মতামত

ধারা ৩২ : ঝুঁকির মুখে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা!

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইছে। গণমাধ্যমকর্মীরা মূলত এই আইনের ৩২ নম্বর ধারাটি নিয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন ফেসবুক স্টেইটাসে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, "সরকারি আধা সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে বেআইনিভাবে প্রবেশ করে তথ্য উপাত্ত ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ।" অপরাধ প্রমাণিত হলে ১৪ বছরের জেল দণ্ড ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

Advertisement

তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া অনুমোদনের পাশাপাশি বাতিল করা হয়েছে বিতর্কিত আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারাটি। কিন্তু ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করে ৩২ ধারার সংযোজন যেন নতুন বোতলে পুরনো মদের প্রবাদের মতো।

সত্য উদঘাটনে কখনো কখনো সাংবাদিকদেরও মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। তবে এই প্রক্রিয়াটি হলো সর্বশেষ ধাপ। যখন তথ্য সংগ্রহের সকল পথ বন্ধ হয়ে যায় তখন আন্ডার কভার রিপোর্টার তথ্য সংগ্রহে নামে। বছর দশেক আগে চ্যানেল ফোর বাংলাদেশের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কিশোর শ্রমিকদের কাজ করানো নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রচার করেছিলো। প্রতিবেদক নারায়ণগঞ্জের একটি গার্মেন্টসে ক্রেতা সেজে ঢুকে গোপন ক্যামেরায় কিশোর শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানোর প্রমাণ খুঁজে পায়।

আরেকটি উদাহরণ দেই। চ্যানেল ফোরের আরেক আন্ডার কভার রিপোর্টার ব্রিকলেইনের বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টের খাবারের মান ও পরিচ্ছন্নতার উদাহরণ দিতে গিয়ে একটি রিপোর্ট প্রচার করেছিলো। সেই রিপোর্টে দেখানো হয়েছিলো রেস্টুরন্টের ওয়েটার কাস্টমারদের ব্যবহারে রাখা বেসিনে পা তুলে পা ধুয়েছেন। যে বেসিনগুলো সাধারণত হাত বা মুখ ধোয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে চ্যানেল ফোরের সেই রিপোর্টার ব্রিকলেইনের সেই রেস্টুরেন্টটিতে ওয়েটার হিসেবে খণ্ডকালীন কাজ নিয়েছিলেন।

Advertisement

২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এক সন্দেহভাজন বোমা হামলাকারীকে ধরতে এফবিআই এজেন্ট এসোসিয়েট প্রেসের সাংবাদিক সেজে একটি সংবাদ প্রচার করে। এফবিআইএর পরিকল্পনা ছিলো এপির করা ওই সংবাদে যদি সংশ্লিষ্ট সন্দেহভাজন বোমা হামলাকারী ক্লিক করে তবে এফবিআই সেই বোমা হামলাকারীর কম্পিউটারে প্রবেশ করতে পারবে। এফবিআইএর ফাঁদে পা দিয়ে ফেইক নিউজের লিংকটিতে ক্লিক করে বোমা হামলাকারী। এভাবেই এফবিআই এজেন্ট এপির সাংবাদিক সেজে যুক্তরাষ্ট্রের এক সন্দেহভাজন বোমা হামলাকারীকে আটক করে। এপির প্রধান নির্বাহী গ্যারি প্রুয়িট এক খোলা চিঠিতে বলেন, সন্দেহভাজন বোমা হামলাকারীকে সনাক্ত করতে গিয়ে এফবিআই এপির সাংবাদিক পরিচয় ব্যবহার করায় বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকতা পেশা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।

এফবিআই-এর পরিচালক জেইমস কমলি তাদের এই পদক্ষেপকে নৈতিক ও আইনসিদ্ধ দাবি করে বলেন, সেই সময়ে জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের গাইডলাইন অনুযায়ী এই পদ্ধতিটি বিধিসম্মত ছিলো। তবে বর্তমানে এধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার আগে এখন সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হতে পারে। এই প্রক্রিয়াটি আইনসম্মত ও যথাযথ। শুধু গণমাধ্যমকর্মী নয়, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকেও এধরনের গোপনীয়তা রক্ষা করে জাতীয় গুরুত্বর্পূণ ইস্যুর সমাধান করতে হয়।

