ইসলামের প্রথম মুজাদ্দিদ হলেন হজরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ রহমাতুল্লাহি আলাইহি। রাজ পরিবারে তাঁর জন্ম। প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে তিনি দেখতে পান যে, তাঁর পিতা মিসরের ন্যায় বিশাল সম্রাজ্যের গর্ভনর। আরো বয়ঃপ্রাপ্ত হলে তিনি নিজেই উমাইয়া সরকারের অধীনে গবর্ণর নিযুক্ত হন।
Advertisement
বনু উমাইয়া বাদশাহগণ যে সব জায়গীরের সাহায্যে নিজেদের খান্দানকে বিপুল অর্থ বৈভবের মালিক করেন, তাঁর এবং তাঁর পরিবার-পরিজনেরও বিরাট অংশ ছিল। এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদের বার্ষিক আয় ছিল ৫০ হাজার আশরাফি।
তিনি বিত্তশালীদের ন্যায় শান-শওকত পূর্ণ জীবন-যাপন করতেন। পোশাক-পরিচ্ছেদ, খানা-পিনা, বাড়ি-ঘর, যান-বাহন, স্বভাব-চরিত্র সবই ছিল শাহজাদার ন্যায়।
এ পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীকালে তিনি যে কাজ সম্পাদন করেন তার সঙ্গে তার পরিবেশের কোনো দূরতম সম্পর্কও নেই।
Advertisement
কিন্তু তাঁর মাতা ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু’র পৌত্রী। তিনি প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের ৫০ বছর পর ৬১ হিজরিতে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর রাজত্বের সময়কালে অসংখ্য সাহাবা ও তাবেঈ জীবিত ছিল।
ইলমে হাদিস ও ফিকরে ওপর তাঁর গভীর পাণ্ডিত্য ছিল। যে কারণে রাষ্ট্র পরিচালনায় যে কোনো সংযোজন বিয়োজনে ক্ষতি ও উপকারের দিকগুলো তার ভালোই জানা ছিল। তবে তার রাষ্ট্র ক্ষমতায় প্রতিপত্তি ও প্রভাব বিস্তার করার মতো লোক তাঁর বংশ ও পরিবারে বিদ্যমান ছিল।
কারণ এ প্রভাব বিস্তার করতে পারলে তাঁর ও তাঁর পরিবার এবং বংশের ব্যক্তি স্বার্থ ও লালসা আর ভবিষ্যৎ বংশধরদের দুনিয়ার যাবতীয় কল্যাণে উপকার লাভ হত। যেমনটি করেছিল অত্যাচারী শাসক ফেরাউন। ৩৭ বছর বয়সী ওমর ইবনে আব্দুল আজিজেরও এমনটি হওয়া ছিল স্বাভাবিক।
কিন্তু তিনি ৩৭ বছর বয়সে ঘটনাক্রমে যখন রাজতখতের অধিকারী হন এবং অনুভব করতে পারেন যে, তাঁর ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির বিশাল দায়িত্ব তাঁর কাঁধে চেপেছে। তখন তার জীবনধারা পাল্টে যায়। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করেই তিনি ইসলামের পথ বেছে নেন। যেন এটি ছিল তাঁর পূর্ব গৃহীত সিদ্ধান্ত।
Advertisement
বংশানুক্রমিকভাবে তিনি রাজ তখতের দায়িত্ব লাভ করেন। কিন্তু বাইয়াত তথা আনুগত্য গ্রহণ করার সময় তিনি জনসমাবেশে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন যে, ‘আমি তোমাদেরকে আমার বাইয়াত থেকে মুক্ত করে দিচ্ছি। তোমরা নিজেদের ইচ্ছা মতো কাউকে খলিফা নির্বাচন করে নিতে পার। অতঃপর জনগণ সর্বসম্মতভাবে এবং সাগ্রহে বলল যে, ‘আমরা আপনাকেই নির্বাচন করছি; তখনই তিনি স্বহস্তে খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
