ইতালিয়ান ইমিগ্রেশন অফিসের এক রুটিন সভায় বসে আছি। পেছন থেকে কেউ একজন সালাম দিলেন। উচ্চারণ শুনেই বুঝতে পারলাম সালাম দাতা নিশ্চই কোনো একজন ইতালিয় নাগরিক হবেন। আমার আন্দাজ ভুল হলো না। ঘর ফিরিয়ে দেখি সহকর্মী মিকেলা বসকলো ফিওরে।
Advertisement
মিকেলা বসকলো ভেনিসের ইমিগ্রেশন অফিসের সহযোগী পরিচালক। কাজের সুবাদেই তার সাথে আমার পরিচয়। সদা হাসি খুশি সুন্দরী এক ইতালিয় যুবতী। কথা বলে কোনো ভাবেই বোঝার উপায় নেই তিনি ইমিগ্রেশন অফিসের এতবড় একটা দায়িত্বে আছেন। সবার সাথে একেবারে সাদা-মাঠা ভাবে মেশেন, হাসেন, কথা বলেন। এতটুকু বস বস ভাব নেই তার মধ্যে। তিনি মনে করেন, সহকর্মীদের মধ্যে বন্ধুত্ব না থাকলে সঠিক কাজ সহজ ভাবে করা যায় না, হয়তো দায়িত্ব পালন করা যায়।
ঘাড় ফেরানোর আগে বুঝতে পারিনি আমার জন্য আরো কিছু বিস্ময় অপেক্ষা করছে। একগাল অকৃত্রিম হাসি দিয়ে মিকেলা বললেন, ভালো আছ কি? আমি মুহূর্তের জন্যে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। কি উত্তর দিব, কি ভাবে উত্তর দিব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এমন পরিস্থতিতে আমি আগেও পড়েছি। কোনো বিদেশির মুখ থেকে হঠাৎ বাংলা শুনলে আমি এতবেশি আবেগি হয়ে যাই যে মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুতে চায় না। দীর্ঘদিন ইতালিতে থেকে, সারাক্ষণ ইতালিয় কলিগদের সাথে তাদের ভাষায় থক-বক করতে এবং শুনতে কান অভ্যস্ত হয়ে গেছে। হঠাৎ হঠাৎ কারো মুখে দুই একটি বাংলা শব্দ শুনলে আমি ভাষা হারিয়ে ফেলি। কোন ভাষায় কি উত্তর করবো সব গুলিয়ে ফেলি। মিকেলার বেলাও তাই হলো।
জানতে চাই- আপনি বাংলা জানেন? তিনি পকো বাংলা কিছু ইতালিয়ান ঢংয়ে বললেন, হ্যাঁ, আমি বাংলা বলতে পারি। বাংলাদেশেও গিয়েছি। তার কথা শুনে আমার চোখ থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে কৌতূহল। মিকেলা তা ঠিকই ধরতে পারলেন। তিনি বললেন, আমি অনেক আগে থেকে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করি। এ কাজ করতে গিয়ে অনেক ভাষাভাষী, জাতি গোষ্ঠির সাথে মেশার সুযোগ হয়। বাংলাদেশিদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমি ধিরে ধিরে কৌতূহলী হয়ে উঠি। তাদের বুঝতে অনেক সময় মহাসমস্যায় পড়ে যাই। ইতালিতে অভিবাসী বাংলাদেশিদের (সকলের না) ভাষাগত দুর্বলতা তো আছেই, পাশাপাশি আর একটা বিষয় খেয়াল করি একেক জনের চিন্তা করার ধরন একেক রকম। কারো সাথে কারো মৌলিক কোনো মিল নেই। কেউ কাউকে উদার ভাবে সহযোগিতা করতে চায় না। অন্যান্য দেশের অভিবাসীরাও আলাদা আলাদা ভাবে চিন্তা করে, কিন্তু তাদের মৌলিক চিন্তায় একটা মিল আছে। যা বাংলাদেশিদের মধ্যে খুঁজে পাই না। দিনে দিনে বাংলাদেশিদের প্রতি আমার কৌতূহল বাড়তে থাকে। আমি বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক, মানসিক অবস্থান জানতে চেষ্টা করি। এ থেকেই মূলত বাংলা ভাষা শেখা এবং বাংলাদেশে যাওয়ার আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
