ভ্রমণ

জল-অরণ্যের কাব্য

রাতারগুল গ্রামের স্লুইসগেইট ঘাটে পৌঁছে নিকটবর্তী দূরে সবুজের রেখা দৃশ্যমান। রাতারগুল জলাবন। রেখার ভেতরেই একপাশে খুব অহংকারী মাথা উঁচু দণ্ডায়মান ওয়াচটাওয়ার, তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়েই চলেছে।

Advertisement

ইঞ্জিন নৌকায় উঠলাম। আমি, হাবীব, সাচ্চু ভাই, দিশা, রেদোয়ান ভাই। সঙ্গে শিহাব ভাই, গিয়াস ভাই আর মাঝি রহিম। গিয়াস ভাই স্থানীয় কৃষক রাজনীতির নেতৃত্ব দেন। গেল আষাঢ়ের শেষ দিন। সকালের বৃষ্টি থেমেছে অনেক আগে। ঝকঝকে রোদ্দুর, ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ আর বিরতি দেয়া বাতাস। ধূসর ধোঁয়া ছেড়ে জলযান শিয়ালীছড়া খাল হয়ে এগিয়ে চলে। রাতারগুলের পাশ দিয়েই যেতে থাকি আমরা। আমার আর গিয়াস ভাইয়ের কথোপকথনে বেশ কয়েকবার প্রসঙ্গ এলেও দলের সদস্যরা বুঝতে পেরেছিল-পারেনি এমন অবস্থা যে, আমরা রাতারগুল জলাবনের পাশ দিয়েই চলছি। তারা ভেবেছিল এটা রাতারগুলেরই অংশ তবে সামনে নিশ্চয়ই এর আরও বৃহৎ কলেবর। দিশা পরে বলেছিল, সে টের পেলেও নীরব থেকেছিল।

আলাপে আলাপে গিয়াস ভাই আমাদের জানালেন, এই অনন্য বনটি ক্রমেই হারাচ্ছে তার অস্তিত্ব। সরকারি নথিতে ৩০০ একরের বেশি উল্লেখ থাকলেও আছে ২০০ একরের কিছু বেশি। ২০১০-১১ সালের দিকে বনটা বাইরের মানুষের দৃষ্টিগোচর হওয়ার সময় প্রায় ৫০০ একরের বেশি ছিল, এর আগে ছিল আরও বেশি। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের অপরিণত-অপরিপক্ক ভ্রমণ-খড়্গ আর সীমাহীন লোভ বনের অন্যান্য সৃষ্টির প্রাণনাশ ও প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পলায়নের গল্পের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আগে তো পাখির কুজনে মেতে থাকতো এই বন, আর আমরা খুব দূর থেকে একটা-দুটা ব্যথিত অভিমানী পাখির ডাক শুনলাম।

শিয়ালীছড়া খালের পর নৌকা পড়লো গোয়াইন নদীতে। এ পথ খাল-নদী মিলিয়েই, গোয়াইনের পর মোয়ালীখাল, পূর্ব পেকের খালসহ কয়েকটি খাল পেরিয়ে আমরা উঠবো পিয়াইন নদীতে। যেতে যেতে পরে পূর্ব পেকের গ্রাম, চলিতাবাড়িসহ কয়েকটি গ্রাম। এখানকার মানুষের জীবন জলের সঙ্গে গভীর পরিচয়ের। বর্ষা মৌসুম তো আছেই, বলা যায় অর্ধবছর নৌকা দিয়েই জীবন প্রণালী সচল রাখে এরা। ৪-৫ বছরের এক শিশু পরিণত বয়সের মানুষ সমেত নৌকা অনায়াসে চালাতে পারে। খুব ছোট থেকেই এরা দক্ষ সাঁতারু ও জেলে। নৌকা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হাসিমুখে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানায়।

