খেলাধুলা

ইংলিশ আর অজিদের মত লঙ্কানদেরও কি স্পিনে বধ সম্ভব ?

ইতিহাস আশা জোগাচ্ছে। পরিসংখ্যান আলোকবর্তিকা-গত ১৭ মাসে ঘরের মাঠে বাংলাদেশ যে দুটি টেস্ট জিতেছে, তার দুটিই শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে।

Advertisement

প্রথমটি ২০১৬ সালের অক্টোবরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১০৮ রানের বড় ব্যবধানে। আর পরেরটি গত বছর আগস্টে অস্ট্রেলিয়ার সাথে (২০ রানে)।

তবে ইতিহাস এও জানাচ্ছে যে, ক্রিকেটের ওই দুই পরাশক্তির সাথে ঐতিহাসিক টেস্ট জয়ের সাক্ষী হলেও শেরে বাংলা এখনো বড় দলের সঙ্গে টেস্ট সিরিজ বিজয়ের সাক্ষী হতে পারেনি।

কি করে পারবে? ঘরের মাঠে বাংলাদেশের যে শুধু জিম্বাবুয়ে ছাড়া আর কোন প্রতিষ্ঠিত শক্তির বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ বিজয়ের রেকর্ড নেই। জিম্বাবুয়ানদের বিপক্ষে টাইগারদের আছে দু'বার সিরিজ বিজয়ের কৃতিত্ব। প্রথমবার ২০০৫ সালে (১-০), পরেরবার ২০১৪ সালে (৩-০)।

Advertisement

এরপর ‘বড় দলের’ তকমাধারি কারো বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ জেতা সম্ভব না হলেও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। তাও একবার নয় দু'বার।

খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়াকে বাগে পেয়েও সিরিজ হারাতে পারেনি। কাকতালীয় কিন্তু সত্য, ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার সাথে ঢাকার শেরে বাংলায় টাইগাররা যে দুই ম্যাচ জিতেছে দুটি সিরিজই ছিল দুই ম্যাচের এবং প্রতিটিই ১-১'এ অমীমাংসিত থেকে গেছে।

এর মধ্যে ইংলিশদের বিপক্ষে চট্টগ্রামে ২২ হেরে ঢাকায় জিতে সিরিজ ড্র করেছিল মুশফিকের দল। আর গত বছর আগস্টে অজিদের সাথে ঘটেছে উল্টো ঘটনা। ঢাকায় জিতে চট্টগ্রামে হেরে সিরিজ হয়েছে হাতছাড়া।

অবশেষে এবার একটি প্রতিষ্ঠিত দলকে ঘরের মাঠে সিরিজ হারানোর সম্ভাবনা জেগেছে। বৃহস্পতিবার থেকে শেরে বাংলায় শুরু হতে যাওয়া টেস্টে দিনেশ চান্দিমালের লঙ্কান বাহিনীকে হারাতে পারলে জিম্বাবুয়ের পর কোনো বড় দলের বিপক্ষে প্রথম সিরিজ বিজয়ের কৃতিত্ব ধরা দেবে। আর এ ম্যাচে মাহমুদউল্লাহর দল যদি জেতে, তাহলে টাইগারদের সোনালী সাফল্যে মোড়া ইতিহাস রচিত হবে ‘হোম অফ ক্রিকেটে।’

Advertisement

তা কি হবে? বাংলাদেশ কি আদৌ শ্রীলঙ্কাকে হারাতে পারবে? শেরে বাংলায় টাইগারদের নতুন সাফল্যের ইতিহাস রচিত হবে? এ প্রশ্ন রেখেই কাল থেকে শুরু বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার চলতি সিরিজের শেষ টেস্ট। চারিদিকে কৌতুহলি প্রশ্ন, 'লঙ্কা বধে কি কৌশল অবলম্বন করবে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের দল?'

