এফডিসি আজ সুনসান, নিরব। শূন্যতার বিষাদ যেন ছায়া ফেলেছে সবখানে। এখানে এফডিসির প্রাণ পুরুষ জহির রায়হানের অন্তর্ধান দিবসে শোকের স্পর্শ পাওয়া যায়। তবে এফডিসির মানুষদের মধ্যে আজ আনন্দ, শিল্পী সমিতির বনভোজন উপলক্ষে।
Advertisement
বছরজুড়েই এফডিসির যে কোনো সম্মেলন, অসংখ্য সিনেমার মহরত, চলচ্চিত্রের যে কোনো সংগঠনের অনুষ্ঠান, মহড়া চলে যে ফ্লোরটিতে তার নাম জহির রায়হান কালার ল্যাব! নিত্যক্ষণ নামটির সঙ্গে জড়িয়ে থেকেও তার মৃত্যুবার্ষিকীতে উদাসীন চলচ্চিত্রের মানুষজন। এর কোনো কারণ খুঁজে না পেলেও এটাই সত্যি, এটাই বাস্তবতা হয়ে ধরা দিলো আজ।
ঢাকাই চলচ্চিত্রের এই প্রবাদপুরুষের নিখোঁজ হবার দিনকে ঘিরে কোনো আয়োজন ছিলো না এফডিসি কর্তৃপক্ষের। কোনো আয়োজনের খোঁজ মেলেনি কোনো সংগঠনে। আয়োজন নেই পরিচালক সমিতিতেও, নিশ্চিত করেছেন পরিচালক সমিতির মহাসচিব বদিউল আলম খোকন।
আজ জহির রায়হানের অন্তর্ধান দিবস। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী জহির রায়হান একাধারে ছিলেন একজন সফল সাংবাদিক, লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। ১৯৭২ সালের আজকের এইদিনে তিনি অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সারকে মিরপুরে খুঁজতে গিয়ে নিজেও নিখোঁজ হন।
Advertisement
জহির রায়হানের প্রকৃত নাম মোহাম্মদ জহিরউল্লাহ। ১৯৩৪ সালের ১৯ আগস্ট নোয়াখালিতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ছোটবেলায়ই জহির রায়হান রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। বড়ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার ও বড়বোন নাফিসা কবিরের মাধ্যমে বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করে ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হন। এ সময় ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বের সূচনা হলে তিনি তাতে যুক্ত হন।
২১ ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক যে ১০ জন প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে গ্রেফতার হন, জহির রায়হান ছিলেন তাদের অন্যতম। সেটিই তার জীবনের প্রথম কারাবরণ।
১৯৫৬ সালের শেষদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের বিখ্যাত চিত্রপরিচালক এ. জে. কারদার (আখতার জং কারদার) তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পটভূমিকায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের উর্দু সংস্করণ জাগো হুয়া সাভেরা তৈরির উদ্যোগ নিলে জহির রায়হান তার সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দেন।
১৯৬১ সালে মুক্তি পায় তার নিজের পরিচালনায় নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনো আসেনি’। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি কলকাতায় অবস্থান করে নির্মাণ করেন বিখ্যাত প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’, ‘বার্থ অব নেশন’, ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ এবং ‘ইনোসেন্ট জিনিয়াস’। ‘জীবন থেকে নেয়া’ তার অন্যতম একটি কালজয়ী সিনেমা।
Advertisement
১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি ঘোষণা করেন বুদ্ধিজীবী হত্যার পেছনের নীল নকশা উদঘাটনসহ মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনেক ঘটনার নথিপত্র ও প্রামাণ্যদলিল তার কাছে আছে, যা প্রকাশ করলে মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যের কুকীর্তি ফাঁস হয়ে পড়বে।
এর পাঁচদিন পর ৩০ জানুয়ারি এক অজ্ঞাত টেলিফোন আসে জহির রায়হানের কায়েতটুলির বাসায়। ‘শহীদুল্লাহ কায়সার মিরপুরে এক বাড়িতে আটক অবস্থায় আছেন’- এই খবর পেয়ে জাকারিয়া হাবিব, চাচাতো ভাই শাহরিয়ার কবিরসহ কয়েকজনের সঙ্গে তখনও অবরুদ্ধ মিরপুরে যান তিনি। ২ নং সেকশনে অবস্থিত মিরপুর থানায় পৌঁছনোর পর ভারতীয় ও বাংলাদেশ সেনা অফিসাররা গাড়িসহ জহির রায়হানকে একা রেখে সঙ্গী-সাথীদের চলে যেতে বলেন।
সেই থেকেই জহির রায়হান নিখোঁজ, আর কোনো খোঁজ মেলেনি। একই সঙ্গে হারিয়ে যায় জহির রায়হানের ডায়েরি, নোটবুক, মূল্যবান ফিল্মসহ দলিলপত্র। জহির রায়হানের খোঁজ খবর বেশি না করার জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে পরিবারবর্গকে হুমকি দেয়া হয়।
এলএ/পিআর