Advertisement
মিকেলা ২০০৫ সালে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। সে অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, আমার বাংলাদেশ সফরের গোড়াতেই গলদ ছিল। আমার সাথে ইতালী থেকে একজন বাংলাদেশি অনুবাদকের যাওয়ার কথা ছিল। তার ওপর অনেকটা নির্ভর করে যখন আমি বাংলাদেশ সফরের সব ঠিক করে ফেলি তখন আর তাকে খুঁজে পাওয়া গেলো না। কোনো ভাবেই তার হদিস করতে পারলাম না। তিনি কোনো ভাবেই আমার সাথে যোগাযোগ করলেন না। বেশ খানিকটা হোঁচট খেলেও আমি দমে যাইনি। আমার বাংলাদেশ সফর বাতিল করিনি। কারণ কাজ করতে করতে বাংলাদেশিদের সম্পর্কে আমার ধারণা এবং অভিজ্ঞতা খুব একটা কম ছিল না।
মিকেলা বলেন, আমি ভালো ইংরেজি জানি, তারপরেও বাংলাদেশে গিয়ে ভাষাগত সমস্যা বেশ টের পাই। অনেক কষ্টে দূতাবাসের মাধ্যমে একজন মহিলা অনুবাদকের সন্ধান পাই, কিন্তু তিনি আমাকে ঢাকায় সময় দিতে রাজি হলেও ঢাকার বাইরে যেতে অপারগতা জানান। অগত্যা কী আর করা, আমি একাই রওনা দিলাম শরিয়তপুরের উদ্দেশ্যে।
আমি প্রশ্ন করলাম, বাংলাদেশের এত জায়গা রেখে শরিয়তপুর কেনো? মিকেলা হেসে উত্তর দেন, কারণ দুইটা। প্রথমত আমি পড়াশোনা করে জেনেছি, প্রকৃত বাংলাদেশ দেখতে হলে, বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি জানতে হলে, মানুষের চিন্তা চেতনার ধরন বুঝতে হলে মাটির কাছে যেতে হবে, অর্থাৎ গ্রামে যেতে হবে। শহুরে কোলাহলে বাংলাদেশের রুপ লাবণ্য বোঝা যাবে না। দ্বিতীয় কারণ হলো ভেনিসের বাংলাদেশি কমিউনিটির অধিকাংশ মানুষ শরিয়তপুর থেকে এসেছেন। শরিয়তপুরের অনেকের সাথে আমার পরিচয় আছে, বন্ধুত্ব আছে। ইতালিতে বসে এতবেশি শরিয়তপুরের গল্প শুনেছি যে শরিয়তপুর কে বাদ দিয়ে আমি বাংলাদেশ ভাবতেই পারি না।
মিকেলার চোখে মুখে তখন মুগ্ধতার আলো ঝলমল করছে। তিনি বলতে থাকেন, আমি শুধু শরিয়তপুর দেখিনি, গোটা বাংলাদেশ দেখেছি। বাংলাদেশের রুপ বৈচিত্র্যে মুগ্ধ হয়েছি। মানুষ আর প্রকৃতির নিবিড় বন্ধন দেখেছি। মাটির সাথে মানুষের ভালোবাসা দেখেছি। গ্রাম বাংলার সরল জীবন দেখেছি। বাংলাদেশের মানুষের আতিথেয়তা আমি কোনো দিন ভুলতে পারবো না। তারা মানুষকে ভালোবাসতে জানে, বুক পেতে আপন করে নিতে জানে। সেখানে প্রকৃতির মতো উদারতা আছে। নেই কোনো অকৃত্রিম অভিনয়।
Advertisement
কথার ফাঁকে মিকেলা গেয়ে উঠলেন, ও আমার দেশের মাটি তোমার উপর ঠেকাই মাথা। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো মিকেলার দিকে তাকিয়ে থাকি। তার চোখের আয়নায় আমার দেশ দেখি। এক সময় আমার দুই চোখ ভিজে যায়। তা দেখে মিকেলা হেসে ফেলে বলেন, তোমরা এত আবেগি কেনো? এত আবেগ বুকে নিয়ে তোমরা বাঁচো কি করে?
