যাত্রাবিরতি চীনে। চাইনিজদের মত সস্তায় জগতের তাবদ সব পণ্য কেউ বানাতে পারেনা। তেমন এদের মত সস্তায় এতো এতো ফ্লাইটও কারোর হয় না। স্রেফ পঁয়ত্রিশ হাজার টাকাতেই চায়না এয়ারলাইন্সে জাপান থেকে ঢাকায় যাওয়া আসা হয়ে যায়; যেখানে মূল্যতালিকায় এর পরের স্থানে থাকা থাই এয়ার বা ড্রাগন এয়ারে সাধারণত ৬০ হাজারেও হয় না। তাও মাসখানেক আগে টিকেট কেটে না রাখলে থাই, ড্রাগন, মালয়েশিয়া বা অন্যান্য এয়ারে আরো অনেক বেশি পড়ে যায়। কিন্তু সস্তার তিন অবস্থার মত স্বাভাবিকভাবেই ফ্লাইটের অবস্থাও তথৈবচ।
Advertisement
ফ্লাইট তাও সহ্য করা যায়, জাপান থেকে ঢাকা ৮ ঘন্টাই তো । কিন্তু যাত্রাবিরতি দুই বা তিনবার মিলে সময় দাঁড়ায় প্রায় ২৪ ঘন্টা। আর এর মধ্যে কোন বিরতি যদি হয় মাত্র দেড় ঘন্টার তো সব রাহে লিল্লাহ ! একে তো চাইনিজদের বাজে ব্যবহার, সবসময় তেড়ে আসার মত ঝগড়াটে ভঙ্গি আর কর্কশ কণ্ঠ সপ্তমাত্রায় চড়িয়ে জিজ্ঞাসাবাদ, কথাবার্তা। তার উপর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও তারা পারতপক্ষে ইংরেজি না বোঝার ভান করে থাকে। বিপুল যাত্রীদের চাপ এড়াতে কোন কথার জবাব না দিয়ে লেফ্ট রাইট করিয়ে পার পেতে চায়।
জাপানেও ইংরেজি চলে না। কিন্তু জাপানিদের অতি বিনয়, নরম স্বভাব আর আন্তরিকভাবে সাহায্যের চেষ্টা ভাষা সমস্যার এমন বৈরি অবস্থায় একটা ভরসা জোগায়। চায়নার বিভিন্ন এয়ারপোর্টে আমারই এসব তিক্ত অভিজ্ঞতা কয়েকবার। বিশেষ করে সাংহাই (পুডং) এর নতুন এয়ারপোর্ট চাইনিজ ছাত্র ছাত্রীদের কাছেই ভীতিকর। প্রথম যেবার সেই এয়ারপোর্টে যাত্রাবিরতি হলো দেশে যাবার পথে, জিজ্ঞেস করলাম পরের ফ্লাইটের জন্য কোন গেইটে যেতে হবে বা গেইটটা কোনদিনে- এমনকিছু। ইমিগ্রেশন কর্মী টিকেটের দিকে না তাকিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীতের এক লাইন দেখিয়ে এয়ারপোর্ট কর্মীদের সাথে ফের খোশ গল্পে ব্যস্ত। লাইনে গিয়ে দাঁড়ানোর পর এক ইওরোপিয়ান বললেন, “ তুমি ভুল লাইনে এসেছ, তোমার ফ্লাইট একদম উল্টাদিকের দোতলায়।”
এভাবেই স্বদেশী বা ভিনদেশী এবং চেনেন জানেন এমন কোন যাত্রীকে পুনরায় না জিজ্ঞেস করে নিলে হ্যান্ড লাগেজ টেনে হেইয়ো হেইয়ো করতে করতে বিশাল এয়ারপোর্টের একেবারে একপ্রান্তে এসে জানবেন আপনি সম্পূর্ণ ভুল প্রান্তে এসে গেছেন । তাই যাত্রাবিরতি স্রেফ দেড় ঘন্টার হলে এইসময়ে স্রেফ জান বাজি রেখে অলিম্পিকজয়ী উসাইন বোল্ট হয়ে উড়তে উড়তে আপনার কানেক্টিং ফ্লাইট ধরতে হবে। আরেকবার দেশ থেকে জাপানের ফিরতি যাত্রায়। বেইজিংএ কানেক্টিং ফ্লাইটের লাইনে পৌঁছানোর পর আমাকে জানিয়ে দিল , “ তুমি পরের ফ্লাইট মিস করেছ ।” স্রেফ হাত পা ছড়িয়ে বসে গেলাম। পরের ফ্লাইট আধা বেলা পরে! নতুন টিকেট লাগবে কিনা বা লাগলে কত, সেই টাকা সাথে আছে কিনা বা ক্রেডিট কার্ড নেবে কিনা চিন্তায় ভাবনায় মাথায় আকাশ ভাঙা অবস্থা! পরদিন অফিসের টেনশন তো আছেই।