ক্ষমতার মসনদে আরোহ করেই তিনি রাষ্ট্রীয় সংস্কার কাজে হাত দেন। প্রথমেই তিনি জাকজমকপূর্ণ রাজকীয় ফেরাউন, কিসরা ও কাইসার সরকারদের রাষ্ট্রীয় নিয়ম-রীতি বন্ধ করে দেন। প্রথম দিনেই তিনি রাজযোগ্য সবকিছুই পরিত্যাগ করে মুসলমানদের মধ্যে তাদের খলিফা পরিচালিত শাসন পদ্ধতি চালু করেন।
রাষ্ট্র ক্ষমতায় আরোহন করে তিনি যে সব কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করেন। তাহলো রাজ পরিবারের সংশোধন>> রাজবংশের লোকিদের দিকে দৃষ্টি দেন। তাদেরকে সব দিক থেকে সাধারন মুসলমানদের পর্যায়ে নিয়ে আসেন।>> তাঁর নিজের জায়গীরসহ অন্যদের যে সব জায়গীর রাজবংশের দখলে ছিল; তার সবগুলো রাষ্ট্রীয় কোষাগার বায়তুল মালে জমা দেন।এ পরিবর্তনের ফলে যা ঘটে তাঁর মূল্যয়ন হলো- ‘তাঁর বার্ষিক আয় ৫০ হাজার আশরাফি থেকে নেমে তা ২ হাজার আশরাফিতে পৌছে।’>> বায়তুল মালের অর্থ তিনি তাঁর নিজের ও নিজ খান্দানের জন্য হারাম করে দেন। এমনকি খলিফা হিসেবে তিনি রাজ ভাণ্ডার থেকে বেতনও গ্রহণ করেননি।রাজত্ব লাভ করার পর তিনি তার নিজের জীবনাচারই পরিবর্তন করে ফেলেন। যেখানে রাষ্ট্র প্রধান হওয়ার আগে তিনি শান-শওকতপূর্ণ জীবন-যান করতেন; সেখানে খলিফা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি গরিবি হালতে চলে যান।খলিফা হওয়ার আগে যেখানে তিনি হাজার দিরহাম মূল্যের পোশাকও তাঁর পছন্দ হতো না সেখানে খলিফা হওয়ার পর তিনি ৪/৫ দিরহাম মূল্যের পোশাককেও তিনি নিজের জন্য অনেক দামি মনে করতেন।
রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংশোধননিজ গৃহ ও পরিজনের সংশোধনের পর তিনি রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে নজর দেন। তৈরি করেন দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা।>> অত্যাচারী গভর্ণরদেরকে বরখাস্ত করেন।>> গভর্ণরের দায়িত্ব পালনের জন্য সৎলোকদেরকে অনুসন্ধান করে বের করে আনেন।>> যে সব প্রশাসনিক কর্মচারীবৃন্দ নিয়মবহির্ভূতভাবে প্রজা সাধারণের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুর ওপর অনধিকার হস্তক্ষেপ করেছিল; তাদেরকে তিনি আইনের আওতায় নিয়ে আসেন এবং আইনের শাসন বাস্তবায়ন করেন।>> রাষ্ট্রীয় কোষাগার বাইতুল মালে কর নির্ধারণ ও জমার সব নিয়ম-নীতি পরিবর্তন করেন।>>আবগারী করসহ বনি উমাইয়া প্রশাসকগণ যে সব অবৈধ ও অন্যায় কর নির্ধারণ করেছিলেন; তিনি তা ক্ষমতারোহনের সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করে দেন।>> জাকাত আদায়ের যে ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, তা নতুনভাবে সংশোধণ করেছিলেন।>> বায়তুল মালের অর্থকে সাধারণ মুসলমানের কল্যাণের জন্য ওয়াক্ফ করে দেন।>> রাষ্ট্রের অমুসলিম প্রজাদের সঙ্গে সঙ্গে যে সব অন্যায় আচরণ করা হয়েছিল, তার প্রতিকার করেন।>> অমুসলিমদের যে উপাসনালয় অন্যায়ভাবে দখল করা হয়েছিল, সেগুলো তাদেরকে ফিরিয়ে দেন।>> অমুসলিমদের যে সব জমি ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল, তাও তিনি তাদেরকে ফেরত দেন।>> ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে তাদের প্রাপ্য যাবতীয় সুবিধা প্রদান করেন।>> রাষ্ট্রের বিচার বিভাগকে সরকারের শাসন বিভাগের অধীনতা থেকে মুক্ত করেন।>> ইসলামি নীতির ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে সরকারি হস্তক্ষেপকে প্রভাবমুক্ত করেন।আর এভাবেই হজরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ রাষ্ট্র ব্যবস্থা সুন্দর, সুসজ্জিত ও সসংহত করতে ইসলামি রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও পুনরুজ্জীবিত করেন।
তাঁর অল্প দিনের শাসন ব্যবস্থা অর্ধ শতাব্দীর জাহেলি রীতি-নীতি অপসারিত হয়। বন্ধ হয়ে যায় বিকৃত আকিদা-বিশ্বাসের প্রচার ও প্রসার। ব্যাপকভাবে জনগণের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। কুরআন হাদিস ও ইলমে ফিকহার শিক্ষা ব্যবস্থা বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে আকৃষ্ট করে।
যার ফলে হজরত ইমাম আবু হানিফা, মালিক, শাফেয়ী ও আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মতো জগৎ বিখ্যাত বিদ্যান ব্যক্তিদের আবির্ভাব হয়।
হজরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের ক্ষমতাকালে অবস্থা এতটাই উন্নত হয় যে, ৪ জন লোক একত্রিত হলেই সেখানে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ও কুরআন-সুন্নাহ সম্পর্কিত আলোচনা শুরু হয়ে যেত।
হজরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের সময়ে পাশ্ববর্তী অনেক রাষ্ট্র ইসলাম গ্রহণ করে। ইসলামের প্রভাবে মুসলমান হয় অসংখ্য মানুষ। যার প্রভাব পড়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। দীর্ঘ দিন ধরে সংঘাত লেগে থাকা রোম সম্রাজ্যের ওপর বিরাট নৈতিক প্রভাব পড়েছিল।
হজরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের মৃত্যুর পর রোমান সম্রাটের মন্তব্য থেকেই তা অনুমিত হয়। রোমান সম্রাট বলেছিল-‘কোনো সংসার বৈরাগী যদি সংসার ত্যাগ করে নিজের দরজা বন্ধ করে নেয় এবং ইবাদতে মশগুল হয়; তাহলে আমি তাতে মোটেই অবাক হই না। কিন্তু আমি অবাক হই সে লোকের ব্যাপারে, যার পদতলে ছিল দুনিয়ার বিপুল ধন-সম্পদ; আর সে তা হেলায় ঠেলে ফেলে দিয়ে ফকিরের ন্যায় জীবন-যাপন করে।’
আড়াই বছরের সংক্ষিপ্ত রাষ্ট্র ক্ষমতা তাঁর সম্রাজ্যে বিশাল পরিবর্তন সাধিত হয়। উমাইয়া ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বিপ্লবী বিজয়ী বীর হজরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজকে বিষ পান করিয়ে ১০১ হিজরিতে হত্যা করা হয়। ৩৯ বছর বয়সে মুসলিম মিল্লাতের এ নিঃস্বার্থ খাদেম হজরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ দুনিয়া থেকে বিদায় নেন।
আল্লাহ তাআলা তাঁকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন। বিশ্বের প্রতিটি দেশকেই তাঁর আদর্শ ও অনুপ্রেরণ গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/আরআইপি