Advertisement

একটু পিছনে ফেরা যাক। অনেকদিন থেকেই শুনছিলাম রাতারগুলের অবস্থা বড়ই সঙ্গীন, নিজ চোখে তা দেখার সাধ ছিল। গতবছর ঈদুল ফিতরের দিন দেখে গিয়েছিলাম, মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এবার আশরাফ ভাইকে আগেই বলে রেখেছিলাম, তিনিও সানন্দে রাজি হলেন। আশরাফ ভাই সিলেটেই থাকেন। একাধারে সাংবাদিক, ‘বাঁচাও রাতারগুল’সহ পরিবেশবাদী আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং অনেক কিছু। অসুস্থতার কারণে নিজে সময় দিতে না পারলেও তার পারিবারিক নোয়া গাড়িটা বিনা ভাড়ায় আমাদের যাতায়াতের জন্য দিয়েছেন। এরই চালক শিহাব ভাই। সিলেট শহরে নাস্তা সেরে বিমানবন্দর সড়ক দিয়ে রাতারগুলের পথে। দীর্ঘদিনের খানা-খন্দের রাস্তার সংস্কার চলছে। এরই মাঝে নামলো বৃষ্টি, সিলেটের বৃষ্টি। সবার আশঙ্কা, কেমনে কী। আর আমার মুচকি হাসি।

জলে ফেরা যাক। প্রকৃতি তার সৌন্দর্যের অবগুণ্ঠন নিঃসঙ্কোচে খুলে দিয়েছে, আর তারই শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধে নিমজ্জিত সবাই। কখনো সচেতন, কখনো অবচেতন মনে নৌকার জল কাটার তালে তালে চলছিলো একক আর সম্মিলিত মাটির গান, সমান তালে বাজছিলো মোবাইল ক্যামেরার শাটারের শব্দ। নৌকা একসময় নতুন একটি ঘাটে থামলো। ছোট বিরতি। নতুন ঘাট, নতুন বাজার, নাম তার মুন্সির বাজার। বেশিদিন হয়নি পত্তন হয়েছে। বাজার থেকে একসময় হাট হবে, এরপর গঞ্জ, নৌকার যাতায়াত বাড়বে, বাণিজ্য বাড়বে, পয়সা হবে মানুষের, আর সর্বনাশ ঘটবে নদী-খালের।

নৌকা আবারও এগিয়ে চলে। দিশার জিজ্ঞাসা, যাচ্ছি কই। বাকি ৩ জনের জিজ্ঞাসা আর কতদূরে রাতারগুল জলাবন। আমি আর গিয়াস ভাই পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হেসে তাদের সবুর করতে বলে নিসর্গে ডুবে যেতে বলি। একটু পরপরই হাঁসের ঝাঁকের জলকেলি, মাছরাঙা, বক আর পানকৌড়ির শিকার-প্রতীক্ষা। হুট করে মিলি সেকেন্ডের জন্য অন্ধকার হয়, ওপরে তাকিয়ে দেখি আমাদের বরাবর সূর্যের নিচ দিয়ে শঙ্খচিল উড়ে যাওয়ায় এমন চকিত আঁধার। শঙ্খচিল যেন জানান দেয়, বিশালতায় একটু ছেদে চমকে ওঠা কেন। যেতে আসতে অনেক বৈঠা বাওয়া নৌকা, ইঞ্জিন নৌকার চলাচল, মানুষ, পণ্য। কয়েকটি ভারতীয় গরুবাহী নৌকা দেখলাম, গিয়াস ভাই বলল, ওসব চোরাই। ততক্ষণে মেঘালয়ের পাহাড়শ্রেণি দৃষ্টিসীমার সিংহভাগে। সবার মুখে আকর্ণ হাসি। পরক্ষণেই চুপসে যাওয়া, কেননা পাহাড়ের গা ফুঁড়ে-বেয়ে ঝরনার উৎস সবই ভারতে, পতনের পরে পানি মিশেছে বাংলাদেশের নদীতে।

