মতামত

গরম কড়াই হতে উত্তপ্ত উনুনে

দীর্ঘদিন ধরে উচ্চশিক্ষায় সেশনজট নামক এক ভয়াবহ রোগ আমাদের উপরে চেপে আছে। ঠিক কবে থেকে এ মরণব্যাধির শুরু হলো তা গুনে পড়ে বলা এখন আর সম্ভব নয়। তবে, ধারণা করি এরশাদ হঠাও আন্দোলন থেকে এর শুরু। এরশাদ হঠেছে ঠিকই কিন্তু সেশনজট আর হটেনি। উপরন্তু এটা ঠিকই জেঁকে বসেছে জগদ্দল পাথরের মতো। তবে, এটাও ঠিক যে এটা কমাতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নানা সময়ে নানা পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। ফলে এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেখানে অনেক বিভাগে সেশনজট নেই বললেই চলে। আবার এটাও সত্য যে, অনেক বিভাগে এখনও সেশনজট রয়ে গেছে।

Advertisement

১৯৯২ সালের আগ অবধি ঢাকা, রাজশাহী এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধীনে কলেজগুলোতে অনার্স, পাশ কোর্স পরিচালিত হতো; যেটা এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়ে থাকে। আগে দেখা যেত যে কোন কারণে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনাকাঙ্খিত বন্ধ হয়ে গেলে এর অধিভুক্ত কলেজের কোর্সগুলোও আর সময়মতো শেষ হতো না। ফলে অবধারিতভাবেই এসব অধিভুক্ত কলেজের ছেলে-মেয়েদেরকে সেশনজটে পড়তে হতো। তার উপরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সীমিত জনবল কাঠামো নিয়ে এ সকল কলেজগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন ছিলো। এখন তাহলে এ থেকে মুক্তির উপায় কি?

সমাধান হিসেবে যা হলো তা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় তিনটির অধীন থেকে অধিভুক্ত কলেজগুলোকে মুক্তি দিয়ে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। আর তারই চূড়ান্ত ফল হলো ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। এতে সবাই আশান্বিত হলো। কিন্তু অনেক বছর যাবৎ কাজের কাজ তেমন হলো না। সেশনজট চলতেই থাকলো। সম্প্রতি অবশ্য সেখানে উন্নতি হয়েছে। মোটামুটিভাবে জট কমতে শুরু করেছে। বর্তমান ভিসি মহোদয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নিয়ে ২০১৫ সালে ঘোষণা করেছিলেন যে, ২০১৮ সাল থেকে এখানে আর সেশনজট থাকবে না। অবস্থাদৃষ্টে বলা যায় মোটামুটিভাবে তা ফলতে শুরু করেছে। সেশনজট বর্তমানে নাই-ই বললেই চলে।

মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ম সমাবর্তন উপলেক্ষে ১২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত আনন্দর্যালিতে বলেছিলেন “সেশনজটের কারণে ছাত্র-ছাত্রীদের অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট হয়েছে। বর্তমানে আর কোনো পরীক্ষায় জট নেই। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন প্রায় ২ হাজার ৫০০ কলেজ এখন সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে।” (সূত্র : জাগো নিউজ, ১২ জানুয়ারি ২০১৭) এই যখন অবস্থা তখন আচমকা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ম সমাবর্তনের ১ মাস পরে ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সাত সরকারি কলেজকে "জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়" হতে বের করে এনে "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়" এর অধিভুক্ত করা হয়।