Advertisement
ময় মুরুব্বির দোয়া ছিল যে কিছুক্ষণ পরে আল্লাহ পাকের খাস রহমতের মত এক এয়ারহোস্টেস স্রেফ মাসিহা হয়ে ছুটতে ছুটতে এসে আমাকে উদ্ধার করলো। সবলাইন বাঁচিয়ে দ্রুত সিকিউরিটি চেকইন, বোর্ডিং পার করিয়ে নিয়ে গেল কানেক্টিং ফ্লাইটে যাবার অপেক্ষমান বাসে। এইতো গেলো ফ্লাইট। এবার এয়ারপোর্টের অন্যান্য চালচিত্র। ট্রানজিটে জানলেন পরের ফ্লাইট ডিলে। কত দেরি? কখন আসবে? বেশি দেরি হলে এর পরের কানেক্টিং ফ্লাইট কি পাব? আবারো তাদের মুখে কুলুপ! তারা তখন জগতের আর কোন ভাষাই বোঝেন না, এমনকি বডি লেংগুয়েজও না! এক দু্ঃসহ উদ্বেগ নিয়ে যাত্রা শেষ করা।
আরেক অভিজ্ঞতাও জানান দেয়া আবশ্যক। কোন নাজুক পণ্য বা হার্ড বডি / লক সিস্টেম ছাড়া অন্য কোন রকম লাগেজ বহন খুবই বিপজ্জনক। চায়নার এয়ারপোর্টের লাগেজ বেল্টে যে বিপুল হর্স পাওয়ারে লাগেজ ছুঁড়ে ফেলে তাতে নাজুক পণ্যের কি হাল হতে পারে তা বলাই বাহুল্য। আর ছুরি কাঁচি না, স্রেফ বল পেন চালিয়ে চেইন সিস্টেম লাগেজ ফাঁক করে আইটেম কি কি বের করে নিতে পারে তার কোন গ্যারান্টি নাই। এসবে ক্ষেপে যাবার কিছু নাই। এত সস্তা কিছু করতে অবশ্যই লেবার খরচ, নিরাপত্তা সুবিধা থেকেই পয়সা বাঁচাতে হয়েছে। তার ভর্তুকি তো আপনাকে দিতেই হবে। বহনকৃত আইটেমের ধরন সম্পর্কে সাবধান।
শুকনা খাবার দাবার অন্য খাবার , বিশেষ করে কাঁচা কোন কিছু নিয়ে পার পাওয়া দুঃসাধ্য । অনেক সাধ করে আনা কোরবানির মাংস, বাড়ির গাছের কাঁচা পাকা আম, মরিচ, ঘরে পাতা গাওয়া ঘিসহ অনেক সাধের জিনিস নিয়ে এসে সদকা দিয়ে ফিরতে হয়েছে অনেককে। এগুলি নিতে দেয়া হবে না। আর , গোদের ওপর বিষফোঁড়া হলো ফ্লাইট ডিলে হলে এই তথ্য অপেক্ষমান আত্মীয় বন্ধু কাউকে জানানোর সুযোগ নাই।
কারণ , আমাদের যোগাযোগের সবচেয়ে প্রচলিত মাধ্যম ফেসবুক চায়নায় নিষিদ্ধ। ভাইবার কচিৎ কাজ করে তো করেনা। এক উপায় স্কাইপ, তাও স্কাইপ আইডি পেশাগত কাজের মানুষ ছাড়া প্রায় কারোই সেভাবে জানা থাকেনা বা থাকলেও স্কাইপে তারা কেউ তেমন অনলাইনেও থাকেনা। আর, এয়ারপোর্টের ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড জোগার করার জন্যেও ইনফরমেশনে কথা বলে মেশিনে পাসপোর্ট ঢুকিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পাসওয়ার্ড নিয়ে সেট করতে হয়।
Advertisement
চায়না এয়ারলাইন্স সম্পর্কে আমরা খোঁজ পেয়েছি ২০১২র দিকে। কিন্তু নিজের এতে ট্রাভেল করা হয়েছে ২০১৫ তে, বইমেলায় নিজের প্রকাশিত প্রথম বই “তোরসা”র সূত্রে। এর আগে ক্যাথে পেসিফিকে দেশে যাতায়ত হতো । কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতার আগেই ২০১৪তে আমার বাবা মায়ের যাত্রা দিয়েই এই এয়ারলাইন্সের অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছিল। প্রথমবারের মত জাপানে আমার বাসায় বেড়াতে আসছিলেন। বয়স্ক মানুষ দুইজন। তাই অনেক আগেই চিংদাওতে সারারাতের যাত্রাবিরতিতে হোটেল বুকিং করে রেখেছিলাম। অনলাইন বুকিং সাইটটার কলসেন্টারে কয়েকবার করে ফোন করেছি, ইন্ডিয়ান কর্মীগুলো বার বার হোটেল বুকিং নিশ্চিত করেছিল।