পিয়াইন ঘাটে যাওয়ার রাস্তা দেখে মনে পড়লো ২ বছর আগের কথা। সেবার ভরা বর্ষায় আমরা সারাদিন নৌকায় করে কুলুমছড়া-লক্ষ্মণছড়া-পানথুমাই-বিছনাকান্দি দেখেছিলাম। উজান ক্রমেই কাছে হওয়ায় মোটরের শক্তি বাড়াতে হলো। পিয়াইন ঘাটের কাছে পৌঁছে যতদূর চোখ যায় পাথর ও বালু তোলার যথেচ্ছাচার। ফলস্বরূপ পরিবেশ ওষ্ঠাগত। প্রশাসন ও অন্য কেউ বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি করেনি বলে দরিদ্র মানুষদের ব্যবহার করে ধনবানদের প্রবল থাবা আঁকড়ে বসেছে। কয়েকটি বাঁক পেরিয়ে, ১৫-২০ কিলোমিটারের ৩ ঘণ্টার যাত্রায় পর্যটক সমেত যে স্থানে পৌঁছে আমিই আগ বাড়িয়ে বললাম, এটা বিছনাকান্দি। সবাই খুশিতে কুটিকুটি। একইসঙ্গে জিজ্ঞাসা, রাতারগুল কই? আমি ও গিয়াস ভাই উত্তর দিলাম, সেটা তো ফেলে আসলাম, ফেরার পথে হবেক্ষণ। সবার সে কি আনন্দ-হিল্লোল! পানিতে দাপাদাপি, ক্যামেরার ক্লিক। বিছনাকান্দিতে পানি কম, হয়তো মেঘালয়ে বৃষ্টি কম হয়েছে। তবু তাদের সাবধান করা হলো বেশি গভীরে না যেতে। প্রতিবছর এখানে চোরা পাথরে মানুষ হারিয়ে যায়, পরে তাদের লাশ পাওয়া যায়। যাই হোক, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলাম। তাগাদা দিয়ে সবাইকে নিয়ে ফেরার সময় অধিকাংশের আবদারে সীমান্ত হাটে ঢুঁ মারলাম। গরুর দুধের চা খেলাম, কাঁচা সুপারি দিয়ে খাসিয়া পান চিবোলাম।

Advertisement

ফিরতি পথে ভাটিতে হওয়ায় নৌকার গতি এমনিতেই বাড়ল। বিকাল নাগাদ রাতারগুল পৌঁছে গিয়াস ভাইয়ের বাড়িতে ভুড়িভোজ। হাঁসের রোস্ট, হাঁসের ডিম ভুনা, হাঁসের গোস্তের ঝোল আর গিলা কলিজা দিয়ে আলুর সঙ্গে মাখা, ডাল আর ছোট মাছ দিয়ে টক জাতীয় ওষুধি ফল, নাম ডেফল। খেয়ে অবিলম্বে আবারও ঘাটে গিয়ে কোষা নৌকায় উঠলাম, এবার মাঝি সিরাজ চাচা, ইঞ্জিন নৌকার কারবার শেষ, গন্তব্য রাতারগুল জলাবন। বনে কোষা নৌকাতেই যেতে হয়, ইঞ্জিন নৌকার আওয়াজ, তেল, ভারিক্কি, বনের প্রাণবৈচিত্রের জন্য মারণাস্ত্র। তাতে কী? রাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা এসব মানেন না, রক্ষকের মুখোশে ভক্ষক হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেরাই ইঞ্জিন নৌকায় বেড়াতে আসেন।

বনে ঢুকেই চোখ কপালে! সম্মানিত পর্যটকে ভরপুর, পানিতে তাদের খাবারের অপচনশীল মোড়ক, সমানে সমান। দেখলাম ঘাটও বেড়েছে। পর্যটকদের উচ্চস্বরে গান, চিৎকার আর হাসাহাসিতে প্রকম্পিত জলাবন! বন আগের মতো ঘন নেই। মরে যাচ্ছে গাছগুলো, পাখি কমছে, পতঙ্গ কমছে, সাপ নেই, বানর নেই। দুঃখ করে এসব বলছিলেন অশীতিপর সিরাজ চাচা। আসলেই তাই। তবে মাছ বেড়েছে, কারেন্টজাল দিয়ে মাছ ধরার উৎপাত কমেছে বলে। দেখতে দেখতে ফাঁকা জায়গায় এলাম, সামনে দাঁড়িয়ে সেই ওয়াচটাওয়ার। সেখানে পর্যটকদের ভিড়। ছবি তোলার জন্য দলের ৩ জন উঠলো সেখানে, বুঝিয়েও পারা গেল না। জানা দরকার, জলাবনের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, কোন স্থাপনা বা অবকাঠামো হওয়া যাবে না, তাতে করে জলাবনের ধ্বংস অনিবার্য। এবং সেদিকেই যাচ্ছে রাতারগুলের ভবিষ্যত। আন্দোলন করেও কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। এসব জায়গায় পর্যটন হতে হবে সংরক্ষিত। রাষ্ট্র এসব বুঝেও বুঝতে চায় না। দিশা বলছিল, বনটা বাঁচবে না।

