আন্তর্জাতিক

টালমাটাল পর্যটন স্বর্গ মালদ্বীপ, নেপথ্যে কী?

রাজনৈতিক সঙ্কট ঘনীভূত হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ মালদ্বীপে। প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লা ইয়ামিন জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণা এবং শীর্ষ আদালতের বিচারক ও দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্টকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়ার পর এ সঙ্কট অারো মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।

Advertisement

পর্যটকদের কাছে ছুটি কাটানোর স্বর্গ হিসেবে পরিচিত এ দ্বীপ রাষ্ট্রকে নিয়ে সংবাদ খুব কমই দেখা যায়। কিন্তু গত সপ্তাহে দেশটির বিরোধীদলীয় শীর্ষ কয়েকজন রাজনীতিককে মুক্তি দিতে সুপ্রিম কোর্টের দেয়া এক রায়ের পর প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনের স্বৈরাচারী প্রতিক্রিয়ায় টালমাটাল হয়ে ওঠে মালদ্বীপ।

ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের এ গভীর রাজনৈতিক সঙ্কটের অবসান হবে কীভাবে? ২০১৩ দেশটির ক্ষমতায় আসেন সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আব্দুল গাইয়ুমের সৎভাই আব্দুল্লা ইয়ামিন। ক্ষমতা নেয়ার পর ভিন্নমত দমনে কঠোর অবস্থানে যান তিনি; যা মালদ্বীপের অতীত ইতিহাস দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। বিরোধীদলীয় প্রায় সব রাজনীতিককে জেলে পুঠিয়েছেন তিনি।

চলতি সপ্তাহে মালদ্বীপের রাজনৈতিক অঙ্গন হঠাৎ অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। গত বৃহস্পতিবার দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদসহ বিরোধীদলীয় ৯ নেতাকে একটি মামলা থেকে খালাস দেয়ার পর তাদেরকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দেয়ার নির্দেশ দেন সুপ্রিম কোর্ট। একই সঙ্গে ইয়ামিনের দল থেকে বেরিয়ে যাওয়া ১২ সংসদ সদস্যকে তাদের পদে পুনর্বহালের নির্দেশ দেয়া হয়।

Advertisement

সুপ্রিম কোর্টের এ আদেশের ফলে ৮৫ আসনবিশিষ্ট মালদ্বীপের পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয় বিরোধীরা। অভিশংসনের শঙ্কায় সুপ্রিম কোর্টের দেয়া আদেশ সরকার বাস্তবায়ন করবে না জানিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন।

ক্ষমতাসীন সরকারের জন্য শুরু হয় কঠিন এক ঝড়; যার সূত্রপাত হয়েছে সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদকে ঘিরে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত দেশটির প্রথম এ প্রেসিডেন্টকে ২০১৫ সালে সন্ত্রাসবাদের বিতর্কিত এক মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট সর্বশেষ রায়ে মামলা থেকে খালাস দেয়ার পর বলছে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই সাবেক এ প্রেসিডেন্টকে মামলায় জড়ানো হয়েছিল। মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ায় চলতি বছরের নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন তিনি।

সোমবার প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন সুপ্রিম কোর্টে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছে এবং প্রধান বিচারপতিসহ ইয়ামিনের সৎভাই সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আব্দুল গাইয়ুমকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মামুন আব্দুল গাইয়ুম বর্তমানে সংসদের প্রধান বিরোধীদের সঙ্গে রয়েছেন।

সুপ্রিম কোর্টের প্রধান ভবনের বাইরে সোমবার শত শত মানুষ বিক্ষোভ করেছে। পুলিশ ক্ষুব্ধ মানুষকে ছত্রভঙ্গ করতে পিপার স্প্রে ব্যবহার করেছে। দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান প্রকাশ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন।

Advertisement

সেনাপ্রধান আহমেদ শিয়াম বলেছেন, মালদ্বীপ সঙ্কটে পড়বে আর তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে না সামরিক বাহিনী। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের অবৈধ কোনো আদেশ মানা হবে না বলেও সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি।

মামুন আব্দুল গাইয়ুম; যিনি ২০০৮ সালের আগে পর্যন্ত প্রায় ৩০ বছর দেশটির ক্ষমতায় ছিলেন। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দেশটির স্থানীয় দৈনিক মালদ্বীপ ইন্ডিপেনডেন্ট বলছে, মালদ্বীপের সাবেক এ প্রেসিডেন্টকে যখন তার বাসা থেকে বের করে আনা হয় তখন বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দাঙ্গা পুলিশের সদস্যরা স্যালুট প্রদর্শন করেন। বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেছেন, এখনো দেশটিতে গভীর শ্রদ্ধার আসনে থাকা গাইয়ুমকে গ্রেফতারের ফলে মালদ্বীপের নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে বিভাজন দেখা দিতে পারে।