নির্দিষ্ট দিনে হোটেলের কারো টিকিটারও দেখা নাই। মাইনাস ৪/৫ ডিগ্রির শীতের রাতে চিংদাওতে আরো কয়েকজন অচেনা বাঙালির সাথে বাবা মাকে এয়ারপোর্ট বন্ধ করে বাইরে দাঁড় করিয়ে দিল! তাদের এয়ারপোর্ট রাতে বন্ধ করে দেবে। ভেতরে লোক থাকতে পারবে না। ট্রানজিট বা এক্সিট যাত্রী কি করবে তাদের মাথা ব্যথা না। আমার অবসরপ্রাপ্ত সচিব বাবার জিন্দেগীতে এহেন অপদস্ত হবার অভিজ্ঞতা নাই। এত শীতের রাতে বাইরে কাটাবার অভিজ্ঞতাও নাই। আশে পাশে অনেকে চৈনিক ট্যাক্সি ক্যাবওয়ালা ব্যাগ নিতে টানাটানি করছে; তাদের পরিচিত হোটেলে নিয়ে যাবে বলে। বাবা মা উঠে যাবেন যে কোনোটায়, এমনি ভাবছেন।
আতঁকে উঠে সাবধান করলেন বাঙালি তরুণ কিছু সহযাত্রী। -আংকেল , খবরদার এদের কথা শুনবেন না। কোথায় নিয়ে লাগেজ টাকা কেড়ে আপনাদের মেরে কেটে ফেলে দিয়ে যাবে। কোন হদিশও হবে না। একটাই তো রাত। এয়ারপোর্টের বাইরে হলেও বারান্দাটা তো অপরিচ্ছন্ন না। শীতের কাপড় হ্যান্ড লাগেজে আছে তো? চাদর বিছিয়ে, গায়ে গরম কাপড় দিয়ে জানটা বাঁচান। ৫/৬ ঘন্টা দেখতে দেখতেই কেটে যাবে। তারা কোরিয়ায় যাচ্ছে কেউ, কেউ জাপানের অন্য শহরে । এর আগেও এমন কিছু অভিজ্ঞতা তাদের ঝুলিতে আছে । তাই অনভিজ্ঞ বাবা মা আর সাহস করলেন না অন্যথা ভাবতে। আর যোগাযোগের তো উপায়ই নেই। কাজেই আমরাও কিছুই জানতে পারলাম না। এই অভিজ্ঞতার পর শপথ নিয়ে আর কোনদিন অনলাইনে চায়নায় যাত্রা বিরতীতে হোটেল বুকিং দেইনা। এয়ারপোর্টে গিয়ে বাঙালি স্বরূপে মুলামুলি করেই হোটেল নেই। আর সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে কুনমিংএ যাত্রা বিরতি নেয়া। কারণ সেখানে প্রচুর বাংগালী হোটেল আছে , যারা এয়ারপোর্ট থেকে পিক এন্ড ড্রপ থেকে শুরু করে হোটেলে একেবারে ঘরের সেবা দিয়ে রাখে, খুবই সুলভ মূল্যে।
প্রথমবারের এই অভিজ্ঞতার পর আমার চাইনিজ ছাত্র ছাত্রীদের প্রশ্ন করেছিলাম ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে। দেখলাম তারা ফেসবুকের বদলে নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে। ভাইবার , হোয়াটস আপের বদলে উই চ্যাট, ওয়েই বো । এমনকি জিমেইল ইউটিউবেও নিষেধাজ্ঞা। হতভম্ব হলাম এমনকি গুগল এবং উইকির বদলে তাদের নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিন। এবং এর কারণ খতিয়ে দেখতে গিয়ে জানলাম চায়না সরকারের সম্পূর্ণ নজরদারির আওতায় যা নেই এমন কোন কিছুই সে দেশে বরদাশত করে না। ফেসবুক এই এখতেয়ার দেবে না বলেই চায়নায় ফেসবুক নেই। তাই চীন যাত্রার আগে কিছু পুঁথি পাঠ নিয়ে নিলে ভালো হয়। নাহলে অনেকের মতই অবরুদ্ধতার এক ভীষণ বৈরি অভিজ্ঞতা পেতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান।neeta2806@yahoo.com
এইচআর/জেআইএম