রুবিনা আখতার আর তার ভাই রুবেল যেন গোবরে পদ্মফুলের উজ্জ্বল উদাহারণ। তারা আমাদের শান্তিনগর এলাকার গর্ব। এরা দু’জনই অত্যন্ত মেধাবী। এটা সৃষ্টিকর্তার দান। তারা কখনও প্রাইভেট পড়েনি। ক্লাসে কখনও ২য় হয়নি। রুবিনা আখতারের স্কুল জীবনে বরাবরই সব শ্রেণিতে এক রোল ছিল। এসএসসি এবং এইচএসসিতেও জিপি-এ ৫ পেয়েছিল। রুবিনারা আমাদের এলাকার প্রদীপ।
Advertisement
কথাগুলো বলছিলেন, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার দন্ডপাল ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের নির্বাচিত ইউপি সদস্য মো. সুরুজ্জামাল। তিনি রুবিনা আখতারের নিকটতম প্রতিবেশী।
গত রোববার বেলা দেড়টায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিভাগের শেষ বর্ষের মেধাবী শিক্ষার্থী রুবিনা আখতার ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে রেলের ইঞ্জিনে কাটা পড়ে দুই পা হারান। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি পঞ্চগড়ে বাড়ি ফেরার জন্য ট্রেনে উঠার অপেক্ষায় ছিলেন।
সোমবার সকালে সরেজমিন পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার দন্ডপাল ইউনিয়নের রুবিনা আখতারের গ্রাম শান্তিনগর ঘুরে জানা গেছে, অতিদরিদ্র এ মেধাবী শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক রেল দুর্ঘটনায় দুই পা হারানোর খবরে হতবাক তার নিজ গ্রাম শান্তিনগরের মানুষ।
Advertisement
রোববার দুপুরের পর অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনা শুনে রাতে তারা ঘুমোতে পারেননি। রাতভর তাদের অনেকেই রুবিনার বাড়িতেই ছিলেন। অসহায় মা আর প্রতিবন্ধী বড় বোনের দিকে তাকিয়ে তাদেরও চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েছিল।
রুবিনা আখতারের প্রতিবেশী ও স্বজনরা জানায়, ছোটবেলা থেকেই সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত আশ্চর্য রকমের মেধাবী ছিলেন রুবিনা আখতার। তার বাবা রবিউল ইসলাম তিন বছর আগে মারা যান। তিন ভাই-বোনের মধ্যে বড় বোন জুলেখা আখতার মানসিক প্রতিবন্ধী। ছোট ভাই মো. রুবেল বেগম রকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী। স্কুল জীবন থেকেই রুবিনা আখতার উপবৃত্তি আর টিউশনির টাকায় লেখাপড়া করতেন।
স্থানীয় শান্তিনগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং কালিগঞ্জ মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাস করেন। ভালো ফলাফল করায় তিনি নিজ উদ্যোগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেও সময়ের বিবেচনায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েই থেকে গেছেন। সেখানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মাসিক তিন হাজার টাকার শিক্ষাবৃত্তি এবং টিউশনির টাকা দিয়ে লেখাপড়াসহ নিজের থাকা খাওয়া চালাতেন। টিউশনির টাকা বাঁচিয়ে মাঝে মধ্যে ছোট ভাইকেও পাঠাতে হতো।
রুবিনা আখতার সন্মান শেষ বর্ষে উঠার পর থেকেই বিসিএস এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। স্বপ্ন দেখেছিলেন, বড় কর্মকর্তা হয়ে বাড়ির আর্থিক দৈন্যতা দূর করবেন।
Advertisement
ছোট ভাইকে উচ্চ শিক্ষিত করে গড়ে তুলবেন। প্রতিবন্ধী বোন আর মায়ের মুখে হাসি ফুটাবেন। কিন্তু কমলাপুর স্টেশনে রেলের ইঞ্জিনে দুই পায়ের সঙ্গে কাটা পরে রুবিনার স্বপ্ন। এরই সঙ্গে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠে একটি অতিদরিদ্র পরিবারের ভবিষ্যৎ। এখন কি হবে পরিবারটির? তার মানুষ হওয়ার স্বপ্ন কি স্বপ্নই থেকে যাবে? দুই পা হারিয়ে রুবিনা আখতার বর্তমানে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
রুবিনা আখতারের মা রহিমা খাতুন বলেন, আমার মেয়ে শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিল। এজন্য বাড়ি ফিরছিল। সেই আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। অসুস্থবস্থায় সে লেখাপড়া করছিল। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারি নাই। তার লেখাপড়ার জন্য কখনও একটি টাকাও পাঠাতে পারি নাই। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাবৃত্তির টাকা আর টিউশনি করে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাতো। সম্প্রতি সেই শিক্ষাবৃত্তিও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুঃশ্চিন্তায় ছিল রুবিনা।
কান্না জড়িত কণ্ঠে রহিমা খাতুন বলেন, আমার মা হাসপাতাল থেকে ফোন করে বলেছে, আমি ভালো আছি মা। চিন্তা করিও না’। এখন আমাদের কি হবে, কি হবে তার লেখাপড়ার, স্বপ্নের। কথাগুলো বলতেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন রহিমা খাতুন।
রুবিনা আখতারের প্রতিবেশী চাচা মোশারফ হোসেন বলেন, আমাদের এলাকার মধ্যে এই দুই ভাই-বোন মেধাবী ছিল। তারা খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করে। আমরাও তাদের কোনো সাহায্য করতে পারিনি। তার দুর্ঘটনার খবরে আমারা রাতে ঘুমাতে পারিনি। এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
কালিগঞ্জ মহাবিদ্যালয়ের এইচএসসি ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, কলেজের স্যারদের মুখে রুবিনা আপুর অনেক সুনাম শুনেছি। তিনি বেশ মেধাবী ছিলেন। তিনিই একমাত্র আমাদের কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। আমরা তার এ দুর্ঘটনায় মর্মাহত।
সফিকুল আলম/এমএএস/এমএস