খেলাধুলা

প্রথম ইনিংসের ভুলই ভোগাচ্ছে টিম বাংলাদেশকে

‘প্রথম ইনিংসে দারুণ খেলে ১৭৬ রান করা মুমিনুলের ব্যাট কি আবার হাসবে? এবারো বড় ইনিংস উপহার দিয়ে ঘোর বিপদে সাহসী নাবিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন কক্সবাজারের ২৬ বছর বয়সী এ যুবা?

Advertisement

সঙ্গীর অভাবে প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরি করতে না পারা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ কি দলের চরম বিপদে ম্যাচ বাঁচানো আরেকটি ইনিংস খেলতে পারবেন? প্রথম ইনিংসে চরম ব্যর্থ লিটন দাস আর মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত কী এবার প্রয়োজনের সময় জ্বলে উঠতে পারবেন?

এসব কৌতুহলি প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে। এর পাশে আর একটি বড় শঙ্কা এসে ভর করেছে বাংলাদেশ ভক্তদের মনে; রাজ্যের ভয়-ডর এসে বাসা বেধেছে ঘুরে ফিরে সবার মনে একটাই প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে- বাংলাদেশ কি ম্যাচ বাঁচাতে পারবে?

পারবে না- এমনটা বলার উপায় নেই। ক্রিকেটে এর চেয়ে অনেক খারাপ অবস্থায় ম্যাচ ড্র করার রেকর্ড আছে ভুরি ভুরি। তবে চতুর্থ দিন শেষ বিকেলের ঝড়ে দুই মূল ব্যাটিং স্তম্ভ তামিম-মুশফিক এবং আরেক ওপেনার ইমরুল সাজঘরে ফেরায় হঠাৎই বিপাকে মাহমুদউল্লাহর দল।

Advertisement

চট্টগ্রাম টেস্টে জয়ের স্বপ্ন শেষ। এখন টাইগারদের সামনে পথ একটাই- ‘ড্র্’। সেটাও সহজ নয়। কাল রোববার পঞ্চম ও শেষ দিনের পুরো সময় উইকেটে টিকে থাকতে পারলেই কেবল হার এড়ানো যাবে।

প্রথম দিন পৌনে চারশো (৩৮৪/৪) রান করা দল চতুর্থ দিন শেষে পরাজয়ের শঙ্কায়- ভাবা যায়! হিসেব মেলানোই কঠিন। তবে বাংলাদেশের কিন্তু এমন রেকর্ড আছে। খুব বেশি দুর পিছন ফিরে তাকাতে হবে না।

গত বছর জানুয়ারিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়েলিংটনে প্রথম ইনিংসে ৫৯৫ রান করেও ৭ উইকেটে হেরেছিল টাইগাররা। সে ম্যাচে দ্বিতীয় ইনিংস শেষ হয়ে গিয়েছিল মোটে ১৬০ রানে।

তবে এবারের প্রেক্ষাপট খানিক ভিন্ন। এখন টাইগারদের তিন সেশনই উইকেটে কাটাতে হবে। খুব খুঁটিয়ে লক্ষ্য করুন, দেখবেন- প্রথম ইনিংসে করা ভুলের খেসারত দেয়ার কারণেই এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের দল।

Advertisement

পরিসংখ্যান জানাচ্ছে বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ব্যাট করেছে ১২৯.৫ ওভার। ওভার পিছু ৩.৯৫ রান তুলে টাইগারদের সংগ্রহ ৫১৩ রান। ব্যাটসম্যানদের স্ট্রাইকরেট খেয়াল করুন, দেখবেন মুশফিকুর রহীম ছাড়া সবাই উইকেটে বেশি সময় টিকে ইনিংসকে বড় করার চেয়ে যতটা সম্ভব দ্রুত রান তোলায় মনোযোগী ছিলেন।

তামিম ৯৮.১১ স্ট্রাইকরেটে ৫৩ বলে করেছেন ৫২ রান। ইমরুল ৫৩.৩৩ স্ট্রাইকরেটে ৭৫ বলে ৪০। মুমিনুল ৮২.২৪ স্ট্রাইকরেটে ২১৪ বলে ১৭৫ রান। এমনকি অফ স্পিনার মিরাজও ১০৬.২৬ স্ট্রাইকরেটে ১৯ বলে করেছেন ২০ রান। সেখানে মুশফিকুর রহীম ৪৭.৯১ স্ট্রাইকরেটে ১৯২ বলে ৯২ আর অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ ৬১.৯৪ স্ট্রাইকরেটে ১৩৪ বলে ৮৩ রান করেছেন তুলনামুলক ধীর গতিতে।

আসুন এবার শ্রীলঙ্কার প্রথম ইনিংসের সংক্ষিপ্ত চালচিত্রটা দেখি; লঙ্কানরা ব্যাট করেছেন ১৯৯.৩ ওভার। ৩.৫৭ স্ট্রাইকরেটে তাদের সংগ্রহ ৭১৩ রান। কুশল মেন্ডিস ৩২৭ বলে ১৯৬ রানের বিশাল ইনিংস খেলেছেন ৬০‘এর কম (৫৯.৯৩) স্ট্রাইকরেটে। তিন সেঞ্চুরিয়ানের মধ্যে কেবল ওয়ান ডাউনে ধনঞ্জয়া ডি সিলভা হাত খুলে খেলেছেন। তার ১৭৩ রানের ইনিংসটি গড়ে উঠেছে ২২৯ বলে ৭৫.৫৪ স্ট্রাইকরেটে।