সাঁঝের মায়া জেঁকে ধরলো। কিন্তু মায়ায় জড়ানো যাবে না, ফিরতে হবে। মন খারাপ করেই বন থেকে বেরুলাম, পথে এ ডালে ও ডালে বসে থাকা আমাদের প্রতি শঙ্খচিলের ভর্ৎসনা। হায়রে মানুষ! হায়রে পর্যটক! শিয়ালীছড়া খাল দিয়ে যাওয়ার সময় সবাই আবারও রোমান্টিক। দিনমণি ডুব দেওয়ার আগেও আকাশজুড়ে হরেক রঙের খেলা দেখাচ্ছে, কাছেই ঘাসের ওপর ফিঙে দম্পতির খুনসুটি, মাথার ওপরে বাঁদুড়ের ডানা ঝাপটে উড়ে যাওয়া, মাছেদের মাঝে মাঝেই জলের ওপর উঁকি দেওয়া, সবই অপার্থিব মনে হচ্ছিলো। ঘাটে পৌঁছে গিয়াস ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শহরে ফেরার সময় আবারও অধিকাংশের আবদার রক্ষায় জাফলং রোডে সাতরঙা, সাত স্তরের স্বাদবিহীন চা খেলাম। শিহাব ভাই বাস কাউন্টার পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন। বাসে ওঠার আগে হাবীবের এক বড় ভাইয়ের কল্যাণে রাতের খাবার সারলাম। বাসে উঠে শঙ্কিত হয়ে উঠলাম। এরপর যখন আসবো, রাতারগুলের কী হাল দেখব? বিছনাকান্দিরই বা কী হাল দেখব? গোটা সিলেটের পরিবেশই বা কেমন থাকবে তখন?

যেভাবে যেতে হয়ঢাকা-সিলেট রুট খুবই অভিন্ন, বাসভাড়া ননএসি ৪৭০ টাকা, এসি ৯৫০-১২০০। ট্রেনভাড়া ১৬০-১১০০। সিলেট শহর থেকে রিজার্ভ সিএনজি ১৫০০-২০০০, মানুষ বেশি হলে রিজার্ভ লেগুনা ২০০০-২৫০০ টাকা। রিজার্ভই সুবিধাজনক। নামতে হবে রাতারগুল ঘাটে। সেখান থেকে কোষা নৌকায় আধা দিন ৬০০-৭০০ টাকা ভাড়া। মাঝিসহ ৪-৫ জনের বেশি ওঠা যাবে না নৌকায়। সাঁতার না জানলে লাইফ জ্যাকেট পরতে হবে। বোট ভাড়া বেশ চড়া। কম করে হলেও ১ হাজার তো নিবেই। মানুষ বেশি হলে ভালো, খরচ ভাগাভাগি হয়।

সতর্কতাবিছনাকান্দিতে খুবই সাবধান থাকতে হয়, সেখানে অসংখ্য চোরা পাথর, হড়কে গেলে খোঁজ থাকবে না। স্রোত বেশি এমন জায়গায় না যাওয়াই ভালো। রাতারগুল থেকে বিছনাকান্দি যাওয়ার উপায় সাধারণত নেই, আমার গিয়েছিলাম বিশেষ ব্যবস্থায়।

থাকাসিলেট শহরে হোটেল, মোটেল অহরহ। তবে ঘুরতে গেলে মোটামুটি মানের হলেই ভালো। কেননা সারাদিন তো ঘোরাফেরাই হবে। উচ্চমানের হোটেল নিলে টাকা অপচয়। ৮শ’ টাকা থেকে ওপরে আধা লাখেরও রুম আছে। কোনরকম বা মোটামুটি থাকার জন্য জিন্দাবাজার মন্দ না। খাবারের জন্য চিন্তার কিছু নেই।

এসইউ/জেআইএম