Advertisement

একে ঠিক আচমকাও বলা যাবে না। কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় স্নাতক (সম্মান) পড়ানো হয় এমন সরকারি কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা দেন। পরে এ বিষয়ে ইউজিসি পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং উপাচার্যরাও এর পক্ষে মত দেন ( সূত্র : জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েবসাইট)। তাই বলা যায়, প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার প্রতিফলনই হচ্ছে ঢাকার সাতটি কলেজকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয় ভালো মনে করেই এ উদ্যোগ নিতে বলেছিলেন। অথচ এখন আমরা কি দেখছি? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভালো ইচ্ছাটা আজ তুমুলভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাবভাব বলছে এ সকল কলেজগুলোর ভার নেয়ার সাধ্য তাদের নেই। এতদিন তারা সেটা স্বীকার করেনি। যদিও সম্প্রতি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তারা বলেছে যে পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই তারা এ সাতটি কলেজকে নিজেদের অধিভুক্ত করেছে। অথচ ২০১৭ সালে অধিভুক্ত এ সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা, ক্লাস এসব শুরু করার দাবিতে যখন রাজপথে নামলো তখন তাদের দাবিকে পাত্তাই দেয়া হলো না। তৎকালীন উপাচার্য এদের সাথে দেখা করারই প্রয়োজন বোধ করলেন না। এরই প্রেক্ষিতে ওদের চলমান শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলাকালে ২০ জুলাই, ২০১৭ সালে তেজগাঁও কলেজেরে ছাত্র সিদ্দিকুর পুলিশের আক্রমণে তার দু’চোখই চিরতরে হারালো।

এখন সরকার সিদ্দিকুরকে চাকরি দিয়েছে। এটা ভালো কথা। কিন্তু সিদ্দিকুরের চোখ হারানোর দায়ভার সত্যিকার অর্থেই কার উপরে বর্তাবে? এ প্রশ্ন তোলাটা কি তাই অযৌক্তিক হবে? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, এর দায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক স্যার কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। এড়াতে পারে না ইউজিসিও। কারণ উনারা এ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ছিলেন। ফলে তাই অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে, এ সকল কলেজকে অধিভুক্ত করার আগে করণীয় কাজগুলো উনারা কেন করেন নি? আর যদি সক্ষমতার ঘাটতি থেকে থাকে তাহলে সত্য কথাটা প্রধানমন্ত্রীকে কেন তারা জানাননি? আমরা অবাক হয়ে দেখলাম যে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সময়ের উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক স্যার এর দায়ভার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরে চাপানোর চেষ্টা করে গেছেন।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অলরেডি প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষ করেছে। কিন্তু ঢাবির অধীনে যারা আছে তাদের পরীক্ষা নাকি শুরু হবে ফেব্রুয়ারিতে। এটা শুধু প্রথম বর্ষের ক্ষেত্রেই নয়। বরং সব বর্ষের শিক্ষার্থীদেরই একই অবস্থা। শিক্ষার্থীদের এখন “ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি” অবস্থা। ফলে নানা সময়ে ওদেরকে রাজপথে নামতে হচ্ছে পরীক্ষা অনুষ্ঠান এবং একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রণয়নের দাবিতে। এটা কল্পনা করা যায়? এর সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। তাদের দাবি অধিভুক্ত এ সকল শিক্ষার্থীদেরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিমুক্ত করতে হবে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, অধিভুক্ত সাত কলেজের ওরা যেন “না ঘরকা না ঘাটকা”।

Advertisement

এমন অবস্থায়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আবারও হস্তক্ষেপ মনে হয় খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। নানাবিধ ঘটনাপ্রবাহ দেখে আমার মনে হয়েছে, এ সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিমুক্ত করে আবারো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিয়ে যাওয়ার মনে হয় এখন সময় হয়েছে। এখন সব থেকে ভালো হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেহেতু তাদের সক্ষমতার ঘাটতিকে স্বীকার করে নিয়েছে সেহেতু তাদের উচিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী এবং ইউজিসিকে অধিভুক্ত সাত কলেজের এ শিক্ষার্থীদেরকে আবারো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফিরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব করা।

আর তা না করলে এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ নেয়ার সময় এখন হয়েছে বলে মনে হয়। কারণ উনার ইচ্ছার আজ এমন করুণ অবস্থা দেখে করণীয় নির্ধারনে তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয়বার অন্য কিছুর ভাবার সময় নেই বলেই মনে হয়। সেই সাথে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করাও আশু প্রয়োজন। তাহলেই মনে হয় সবার মঙ্গল হবে।

লেখক : চিকিৎসক ও শিক্ষক।

এইচআর/জেআইএম