ব্রিটেনের প্রেস কমপ্লেইন কমিশনের দশ নম্বর ধারার ১- এ বলা আছে কোন প্রতিষ্ঠানের তথ্য, ছবি বা দলিল গোপন ক্যামেরায় ধারণ করে, কোন ধরনের শ্রবণযন্ত্র বা মোবাইল ডিভাইসে, মেসেজে বা ইমেইলে কোন ধরনের ছবি বা ডক্যুমেন্টস পূর্বানুমতি ছাড়া ধারণ বা প্রকাশ করা যাবে না। তবে উপধারা ২ তে বলা আছে, এধরনের তথ্য ধারণ বা প্রচার করা ন্যায়সঙ্গত হবে যদি সেই তথ্যের ব্যাপারে পাবলিক ইন্টারেস্ট থাকে। তাহলে আমরা দেখছি ইংল্যান্ডেও গণমাধ্যমকর্মীদের গোপনে তথ্য ধারণ করাকে গুপ্তচরবৃত্তি হিসেবে দেখছে না। কিন্তু বাংলাদেশে নতুন প্রস্তাবিত ডিজিটাল আইনে এই ধরনের কাজকে গুপ্তচরবৃত্তি হিসেবে দেখা হবে।

সদ্য প্রয়াত ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক যখন দীর্ঘ চার মাস লন্ডনে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তখন তার শারীরিক অবস্থা জানতে মানুষ কৌতূহলী ছিল। কিন্তু যেহেতু মেয়রের পরিবার কিংবা সরকারি প্রেস নোট থেকে মেয়রের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জনগণকে সন্তুষ্ট করা যাচ্ছিলো না তখনই নানা ধরনের গুজবের ডালপালা গজাতে শুরু করেছিলো। একাত্তর টেলিভিশনের বার্তা প্রধান শাকিল আহমেদ যখন আমাকে বললেন তিনি মেয়র আনিসুল হকের চিকিৎসার সর্বশেষ আপডেট চান।

Advertisement

প্রকৃত সত্য উদঘাটনে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সেই সময়ে জরুরি হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু যেহেতু মেয়রের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকেও শেষ মুহূর্তে তেমন কোন খবর পাওয়া যাচ্ছিলো না তখন নিরুপায় হয়ে আমার আন্ডারকভার সাংবাদিকতার আশ্রয় নেওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিলো না। মেয়রের পরিবার ব্যক্তিগত প্রাইভেসির দোহাই দিয়ে জাতিকে মেয়র আনিসুল হকের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে তেমন তথ্য সরবরাহ করছিলেন না, যতটুকু তথ্য তারা দিচ্ছিলেন সেই তথ্যে সাধারণ মানুষকে সন্তুষ্ট করা যাচ্ছিলো না। যেহেতু চিকিৎসা চলছিলো ব্রিটেনে তাই মেয়রের প্রাইভেসি ভঙ্গ করে তার চিকিৎসার তথ্য সংগ্রহ করা ছিলো অত্যন্ত দুরূহ কাজ। পরিস্হিতির কারণেই মেয়রের প্রাইভেসি ভেঙ্গে আমি মেয়র যে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন সেই তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম।

মেয়রের পরিবার, বাংলাদেশ হাইকমিশন কিংবা যারা মেয়র আনিসুল হককে হাসপাতালে দেখেছেন তাদের কেউ সাংবাদিকদের বলছিলেন না মেয়র আনিসুল হক কোথায় চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। শুধুমাত্র একটি ছবির উপর ভিত্তি করে অনুসন্ধান শুরু করেছিলাম। যে ছবিটি মেয়র যে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন সেই হাসপাতালের সামনে তোলা হয়েছিলো। সেই ছবিতে হাসপাতালের নাম লেখা ছিলো না কিন্তু বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে ছবিটির লোকেশন সনাক্ত করে সেই লোকেশনের সূত্র ধরে আমাকে আগাতে হয়েছিলো।

সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে আমি প্রাইভেট হাসপাতালের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেিছলাম। মেয়র আনিসুল হক যে কেবিনে ভর্তি ছিলেন সেই কেবিনে চলে গিয়েছিলাম। যে নার্স মেয়র আনিসুল হকের তত্ত্বাবধানে ছিলেন, সেই নার্সের কাছ থেকে মেয়র আনিসুল হকের তথ্য জানতে আমাকে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়েছিলো। মেয়র আনিসুল হককে সেই ন্যাশনাল নিউরোলজি হাসপাতাল থেকে যে ওয়েলিংটন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিলো সেই তথ্যও জানা গেলো।

মেয়র আনিসুল হক যে সত্যি অসুস্থ্য ছিলেন এবং ওয়েলিংটন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন এটি আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম আমার পরিচয় গোপন করেই। কিন্তু যখনই আমি হাসপাতাল থেকে বের হয়ে হাসপাতালের সামনে ক্যামেরা বের করে রেকর্ড করছি ততক্ষণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সিসি ক্যামেরায় আমাকে দেখে নিরাপত্তা রক্ষী নিয়ে হাজির। আমার ফুটেজ তাদেরকে হস্তান্তর করতে হবে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলো, হাসপাতালে প্রবেশের সময় আমি মিথ্যা পরিচয় দিয়েছিলাম এবং প্রবেশ পথে রেজিষ্ট্রেশন ছাড়াই হাসপাতালে প্রবেশ করেছিলাম। ব্রিটেনের নিয়ম অনুযায়ী কোন রোগীর ব্যক্তিগত তথ্য দেওয়া যায় না। আমি সেই নিয়ম ভঙ্গ করে মেয়র আনিসুল হকের ব্যক্তিগত তথ্য জেনে মেয়রের প্রাইভেসি ভঙ্গ করেছি। তৃতীয়ত আমি হাসপাতালের নার্সের ভিডিও ধারণ করেছি। এই সমস্ত অভিযোগের কারণে আমাকে পুলিশে সোপর্দ করা হবে।

