জাতীয়

প্রশ্ন ফাঁস রোধে সরকারের সব পন্থা বিফলে

সরকারের নানা উদ্যোগের পরও কোনভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না প্রশ্ন ফাঁস। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ্যে প্রশ্ন ফাঁস হলেও জড়িতদের ধরতে না পারায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ২০১২ সাল থেকে ব্যাপক আকারে প্রশ্ন ফাঁস শুরু হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় শুরু থেকেই তা অস্বীকার করে আসছে। এই অস্বীকার করার প্রবণতায় প্রশ্ন ফাঁস আজ মহামারি আকার ধারণ করেছে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।

Advertisement

তারা বলছেন, প্রশ্ন ফাঁস বন্ধে পুরোনো পরীক্ষা পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে নতুনভাবে সংস্কার করা প্রয়োজন। গতানুগতিক পদ্ধতি অবলম্বন করে পাবলিক পরীক্ষা চলতে থাকলে প্রশ্ন ফাঁস থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িতদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে প্রভাবমুক্ত একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠনেরও পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষাবিদরা।

পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এসএসসি ও সমমানের তিনটি পরীক্ষার প্রশ্নই ফাঁস হয়েছে। এবার প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে কেন্দ্রে হাজির বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগে থেকেই দেশের সব কোচিং সেন্টার বন্ধ, কেন্দ্র সচিব ছাড়া পরীক্ষা কেন্দ্রে আর কাউকে মোবাইল নিয়ে প্রবেশ করতে না দেয়া, সব ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস নেয়া নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু কোন কিছুই কাজে আসেনি। গত কয়েক বছরের মতো এবারও হচ্ছে প্রশ্ন ফাঁস। প্রথম দুটি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার পর তা ঠেকাতে এবং চক্রকে ধরতে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।

প্রশ্ন ফাঁস বন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, গতানুগতিক পদ্ধতি পরিবর্তন করে পাবলিক পরীক্ষায় পরিবর্তন আনতে হবে। বিট্রিশ আমলের প্রণীত পদ্ধতি দিয়ে আর চলতে পারে না। পুরোনো পদ্ধতি অবলম্বন করায় বারবার প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। এই শিক্ষাবিদ বলেন, পুরোনো কারিকুলাম, সিলেবাস, প্রশ্ন পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বোর্ড পদ্ধতি বাতিল করে স্কুলভিত্তিক পাবলিক পরীক্ষা আয়োজন করতে হবে। এরপর সেসব পরীক্ষার খাতা শিক্ষকরা মূল্যায়ন করবেন। স্কুলের স্টান্ড্যান্ড অনুযায়ী বোর্ড কারিকুলাম নির্বাচন করে দিবে। সেই কারিকুলাম অনুযায়ী নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা আয়োজন করলে প্রশ্ন ফাঁসের কেলেঙ্কারি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।

Advertisement

পরীক্ষা পদ্ধতি বিশ্বের সব দেশেই আছে। আমরা কেন তাকে ধ্বংসে নেমেছি এমন প্রশ্ন তুলে সিরাজুল ইসলাম বলেন, পৃথিবী পরিবর্তন হচ্ছে, অথচ আমরা সেই পুরোনো পদ্ধতিকেই আকড়ে রেখেছি। এ কারণে পাবলিক পরীক্ষা শুরুর আগেই প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে তিনি পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন ও অভিন্ন পদ্ধতি বাতিলের দাবি জানান। প্রশ্ন ফাঁস রোধে গতকাল রোববার বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সভাপত্বিতে জরুরি এক বৈঠক হয়েছে। বৈঠক শেষে প্রশ্ন ফাঁসকারীকে ধরিয়ে দিলে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এছাড়া সেই বৈঠকে ১১ সদস্যবিশিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের একটি পরীক্ষা বাতিল কমিটি তৈরি করা হয়েছে। পাবলিক পরীক্ষার আগে বা পরে প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রমাণিত হলে সে পরীক্ষা বাতিল করতে পারবে কমিটি। এছাড়া প্রশ্ন ফাঁস রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো তৎপর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে মানুষের পক্ষে যা যা করা সম্ভব আমরা তাই করছি। তারপরও তা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। যারা এসব কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের সকলকে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। খুব শিগগিরই তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়তে হবে। তিনি বলেন, প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী, ছাপার কাজে যুক্ত, প্রশ্নের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এবং বিভিন্ন পর্যায়ে পরিবহন ও বিতরণের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১০ হাজার মানুষ জড়িত রয়েছেন। তাদের কেউ একজন অসাধু হলে সবার সততা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এ কারণে আরো কি কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে তা ভাবা হচ্ছে। এসব চক্রের সঙ্গে জড়িতদের ধরিয়ে দিলে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। এদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আরো তৎপর হয়ে উঠেছে।

তিনি আরো বলেন, প্রশ্নপত্রের খাম সিলগালা করা হয়। কেউ ইচ্ছে করলে সেটি খুলে আবারো নতুন করে সিলগালা করতে পারে। এ কারণে আগামী বছর থেকে সিকিউরিটি টেপ ব্যবহার করে সেই খাম বন্ধের কথা ভাবা হচ্ছে। তাতে করে কেউ সেটি খুললে তা ধরা পড়বে। এছাড়া প্রশ্নফাঁস বন্ধে আরো কি ধরনের পদ্ধক্ষেপ নেয়া সম্ভব তা ভাবা হচ্ছে। তবে প্রশ্ন ফাঁসকারীরা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও বিতরণ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে একটি উচ্চমানের তদন্ত কমিটি করে অপরাধীদের ধরার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

এই শিক্ষাবিদ জাগো নিউজকে বলেন, প্রশ্ন ফাঁস বা তার গুজব শিক্ষার্থীদের মানসিকতা দুর্বল করে দেয়। এ কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকলে শিক্ষা ব্যবস্থায় ধ্বস নেমে আসবে। রাষ্ট্রে মেধাবি জাতি তৈরি হবে না। তাই এসব কেলেঙ্কারি বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে একটি শক্তিশালী কমিটি তৈরি করতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের সার্বিক সহায়তা প্রদান করতে হবে। এ কাজের সঙ্গে জড়িত যেই থাকুক না কেন, অপরাধীর মুখোশ উম্মোচন করে তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিতে হবে। মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনাকে অস্বীকার করলেই এখান থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে না। পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নের ধরন পরিবর্তন আনতে হবে। এমনভাবে প্রশ্ন তৈরি করতে হবে যা ক্লাসে ৫০ শতাংশ মূল্যায়ন হয়েছে। তবেই প্রশ্ন ফাঁসের প্রতি আগ্রহ কমে যাবে। বহুনির্বাচনী প্রশ্ন ক্রমান্বয়ে তুলে দিতে হবে। সৃজনশীলতার দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে পরীক্ষার্থীরা নিজের মেধা খাটিয়ে লিখতে পারে। প্রশ্ন ফাঁস ও কোচিং ব্যবসা বন্ধে তিনি পঞ্চম শ্রেণির পিইসি-সমাপনী ও ৮ম শ্রেণির জেএসসি-জেডিসি’র পাবলিক পরীক্ষা বাতিলের দাবি জানান।

Advertisement

এমএইচএম/ওআর/এমআরএম