ইতিহাস সাক্ষী দিচ্ছে, এর আগে এই মাঠে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে স্পিন সহায় পিচে বোলিং ছিল স্পিন কেন্দ্রিক । দুই টেস্টেই তিন জেনুইন স্পিনার (সাকিব, তাইজুল ও মিরাজ) খেলেছেন। এর মধ্যে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একাদশে ছিলেন একজন মাত্র পেসার (কামরুল ইসলাম রাব্বি)। আর অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে দুই জনের গড়া পেস বোলিং লাইন আপে বাঁহাতি মোস্তাফিজের সাথে ছিলেন শফিউলও।

একটি টেস্ট ম্যাচও হাই স্কোরিং ছিল না। এক ম্যচের কোনো ইনিংসে ৩০০ রানও ওঠেনি। শুধু ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২০১৬ সালের অক্টোবরে দ্বিতীয় ইনিংসে টাইগারদের স্কোর গিয়ে ঠেকেছিল ২৯৮‘এ। এছাড়া গড়পড়তা রান ২২০ থেকে ২৫০/২৬০ ‘এ ঘোরাঘুরি করেছে।

একটি ম্যাচও পুরো পাঁচ দিন হয়নি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয় ধরা দিয়েছিল তিন দিনের মাথায়। আর অজিরা হার মেনেছিল চার দিনে।

ওই দুটি জয়ই টিম ওয়ার্কের ফসল। তারপরও ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তামিম ইকবাল আর দুই স্পিনার ভিতরে মেহেদি হাসান মিরাজ ও সাকিব আল হাসানই ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দুই স্মরনীয় জয়ের পিছনে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশ ১০৮ রানে জয়ী হয়। খেলা শেষ হয়ে যায় তিনদিনেই। সে ম্যাচে ছয়টি করে (মিরাজ ২৮-২-৮২-৬, মিরাজ ২১.৩-২-৭৬-৬) ১২ উইকেট শিকার করে জয়ের নায়ক হবার পাশাপাশি ম্যাচ সেরা হন অফস্পিনার মিরাজ। অন্য দুই স্পিনার সাকিব (১৬-৫-৪১-১ এবং ১৩-১-৪৯-৪) ও তাইজুলও (২৫.৩-৩-৬৫-৩) দারুণ ব্যাকআপ করেছিলেন।

একইভাবে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও টাইগাররা জয়ী হয় স্পিনারদের হাত ধরে। এবার জয়ের নায়ক বাঁহাতি সাকিব। ব্যাট হাতে প্রথম ইনিংসে ৮৪ রানের ঝলমলে ইনিংস উপহার দেয়ার পর দুই ইনিংসে অজি ইনিংসের অর্ধেকটা পকেটে পুরে (সাকিব ৫/৬৮ ও ৫/৮৫) ম্যাচে ১৫৩ রানে ১০ উইকেট দখল করে ম্যাচসেরা এই অলরাউন্ডার।

এবারো কি সেই স্পিন নির্ভরতা? শেরে বাংলায় তাহলে আবারো স্পিন নির্ভর উইকেটে খেলা হবে? তাহলে আবারো স্পিনারদের দিকেই তাকিয়ে বাংলাদেশ? মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের দল কি শেরে বাংলায় আবারো স্পিননির্ভর বোলিং নিয়ে মাঠে নামবে?

নিশ্চয়ই খুব জানতে ইচ্ছে করছে, তাইনা? তাহলে শুনুন, টেস্ট শুরুর ২৪ ঘন্টা আগে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর কথায় পরিষ্কার, তারা এ ম্যাচেও স্পিন কেন্দ্রিক বোলিং সাজাবেন। তার ভাষায়, ‘দেখে মনে হচ্ছে, উইকেট বেশ শুষ্ক এবং স্পিন সহায়।’

যদিও দ্বিতীয় টেস্টের একাদশ ঘোষণা হয়নি এখনো। তবে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের কথায় মিলেছে পরিষ্কার ইঙ্গিত, টিম কম্বিনেশন হয়তো চট্টগ্রাম টেস্টের মতই থাকবে। তার মানে স্পিনিং ট্র্যাক। আর তিন স্পিনারের দেখা মিলবে আবারো।

মানা গেল, এই মাঠে গত দেড় বছরে দু'দুটি বড় জয় এই স্পিনারদের হাত ধরে। সেটা সব দৃষ্টিকোণ থেকেই ঠিক। ইংলিশ ও অজি ব্যাটসম্যানরা বরাবরই উপমহাদেশের স্লো ও স্পিনিং ট্র্যাকে এসে খাবি খায়। বাংলাদেশের মাটিতেও পারেনি।