কিন্তু আরেক সেঞ্চুরিয়ান রোশেন সিলভা (৪৭.৩৯ স্ট্রাইক রেটে ২৩০ বলে ১০৯) আর অধিনায়ক দিনেশ চান্ডিমাল (৪৭.০২ স্ট্রাইকরেটে ১৮৫ বলে ৮৭) তুলনামূলক বেশি সময় ক্রিজে কাটিয়ে স্লথ গতিতে রান তোলায় লঙ্কান ইনিংস বড় হয়েছে। শুধু রানে নয়। সময়ের মানদণ্ডেও হয়েছে দীর্ঘ।

টেস্ট ক্রিকেট শুধু রানের খেলা নয়। সময়েরও খেলা। পাঁচ দিনে ১৫টি সেশন। যে দল গুণে গুণে বেশি সময় উইকেটে কাটাতে পারে, তাকে হারানো কঠিন। এখানে রান করা যেমন প্রয়োজন, আবার দীর্ঘ সময় ব্যাট করাও দরকারী।

ঠিক সেই কাজটিই করতে বার বার ব্যর্থ বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। টেস্ট ক্রিকেট সীমিত ওভারের খেলা নয়, ধুম-ধাম ব্যাটিং করে আর চার ও ছক্কার ফুলঝুড়ি ছুটিয়ে ম্যাচ জেতা বহুদুরে, ড্র করাও কঠিন।

এ সত্য উপলব্ধিতে বার-বার ভুল হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের। অতীতের কথা না হয় বাদ দেয়া গেল, চট্টগ্রাম টেস্টে প্রথম ইনিংসে একটু হিসেব কষে ব্যাট করলে এখনকার মত খারাপ অবস্থায় পড়তে হতো না টাইগারদের।

লিটন দাসের উইকেটে এসে প্রথম বল ছেড়ে- শূন্য রানে বোল্ড হওয়া আর মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের উইকেট ছেড়ে মারতে যাওয়া অবশ্যই ভুগিয়েছে দলকে। মানা গেল, লিটন দাস উইকেটে এসে প্রথ বল ছেড়ে দিতে গিয়ে বোল্ড হয়েছেন; কিন্তু মোসাদ্দেক কেন, কি কারণে উইকেটে থিতু হবার আগে হেরাথকে স্পিনের বিপক্ষে মিড অনের ওপর দিয়ে তুলে মারতে যাবেন?

দ্বিতীয় দিন সকাল সকাল মিরাজের কি এমন রানের তাড়া ছিল যে অযথা ও অপ্রয়োজনে তিন রান নিতে গেলেন? এ দুটি আউটের চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। না হয় ইনিংসের দৈর্ঘ্য আরও বড় হতে পারতো। এই তিনজন মিলে বেশি না, একটি সেশন কাটিয়ে দিতে পারলেই খেলার চালচিত্র থাকতো অন্যরকম।

মুমিনুল তার মত খেলেছেন। ১৭৬ রানের ইনিংসকে সময় দিয়ে বিচার করার কোনই অবকাশ নেই। ওটা শুধু মুমিনুলের নয়, বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংস গুলোর অন্যতম। কাজেই সেটা কত দ্রুত সময়ে হয়েছ, তা নিয়ে কথা বলা অযৌক্তিক।

তামিম আজকাল অনেক দায়িত্ব সচেতন। ওয়ানডেতেও ঝড়ো ও আক্রমণাত্মক মেজাজ বাদ দিয়ে দায়িত্ব সচেতনতার পরিচয় দিয়ে ধরাবাহিকভাবে ভাল খেলছেন। রানও পাচ্ছেন। টেস্টেও সেভাবে খেললে ভাল করতেন। তবুও শুরুতে তার সাহসী ইনিংসটা বাকিদের উজ্জীবিত করেছে। সাহসের বড়ি হিসেবে কাজে দিয়েছে।

কাজেই প্রথম ইনিংসে মুমিনুল আর তামিমের দ্রুত রান তোলার পক্ষেই যুক্তি বেশি। মুশফিক আর মাহমুদউল্লাহ যথার্থই খেলেছেন। তাদের কারণেই ইনিংসটির দৈর্ঘ্য বেড়েছে। না হয় ১০০ থেকে ১১০ ওভারের মধ্যে শেষ হয়ে যেতো। তাহলে কিন্তু এতক্ষণে নিশ্চিত পরাজয়ের দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়াতে হতো।

প্রথম ইনিংসে ১৩০ ওভারের একবল কম ব্যাট করা বাংলাদেশ আর এক সেশন বেশি ব্যাট করতে পারলেই ইনিংসের দৈর্ঘ্য গিয়ে দাঁড়াতো ১৫০ প্লাস ওভারে। অনিবার্য্যভাবে তখন রানটাও ৬০০‘তে গিয়ে ঠেকতো। তখন লঙ্কানরা এত ‘গজেন্দ্র গমনে’ ধীরে সুস্থে ইনিংসটাকে এত লম্বা করে ২০০ রানে লিড নিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুড়তে পারতো না।

আরও দ্রুত খেলার তাগিদ থাকতো তাদের। তাহলে অবশ্যই বাংলাদেশের বোলারদের সাফল্যের সম্ভাবনাও বেশি থাকতো। এই যে সময়ের কথা চিন্তা না করে এবং সেশন অনুযায়ী ব্যাট করতে না পারা- সেটাই বিপদের কারণ।

আগামীকাল শেষ দিন কি উইকেটে দাঁতে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকা সম্ভব হবে টাইগারদের? সেটাই দেখার।

এআরবি/আইএইচএস/এআরএস