আমি মিকেলার কথার কোনো উত্তর দিতে পারি না। তিনি আমার দিকে একটা বই বাড়িয়ে দেন। বুঝতে পারি, প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ভারি হয়ে ওঠা পরিবেশটা মিকেলা একটু হালকা করতে চাচ্ছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যাওয়ার আরো একটা কারণ ছিল, ভেনিস বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতিতত্ত্ব বিভাগের জন্য একটা থিসিস লেখা। আমি বাংলাদেশ থেকে ফিরে সে কাজটি করেছি। আমার দেখা এবং অনুভব করা বাংলাদেশের খুঁটিনাটি সব বিষয় নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছি। যা বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।
মিকেলা তার বই সম্পর্কে বলেন, আমি বাংলাদেশের মানুষ কে আমার বইতে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশিদের জাতিতত্ত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ভবিষ্যতে যেসব ছেলে মেয়েরা বাংলাদেশিদের জাতিতত্ত্ব জানতে চাইবে, ওই বিষয়ে পড়াশুনা করবে বইটা তাদের কাজে লাগবে। আমি মিকেলার বইর পাতা উল্টাতে শুরু করি। বাংলাদেশের ইতিহাস, ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক অবস্থা, সমাজ-সংস্কৃতি, শরীয়তপুর-নড়িয়ার, সব বিষয় তুলে ধরেছেন আলাদা আলাদা করে। তার বইতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাজ, পর্দা, লজ্জা, দুর্নাম, বিয়ে, তালাক, যৌতুক, প্রেম-ভালোবাসা, ধর্ম চর্চা, প্রবাসীদের দেশিও জীবন মান, বেকারত্ব, হতাশা, নারী নির্যাতন, এসিড নিক্ষেপ, প্রবাসীদের গড় সংখ্যা, গার্মেন্টস, সমাজে পুরুষের আধিপত্য, শিক্ষা, বিশ্বাস, অবিশ্বাস, অন্ধবিশ্বাস, ঢাকার জীবন যাত্রা, ইতালি প্রবাসীদের গড় সংখ্যা, তাদের সুখ দুঃখ হাসি কান্না কি নেই? সব বিষয়ই তিনি তুলে ধরেছেন।
আমি জানি না মাত্র কদিনের বাংলাদেশ সফরে তিনি কী ভাবে এতকিছু নিজের ভেতর ধারণ করলেন, লিখলেন। আমি বোকার মতো প্রশ্ন করি, জানার জন্য, রিসার্চ করার জন্য এখনতো কোথাও যাওয়ার দরকার হয় না, নেটে ক্লিক করলেই সব পাওয়া যায়। মিকেলা বলেন, বাংলাদেশে গিয়ে আমি জীবনের অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। মানুষের জীবনের বৈচিত্র্য দেখেছি। যা কোনো ভাবেই বইপত্র পড়ে, ইন্টারনেট ঘেটে অর্জন করা সম্ভব ছিল না। যেমন আগে কোনো ভাবেই বুঝতে পারতাম না কেনো হাজার হাজার বাংলাদেশি নিজ দেশ ছেড়ে বিদেশে আসে। শুধুই কী দারিদ্র্যতার জন্য?