ইংলিশদের বিপক্ষে মিরাজকে টেস্ট অভিষেকে মনে হয়েছে এরাপল্লি প্রসন্ন। আর সাকিব তো অস্ট্রেলিয়ানদের নাকানি চুবানি খাইয়ে ছেড়েছেন। সন্দেহ নেই, মিরাজ ও সাকিব দুজনই উইকেট থেকে সাহায্য পেয়ে ওই দুই সিরিজে অসাধারণ বোলিং করেছেন।

কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, তাদের প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং লাইন আপে বেশ ক'জন বিশ্বমানের তারকা ব্যাটসম্যান থাকলেও তাদের এমন স্পিন সহায় পিচে ভালো খেলার রেকর্ড খুব কম। তারা বরাবরই ভারত, শ্রীলঙ্কা আর বাংলাদেশে এসে স্লো আর টার্নিং পিচে আড়ষ্ট থাকেন। অস্বস্তিতে ভোগেন। কাজেই তাদের বধ করা সম্ভব হয়েছিল।

বোঝাই যাচ্ছে, সেই স্পিন সহায় পিচ ও অভিন্ন ফর্মুলায় লঙ্কানদেরও হারানোর চিন্তা। সেটা কতটা যৌক্তিক? যে দলের ব্যাটসম্যানরা এরকম স্লো ও স্পিনিং ট্র্যাকে খেলে খেলেই হাত পাকিয়ে ফেলেছেন, এমন পিচে তাদের বেকায়দায় ফেলা এবং পর্যুদস্ত করার চিন্তা কতটা সফল হবে, তা নিয়ে আছে সংশয়।

সাকিব থাকলে তাও একটা কথা ছিল। সাকিবও নেই। উইকেটে যতই টার্ন থাকুক, বল তো হাত-কব্জিতে ঘোরাতে হবে। সাকিব ছাড়া তাইজুল, মিরাজ আর রাজ্জাক (তিন নম্বর স্পিনার হিসেবে হয়তো এ অভিজ্ঞ বাঁহাতিকেই দেখা যাবে) তিন স্পিনার কি সেই কাজটা করতে পারবেন? তারা কি লঙ্কান ব্যাটসম্যানদের বিপাকে ফেলতে পারবেন? নাকি উল্টো লঙ্কান স্পিনাররা টুঁটি চেপে ধরবে টাইগারদের?

ভুলে গেলে চলবে না, লঙ্কান স্পিন আক্রমণও বেশ ধারালো। রঙ্গনা হেরাথের মত বিশ্বসেরা বাঁহাতি স্পিনার আক্রমণের নেতৃত্বে। যার ঝুলিতে ৪০০ এর বেশি টেস্ট উইকেট। বাঁহাতি চায়নাম্যান সান্দাকানও বেশ বল ঘোরাতে পারেন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে স্পিনিং ট্র্যাক আর অতি স্পিন নির্ভরতা না আবার ঝুঁকির কারণ হয়ে দেখা দেয়।

ধনঞ্জয় ডি সিলভা, কুশল মেন্ডিস , দিনেশ চান্দিমাল আর রোশন পেরেরা সিলভাদের হয়তো অ্যালিস্টার কুক, বেন স্টোকস আর জো রুট, অস্ট্রেলিয়ার স্টিভেন স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নারদের মতো তারকাখ্যাতি নেই, কিন্তু উপমহাদেশের স্লো ও স্পিনিং ট্র্যাকে খেলার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অনেক বেশি।

চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে সিরিজের প্রথম টেস্টেই যেমন দেখা গেছে, বাংলাদেশের স্পিনারদের নির্বিষ বোলিংয়ের বিপক্ষে ৭১৩ রানের হিমালয় সমান স্কোর গড়ে লঙ্কানরা। তিন তিনজন করেছেন সেঞ্চুরি, বিগ ফিফটি করেছিলেন দু'জন। এমন একটি দলের বিপক্ষে সাকিব ছাড়া স্পিন উইকেটে খেলা কঠিন চ্যালেঞ্জই হবে।

মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের দল কি সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে? উত্তরটা সময়ের হাতেই তোলা থাক।

এআরবি/এমএমআর/এমএস