ব্যাটিং যদি হয় তার ধ্যান-জ্ঞান, তাহলে কিপিং অবশ্যই তার ভাললাগা, ভালবাসা। ঠিক লোভ বা মোহ বলা যাবে না। তবে অধিনায়কত্ব বা নেতৃত্বের প্রতিও একটা অন্যরকম আকর্ষণ ছিল তার। বিভিন্ন সময় সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়কত্ব আর উইকেটকিপিং প্রসঙ্গ আসলে মুশফিকুর রহীমের মুখে থেকে দুটি কথা উচ্চারিত হয়েছে, ‘আমি আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব উপভোগ করি এবং তা যথাযথভাবে পালনের চেষ্টাও থাকে।’ কঠিন সত্য হলো, মুশফিকুর রহীমের ওই আকর্ষণ ও আর ভালবাসার বস্তু এখন হাতছাড়া। তার টেস্ট ক্যাপ্টেন্সি চলে গেছে। তার বদলে টেস্টে বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব বর্তেছে সাকিব আল হাসানের কাঁধে। টেস্টে কিপিংটাও আর করা হচ্ছে না। সর্বোচ্চ সতর্কতা, আর চরম মনোযোগ-মনোসংযোগে উইকেটের পিছনে প্যাড পরে গ্লাভস হাতে লম্বা সময় দাঁড়িয়ে থাকা আর হচ্ছে না। এখন টেস্টে মুশফিকের বদলে কিপিং করছেন লিটন দাস।
Advertisement
কাজেই টেস্ট দলে মুশফিকুর রহীম এখন শুধুই ব্যাটসম্যান। অথচ এই কয়েক মাস আগেও তিনি ছিলেন টেস্ট দলের সর্বেসর্বা। অধিনায়ক। সঙ্গে উইকেটকিপারও। এখন ওই দুই পরিচয়ের একটিও নেই। ভালবাসা, ভাললাগা এবং উপভোগ করার দু’ দুটি প্রিয় বস্তু হাতছাড়া।
যত বড় শক্ত মনের মানুষই হোন না কেন, এ রকম অবস্থায় প্রথমে নিজেকে স্বাভাবিক রাখা কঠিন। মানসিক স্থিরতা কমে যাবার কথা। পাশাপাশি ওই দুটি অতি প্রিয় ও উপভোগের বস্তু না থাকলে একটা অন্যরকম মানসিক চাপও পেয়ে বসার কথা।
সেগুলোই শেষ নয়। আরও একটা অন্যরকম চাপ ছিল। যা অধিনায়কত্ব চলে যাওয়া আর কিপিং করতে না পারার মত হতাশা, দুঃখ-যন্ত্রনার না হলেও বড় দুশ্চিন্তার খোরাক ছিল। তার স্ত্রী জান্নাতুল কিফায়া মন্ডি সন্তান সম্ভাবা এবং চট্টগ্রাম টেস্টের সময় কিংবা এক দুই দিন পর সন্তান ভুমিষ্ট হবার সম্ভাব্য দিনক্ষণ আগেই বেধে দিয়েছিলেন চিকিৎসকরা।
Advertisement
নিজের প্রথম সন্তান ভুমিষ্ট হবার সময় অনেক ক্রিকেটারেরই মাঠ ছেড়ে সন্তান সম্ভাবা স্ত্রীর পাশে থাকার নজির আছে। এই তো এবার বিপিএলের সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটার ড্যারেন স্যামি মাঠ থেকে সোজা উড়ে গেলেন সন্তান সম্ভবা স্ত্রীর পাশে থাকতে।
খবরটা চাওর হয়নি। তবে সত্য, মুশফিকুর রহীমও চেয়েছিলেন, সন্তান ভুমিষ্ট হবার আগে ও প্রসবের সময় পরে স্ত্রীর পাশে থাকতে। এ লক্ষ্যে বোর্ডের কাছে ছুটির দরখাস্তও দিয়েছিলেন; কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, শেষ মুহুর্তে সাকিব আল হাসান ইনজুরিতে পড়ে যাওয়ায়, মুশফিকের ছুটির আবেদন নাকচ হয়ে যায়।
টেস্ট চট্টগ্রামে না হয়ে ঢাকায় হলে তবু একটা কথা ছিল। মাঠে খেলা চলাকালীন সময়টুকু বাদ দিলে বাকি সময় হয়ত স্ত্রী ও হবু সন্তানের খোঁজ খবর নেয়ার সুযোগ থাকতো; কিন্তু বন্দর নগরী থেকে তো আর সে সুযোগ ছিল না।
জানা গেছে, চিকিৎসক ৫ ফেব্রয়ারিকেই সন্তান ভুমিষ্ট হবার পূর্ব নির্ধারিত দিন হিসেবে চিহ্নিত করে দিয়েছিলেন। সে কারণেই মুশফিক মানসিক উৎপীড়নে ছিলেন; টেস্ট চলবে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। কি জানি সন্তান প্রসবের দিনক্ষণ যদি একদিন এগিয়ে আসে, তাহলে কি হবে?