আমি নিরাপত্তা রক্ষীর দায়িত্বে থাকা মহিলার বক্তব্য ঠাণ্ডা মাথায় শুনে তাকে বললাম, তাদের সিকিউরিটি আমার পরিচয় জানতে ব্যর্থ হয়েছে, আমি রেজিষ্ট্রেশন না করে হাসপাতালে প্রবেশ করেছি ঠিকই এবং আমার কাজ শেষ করে এখন আমি হাসপাতালের বাইরে অবস্থান করছি। তার যদি কোন বক্তব্য থাকে তিনি পুলিশে রিপোর্ট করতে পারেন, কিন্তু একজন সাংবাদিক হিসেবে পাবলিক ইন্টারেস্টের জন্য আমি দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র।

হাসপাতালের বাইরে থাকা অবস্থায় তিনি আমাকে পুলিশ দিয়ে এরেস্ট করাতে পারবে না। হাসপাতালের বাইরে থেকে ভিডিও নেওয়ার অধিকার আমার রয়েছে। তিনি ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে বুঝে গেলেন, আন্ডার কভার রিপোর্টারের খপ্পরে পড়েছেন। কিছুক্ষণ যুক্তি তর্ক করে শুধু বললেন, ''তুমি তোমার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে যাও আর আমার নার্সের ভিডিওটা ডিলিট করে দিও।'' আমি নিশ্চিত সেই দিনের ঘটনার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি, রিসেপশন ও সংশ্লিষ্ট নার্সের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে ব্যবস্থা নিয়েছে। কেননা এই ব্যক্তিদেরই ধোঁকা দিয়ে আমার তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছিলো।

হাসপাতাল থেকে বের হওয়া মাত্রই মেয়র আনিসুল হকের স্ত্রী রুবানা হকের ফোন। তিনি আমাকে নিষেধ করেছিলেন যেন সেই সংবাদ প্রচার না করি। কিন্তু তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে, তার পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেই লন্ডনের চ্যানেল এস টেলিভিশন ও বাংলাদেশের একাত্তর টেলিভিশন সংবাদ ব্রেক করেছিলো আনিসুল হক সত্যিই অসুস্থ্ এবং তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। কিন্তু প্রাইভেসির খাতিরে আমরা তার মৃত্যুর আগে ওয়েলিংটন হাসপাতালের নামটি উল্লেখ করিনি।

এখন তাহলে উপসংহার হলো এই, যদি এমন কোন সংবাদ জানার ব্যাপারে পাবলিক ইন্টারেস্ট তৈরি হয় যেখানে সাংবাদিকের গোপনীয়তার আশ্রয় নিয়ে আন্ডারকভার রিপোটিংএ যেতে হয়, তবে এটি হলো সবশেষ মাধ্যম। যদি অন্য কোন মাধ্যম থেকে তথ্য প্রাপ্তির সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

আশা করি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর ৩২ নম্বর ধারার মতো বিতর্কিত কোন ধারা চূড়ান্ত সংযোজনের আগে ধারাটি নিয়ে নীতি নির্ধারকরা গণমাধ্যমের সাথে আলোচনা করবেন। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে এধরনের ধারা সাধারণ জনগণের মধ্যে ক্ষমতাসীনদের সম্পর্কে আস্থাহীনতা ও সন্দেহ সৃষ্টি করতে পারে।

ডিজিটাল আইনের ৩২ নম্বর ধারাটি সরকারি, আধা সরকারি কিংবা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম বা দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সাংবাদিকের স্বাধীনতাকে যেমন খর্ব করবে তেমনি সাংবাদিকদের নিরাপত্তাকেও ঝুঁকির মুখে ফেলে দেবে। দয়া করে সাংবাদিকদের দিকে তাক করে পয়েন্ট থ্রি টু'র ট্রিগার চাপবেন না। আমরা বিশ্বাস করি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নথি ও দলিলের গোপনীয়তার রক্ষায় আইনগত সুরক্ষা থাকা যেমন জরুরি অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা রক্ষার নামে কেউ যেন এই ধারাটিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে সেই দিকেও সমানভাবে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি।

লেখক : কারেন্ট এফেয়ার্স এডিটর চ্যানেল এস টেলিভিশন, লন্ডন। ইউকে প্রতিনিধি একাত্তর টেলিভিশন।tvjournalistuk@gmail.com

এইচআর/পিআর