আমি জানি এক একজন বাংলাদেশি ইউরোপের যে কোনো দেশে আসার জন্য ১০/১৫ লাখ টাকাও খরচ করে। তার মানে তাদের সামর্থ্য আছে, তারা গরিব নয়। এসব চিন্তা করে আমি কোনো উত্তর মেলাতে পারতাম না। কিছুতেই বুঝতে পারতাম না এত কষ্ট তারা কেনো করে? কেনো তারা পথে পথে ফুল বিক্রি করা, খেলনা বিক্রি করার মতো কষ্টের কাজ বেছে নেয়। কেনো তারা জীবনের ঝুঁকি জেনেও সমুদ্র পথে পাড়ি দেয়। এখন আমি সব বুঝতে পারি। বাংলাদেশে যাওয়ার পরে আমার সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছি। যা বই পড়ে বা নেট ঘেটে পাওয়া সম্ভব হতো না।
বাংলাদেশে এখনো যৌথ পরিবার আছে, যা আমার খুবই ভালো লেগেছে। কিন্তু সমস্যা হলো অনেক যৌথ পরিবারে এক জনের আয়ের উপর ৫/৭ জন নির্ভর করে। একজন প্রবাসীর আয়ের উপর নির্ভর করে অনেক সংসার চলে। তারা অপেক্ষা করে থাকে কখন প্রবাসী ছেলে বা স্বামী টাকা পাঠাবে সেই টাকায় তারা সংসার চালাবে, নিত্য প্রয়োজন মেটাবে, ছোট বড় উৎসব করবে, আনন্দ ফুর্তি করবে, যা আমার কাছে সঠিক মনে হয়নি। একজন প্রবাসী যখন দেশে যায় তার আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে সবাই ওঁত পেতে থাকে দামি দামি উপহারের জন্য। তার টাকায় মোজ-মাস্তি করার জন্য।
যানবহনের ভাড়া থেকে শুরু করে সব জায়গায় তার কাছে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি টাকা দাবি করা হয়। বকশিস চাওয়া হয়। তারা একবারও ভাবে না- একজন মানুষের দ্বারা এত কিছু করা সম্ভব না। সকলের চাহিদা মেটানো সম্ভব না। অথচ ওই প্রবাসী প্রবাসে কী করে, কী ভাবে তার জীবন চলে তা কেউ ভাবে না। মিকেলা বলেন, হয়তো আমার বোঝায় অনেক ভুল থাকতে পারে, কিন্তু আমার কাছে বাস্তবতা এমনই মনে হয়ছে। মনে হয়েছে এমনটাই বাংলাদেশের কালচার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমি অনেক অভিভাবকের সাথে কথা বলে জেনেছি, তাদের ছেলেকে বাড়ি, দোকান, জমি বিক্রি করে, বন্ধক রেখে বিদেশে পাঠিয়েছেন। ছেলে বিদেশে গিয়ে বৈধ হতে পারেনি। ভালো কাজ পায়নি। সংসারের চাহিদা মেটাতে পারছে না। বাবা, মা, স্ত্রীর মুখে হাসি ফোটাতে পারছে না। একদিকে ছেলে বিদেশে কষ্ট করছে, অন্য দিকে বাবা মা স্ত্রী সন্তানরা দেশে কষ্ট করছে। আমি অনেক স্ত্রী কে দেখেছি তাদের কষ্টের কোনো সীমা নেই। তারা মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতেও পারে না। স্ত্রী বছরের পর বছর স্বামীকে কাছে পায় না, সন্তান কাছে পায় না তাদের বাবা কে। কেউ কেউ বছরে মাত্র একবার ৩/৪ সপ্তাহর জন্য কাছে পায়, যাকে কোনো ভাবেই স্বাভাবিক জীবন বলা যায় না।
মিকেলা বলেন, এখনো যারা লাখ লাখ টাকা খরচ করে ইতালি বা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি মজাচ্ছে আমার মনে হয়েছে তাদের কাছে সঠিক তথ্য নেই। তারা বুঝতে পারছে না ইউরোপে এখন আর আগের মতো কাজ পাওয়া যায় না। এখানের অনেক মানুষ বেকার। সঠিক তথ্য না জানার পেছনে আমার মনে হয়েছে দুইটা কারণ আছে, এক. যারা টাকার বিনিময় এদের বিদেশে নিয়ে আসে তারা সঠিক তথ্য দেয় না। আরেক হলো যদি কেউ (বন্ধু/আত্মীয়) সত্যি কথা বলে এরা বিশ্বাস করতে চায় না। মনে করে ওই বন্ধু বা আত্মীয় হয়তো তার ভালো চায় না, হিংসা করে। সবার মধ্যে কেমন যেনো একটা মোহ কাজ করে।
লেখক : ইতালিপ্রবাসী।
এইচআর/জেআইএম