জরুরি অবস্থা জারির ফলে দেশটিতে ধরপাকড়ে ব্যাপক ক্ষমতা পেল নিরাপত্তা বাহিনী। বিচার বিভাগের ক্ষমতা হ্রাস পাবে, এমনকি প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনকে অভিশংসনে সংসদে যে কোনো ধরনের পদক্ষেপ আটকে যাবে।

বিরোধীরা বলছেন, ইয়ামিন এখন উন্মত্ত। দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপে ব্যাপক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করে সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ বলেছেন, মার্শাল ল জারি হতে পারে।

ভারত মহাসাগরের ক্ষুদে এ দ্বীপরাষ্ট্রে সৌদি আরব এবং চীনের বিশাল বিনিয়োগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছেন প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন। সুতরাং তিনি এখন হয়তো ভাবছেন, রাজনৈতিক এ সঙ্কটে তার পাশে প্রচুর সমর্থন রয়েছে।

২০০৮ সালে মালদ্বীপের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা নেন মোহাম্মদ নাশিদ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় জরুরি আহ্বান জানিয়ে সেই সময় দ্রুত আন্তর্জাতিক তারকা বনে যান তিনি। সাগরে তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় থাকা এ দ্বীপ রাষ্ট্রটির অধিকারের ব্যাপারে বিশ্ব জনমতকে জানান দিতে পানির নিচে মন্ত্রিসভার এক বৈঠক করেন নাশিদ।

২০১৩ সালের বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নাশিদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ক্ষমতার মসনদে বসেন ইয়ামিন। তখন থেকেই দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে ধীরগতির অস্থিরতা শুরু হয়।

মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর বলছে, ক্ষমতায় আসার পর প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন তার জোটের সঙ্গে কৌশলে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। কারাবন্দি অথবা নির্বাসনে পাঠিয়েছেন প্রধান প্রধান বিরোধী নেতাদের; নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের বরখাস্ত করে পার্লামেন্টের বাইরে রেখেছেন। মানবাধিকার-সংক্রান্ত আইন সংশোধন করে নির্দেশ মানতে অপরাগতা প্রকাশকারী কর্মকর্তাদের নির্বিচারে চাকরিচ্যুত করেছেন ইয়ামিন।

রাজনৈতিক অস্থিরতায় ইতোমধ্যে দেশটির পর্যটন শিল্পে ধস দেখা দিয়েছে। যদিও দেশটির সরকার পর্যটকদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, ভ্রমণপিপাসুরা নিরাপদ। পর্যটন খাতের ওপর মালদ্বীপের অর্থনীতির চাকা ব্যাপক পরিসরে নির্ভরশীল।

মালদ্বীপের পর্যটকের অন্যতম উৎস চীন এবং প্রতিবেশী ভারত। রাজনৈতিক সঙ্কট শুরু হওয়ায় ইতোমধ্যে এ দুই দেশ তাদের নাগরিকদের মালদ্বীপে অপ্রয়োজনীয় সফর এড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে। এছাড়া যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের নাগরিকদের রাজধানী মালেতে চলাচলে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছে।

সন্ত্রাসী হামলার শঙ্কায় ২০১৫ সালে দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। ওই সময় মালদ্বীপ ভ্রমণে সব ধরনের বুকিং বাতিল করেন পর্যটকরা; যা দেশটির অর্থনীতিতে ব্যাপক আঘাত হানে।

গত বছর প্রায় ১৪ লাখ বিদেশি মালদ্বীপ ভ্রমণ করেছে; আগের বছর এ সংখ্যা ছিল প্রায় ১২ লাখ ৮০ হাজার। শ্রীলঙ্কায় থাকা সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ বলেছেন, চলতি বছরের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন তিনি। সঙ্কট সমাধানে আঞ্চলিক সুপার পাওয়ার প্রতিবেশী ভারতের জরুরি হস্তক্ষেপ চেয়েছেন তিনি।

অতীতে দুর্নীতির অভিযোগে বেশ কয়েকবার অভিশংসনের মুখে পড়েছিলেন ইয়ামিন। শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার অঙ্গীকার করেছেন তিনি। অন্যদিকে, বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরা ইয়ামিনের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

সূত্র : এএফপি, সান, মালদ্বীপ ইন্ডিপেনডেন্ট।

এসআইএস/আইআই