Advertisement
প্রচন্ড মানসিক চিন্তা-টেনসন কাজ করেছে নিশ্চয়ই; কিন্তু মুশফিকুর রহীমের মাঝে তেমন প্রতিক্রিয়াই হয়নি। ভিতরে প্রচন্ড চাপ নিয়েও ছিলেন নির্ভার। টেস্ট ক্যাপ্টেন্সি হারিয়ে আর গ্লাভস হাতে উইকেটের পিছনে বোলিং-ফিল্ডিংয়ে নজরদারি ও খবরদারি করার সুযোগ হাতছাড়া হবার পাশাপাশি প্রথম পিতা হবার চিন্তা- কিছুই তার ভাল খেলার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
এতটুকু হতাশ হতোদ্যম আর মানসিক উৎপীড়নে না ভুগে মুশফিক চরম পেশাদার মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। দেখিয়ে দিয়েছেন, কোনরকম মানসিক চাপ না নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে ব্যাট হাতে পারফরম করতে পারি আমি।
যারা এতকাল মুশফিককে আবেগপ্রবণ ও নরম স্বভাবের মানুষ বলে ভাবতেন, তারাও সব শুনে নিশ্চয়ই অবাক হবেন- সত্যিই এমন নানামুখি চাপ সহ্য করে এত ভাল খেললেন কি করে তিনি? মুশফিক দেখিয়ে দিলেন পরিশ্রম-অধ্যাবসায়, নিষ্ঠা ও ভাল খেলার আন্তরিক ইচ্ছে থাকলে শত দুঃখ, কষ্ট আর দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়েও ভাল খেলা যায়। রান করা যায়।
তার প্রমাণ চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম ইনিংসের দুর্দান্ত ব্যাটিং। মুমিনুল হক দুই ইনিংসে অনবদ্য শতরান করে প্রথম টেস্টের নায়ক। তার ব্যাট থেকে আসা ১৭৬ রান প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশকে ৫০০‘র ঘরে পৌঁছে দিয়েছে; কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, মুশফিকের অবদানের কথা।
সেঞ্চুরি করতে না পারলেও দলকে এগিয়ে নেয়ার কাজটি বেশ আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততার সাথেই পালন করেছেন মুশফিক। দুই ওপেনার তামিম ইকবাল আর ইমরুল কায়েস দলকে শক্ত ভিত গড়ে দেয়ার পর মুমিনুলের সাথে তৃতীয় উইকেটে তুলে দেয়া ২৩০ রানের বিরাট পার্টনারশিপেই আসলে বাংলাদেশ বড়-সড় পুঁজির পথে এগিয়ে যায় অনেকখানি।
শতরানের দোরগোড়ায় গিয়ে খানিক ভুল করে বসলেন তিনি। পড়ন্ত বিকেলে নতুন বল হাতে সুরঙ্গা লাকমালের অফ স্ট্যাম্পের ঠিক বাইরের বলে অযথা ব্যাট পেতে কট বিহাইন্ড হয়ে যান। মুশফিক ধৈর্য্য ধরে ১৯২ বলে ৯২ রানের ইনিংসটি সাজান। ৮ রানের আক্ষেপটা হয়ত কেটে গেছে।
দল লড়াই করে ম্যাচ ড্র করেছে। প্রথম টেস্ট শেষ হবার পরদিন সকালে তার ও স্ত্রী মন্ডির ঘর আলো করে এসেছে নতুন শিশু। খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রথম পিতা হয়ে মুশফিক আনন্দিত। উদ্বেলিত।
কে জানে সারা বছর যে মাঠেই কাটে অনেকটা সময়, সেই শেরে বাংলায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে জ্বলে উঠতে পারে মুশফিকের ব্যাট। ইতিহাস সাক্ষী দিচ্ছে, গত ১৩ মাসে ২০১৭ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে তার শেষ ১৮ ইনিংসে আছে দুটি শতরান। প্রথমটি ১২ জানুয়ারি ওয়েলিংটনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে (৩৬৫ মিনিটে ২৬০ বলে, ১৫৯, ২৩ বাউন্ডারি ও এক ছক্কা)।
পরেরটি গত বছর ৯ ফেব্রুয়ারি হায়দরাবাদে ভারতের বিপক্ষে ৩৮১ মিনিটে ২৬২ মিনিটে ১৬ বাউন্ডারি ও ২ ছক্কা। এই সময়ে মুশফিকের ব্যাট থেকে চারটি হাফ সেঞ্চুরিও (৮৫, ৫২, ৬৮ ও ৯২) বেরিয়ে এসেছে।
যার দুটি আবার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে (গলে ৮৫ আর শততম টেস্টে পি সারায় ৫২)। বাকি দুটি ঘরের মাঠে (২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ঘরের মাঠে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২৫২ মিনিটে ১৬৬ বলে ৬৮)।
এরপর দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে কিছু করতে পারেননি। চার ইনিংসে সাকুল্যে (৪৪, ১৬, ৭, ২৬) করেছিলেন ৯৩। আর এবার চট্টগ্রামে ৯২।
একমাত্র ডাবল সেঞ্চুরিটি (২০১৩ সালের ৮ মার্চে ৪৩৭ মিনিটে ৩২১ বলে ২২ বাউন্ডারি ও এক ছক্কা) লঙ্কানদের বিপক্ষে বলেই শুধু নয়, টেস্টে তার সবচেয়ে বেশি রান শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই (১২ টেস্টে ২২ ইনিংসে ৮৬৯ রান, এক সেঞ্চুরি ও ছয় হাফ সেঞ্চুরি)।
আর মাত্র ১৩১ রান করলেই শ্রীলঙ্কার সাথে এক হাজার রান পূর্ণ হবে। দেখা যাক ঢাকা টেস্টে নির্ভার মুশফিক তা করতে পারেন কি না?
এআরবি/আইএইচএস/এমএস