেচনায় পর্তুগীজরাও বাঙালিদের কাছাকাছি। এই ভাষাটি পর্তুগাল ও ব্রাজিলসহ ইউরোপ এবং আমেরিকার প্রায় ১২ দেশে ব্যবহৃত হয়। পর্তুগীজদের পাশাপাশি মালয় ভাষা সমানতালে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার দাবিদার। এই ভাষাটি মালয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, তিমুর এবং থাইল্যান্ডে ব্যবহৃত হয়।
সর্বশেষ ভাষা হিসেবে আরবি জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার কারণ শুধু আরবি ভাষায় কত মানুষ কথা বলে, সেই দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় নয়। বিশ্বের ২২ টি স্বাধীন দেশ আরবি ভাষার ব্যবহার রয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলো জাতিসংঘের সমস্ত দলিল আরবিতে অনুবাদের সমুদয় অর্থ বহন করার নিশ্চয়তা দেওয়ার পরই আরবিকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
জনসংখ্যার বিবেচনায় বাংলা ভাষা বিশ্বে সপ্তম হলেও মাত্র দু'টি দেশে বাংলা ভাষা চালু আছে। যদিও সিয়েরা লিয়নের অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি রয়েছে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ প্রবাসি বাঙালি বাংলা ভাষায় কথা বলছে। তবুও প্রবাসীদের মধ্যে বাংলা ভাষার ব্যবহার খুবই সামান্য সেটি নিজের ঘরে, দাপ্তরিক কাজে নয়। তাই জাতিসংঘে সপ্তম ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি সহজ হবে না।
Advertisement
তবে কাজটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় শুরু করলেই দাবি আদায়ের আনুষ্ঠানিক কাজটি শুরু হয়। ইংল্যান্ডের বেশ কয়েকটি শহরের একাধিক সংগঠন বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি নিয়ে গত এক দশকে জাতিসংঘে ও লন্ডনের হাইকমিশনের কাছে স্মারকলিপি দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে এখন অনেকটা হাল ছেড়ে দিয়েছে।
ফেব্রুয়ারি মাস আসলে কেউ কেউ সেই পুরনো ফাইল ফলো আপ করার চেষ্টা করেন। আমরাও বছর বছর দু'চার কলম লিখে আবার চুপ করে থাকি। বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার প্রচেষ্টা সফলতার মুখ দেখে না। তবে জাগো নিউজের পক্ষ থেকে এই প্রচেষ্টা আবারো শুরু হয়েছে। এই উদ্যোগের সাথে যেহেতু তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার নিজে যুক্ত হয়েছেন তাই আশান্বিত হয়েছি। নিশ্চয়ই সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে ভাবতে শুরু করেছেন।
আমি এই কলামটি লেখার আগে লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের পুরনো স্মারকলিপি গুলো কোথায় জমা পড়ে আছে একটু খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ইংল্যান্ড থেকে যারা বাংলাদেশ হাইকমিশনে স্মারকলিপি দিয়েছিলেন তাদের ফাইল পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় সেই স্মারকলিপি গুলো আমলে নিয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে যে পাঠায়নি বা পাঠালেও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় যে এই বিষয়ে গত এক দশকেও কোন দৃশ্যমান উদ্যোগ নেয়নি সেটি পরিস্কার। তাই জাগো নিউজ বা অন্যান্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন যারাই বাংলা ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগে যুক্ত হয়েছেন তাদের উচিত হবে শক্তিশালী জনমত গড়ে তোলা এবং সেটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে সাথে নিয়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে করা।
একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে দাবিটি কিন্তু বাংলাদেশ সরকারকেই আনুষ্ঠানিকভাবে সাধারণ পরিষদে উত্থাপন করে রেজুলেশন আনতে হবে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত বাংলাদেশের দাবিটির প্রতি অন্য সদস্য রাষ্ট্রের সমর্থন থাকলেই বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে অন্তুর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। তবে তার আগে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সকল ডক্যুমেন্ট বা দলিল বাংলায় অনুবাদ করার ব্যয়ভার বহন করার জন্য সম্মত হতে হবে।
সর্বশেষ যখন আরবি ভাষা জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে যুক্ত হয়েছিলো তখন আরব বিশ্বের আরবি ভাষাভাষী দেশ অনুবাদের সমুদয় অর্থ দেওয়ার চুক্তি করে। যতদিন আরবি ভাষা জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা থাকবে ততদিন আরব বিশ্বের দেশগুলো জাতিসংঘকে অনুবাদের সমুদয় খরচ দিয়ে যাবে। তাই বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে অনুবাদের এই বিশাল অংকের অর্থ খরচের প্রতিশ্রুতি দেওয়া এবং সদস্যভুক্ত দেশগুলোর সমর্থন আদায় করা।
এখন এই বিশাল অংকের অর্থ খরচ করে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে আদৌ জাতিসংঘে বাংলা ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি নিয়ে কাজ শুরু করবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের। এই দাবি কতটা জোরালো হচ্ছে তার ওপর সরকারের কাজের গতি নির্ভর করবে। যেহেতু রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে জাতিসংঘে বাংলা ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে এমন কোনো সরকারি ঘোষণা এখনো আসেনি, তাই সরকারকে গতিশীল করতে এই দাবির প্রতি শক্তিশালী জনমত গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। তবে বাংলাদেশের জন্য সেলিং পয়েন্ট হতে পারে ইউরোপের দেশ গুলোর মধ্যে চারটি ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করা হয়েছে, আমেরিকা আর ব্রিটেনের রয়েছে ইংরেজি, এই বিষয়টি।
অন্যদিকে অ্যাফ্রিকার অনেক দেশেই আরবি ভাষা অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখন শুধু বাকি এশিয়ার একটি ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা। বাংলা ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য জাতিসংঘের ১৯৩ টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে এশিয়ার সদস্য ৫৩টি, তাই এশিয়ার সদস্যভুক্ত দেশেগুলোর সমর্থন জোরালো করতে পারলে বাকি অ্যাফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ গুলো।
আরবি যেহেতু জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ইতিমধ্যে স্বীকৃতি পেয়েছে তাই আরব লীগের ২২ টি দেশের বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায় সহজ হবে। এখন সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বাংলা ভাষার প্রতি জাতিসংঘের অপর সদস্যভুক্ত দেশগুলো কতটা সমর্থন দেবে সেই পরিকল্পনা নিয়েই এগোতে হবে। তবে বাংলাদেশ ছাড়াও যেহেতু ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষার বিস্তৃতি রয়েছে তাই এই ক্যাম্পেইনে ভারতকে যুক্ত করে এশিয়া অঞ্চল থেকে প্রস্তাবটি শক্তিশালী করতে হবে।
সর্বোপরি, প্রবাসে বাংলাদেশি সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যারা বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য দীর্ঘদিন দাবি জানিয়ে আসছিলো তাদেরকে বিদেশী দূতাবাসের মাধ্যমে সম্পৃক্ত করতে পারলে বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাববি আদায় করা সহজ হবে।
লেখক : কারেন্ট এফেয়ার্স এডিটর, চ্যানেল এস টেলিভিশন, লন্ডন। একাত্তর টেলিভিশনের যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি।tvjournalistuk@gmail.com
এইচআর/আরআইপি