রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে সারা দেশে তেমন একটা আলোচনা নেই। তবে ব্যতিক্রম হাওর জেলা কিশোরগঞ্জ। এখানকার মানুষের মধ্যে দেশের ২১তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই। এর কারণও আছে।
Advertisement
হাওরের জল-কাদা গায়ে মেখে বড় হয়েছেন ভাটির বরপুত্র একজন আবদুল হামিদ। পেয়েছেন খেতাবও। ভাটির নিভৃত পল্লী কামালপুরে সাধারণ গৃহস্থ পরিবারে জন্ম যে শিশুর- সেই আব্দুল হামিদ এখন বঙ্গভবনের অধিপতি। তাই দেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে নিয়ে এ জেলার মানুষ গর্ব করতেই পারেন।
কিশোরগঞ্জের মানুষের প্রিয় ‘হামিদ ভাই’ আবারও দেশের রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন এমনটা মনে করছেন এ জেলার মানুষ। তাদের ধারণা দেশের ইতিহাসে এ পর্যন্ত যারা রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের মধ্যে সেরা বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
প্রবীণ রাজনীতিক, সদালাপী, সৎ ও হাসি-খুশি এ মানুষটি দেশের মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। দলমত নির্বিশেষ সবার কাছে হয়েছেন প্রিয়পাত্র। দেশের যে কোনো সংকট মুহূর্তে প্রকৃত অভিভাবকের মতোই নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন।
Advertisement
২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন মো. আবদুল হামিদ। আগামী ২৩ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এরই মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। আগামী ১৮ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
তফসিল ঘোষণার পর থেকেই কে হচ্ছেন নতুন রাষ্ট্রপতি এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। ২১তম রাষ্ট্রপতি পদে বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ছাড়াও দেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের বড় ছেলে জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী ও জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরিন শারমিনের নাম সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে শোনা যাচ্ছে।
তবে কিশোরগঞ্জবাসীর বিশ্বাস এবং প্রত্যাশা বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদকেই দ্বিতীয় মেয়াদে আবারও রাষ্ট্রপতি করা হবে।
তাদের মতে, আবদুল হামিদ একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। প্রথম মেয়াদে তিনি সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাকে নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন। সামনে জাতীয় সংসদের নির্বাচন। আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকরাও চাচ্ছেন তিনি রাষ্ট্রপতি থাকুক। সবমিলে আবদুল হামিদ আবারও রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন বলেই বিশ্বাস তাদের।
Advertisement
কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ও জেলা জজ কোর্টের পিপি অ্যাডভোকেট সাহ আজিজুল হক বলেন, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। বর্তমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি সততা ও সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। দেশ-বিদেশে তিনি ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছেন। তাই আমি মনে করে দেশনেত্রী শেখ হাসিনা তাকেই আবারও রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেবেন।
রাষ্ট্রপতির নিজের নির্বাচনী এলাকা অষ্টগ্রামের আব্দুল্লাহপুর গ্রামের কৃষক মিয়াচান বলেন, ‘হামিদ ভাই আমরার লাইগ্যা আল্লাহর দান। তার মতো নেতা আর হবে না। উনি আছেন বলেই হাওরের মানুষ ভালা আছে। তারেই আমরা আবার রাষ্ট্রপতি দেখতে চাই।’
ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত মো. আবদুল হামিদ। কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকা থেকে তিনি সাত বার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের উপনেতা, ডিপুটি স্পিকার ও দুই বার স্পিকারের দায়িত্বও পালন করেছেন। জাতীয় সংসদের ডিপুটি স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আবদুল হামিদ। বাবা হাজি মো. তায়েব উদ্দিন ও তমিজা বেগম। কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল সরকারি কলেজ থেকে মানবিকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পাস করেন।
এরপর ঢাকার সেন্ট্রাল ল’ কলেজ থেকে এলএলবি পাস করে কিশোরগঞ্জ বারে আইন পেশায় যোগ দেন তিনি। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত পাঁচবার জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫৯ সালে ছাত্রলীগে যোগ দেয়ার মধ্য দিয়ে আবদুল হামিদের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ১৯৬১ সালে কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থাতেই যোগ দেন আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে।
একপর্যায়ে তাকে কারাগারেও যেতে হয়। গুরুদয়াল কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ও সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালনের পর ১৯৬৪ সালে কিশোরগঞ্জ সাব-ডিভিশনের ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব নেন আবদুল হামিদ। ১৯৬৬-৬৭ সালে ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। এরপর ১৯৬৯ সালে যোগ দেন আওয়ামী লীগে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে ময়মনসিংহ-১৮ আসন থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য নির্বাচিত হন আবদুল হামিদ। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে তাকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৫ আসন থেকে নির্বাচিত হন আবদুল হামিদ। এরপর ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ, ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ, ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ, ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ এবং সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তিনি সাংসদ নির্বাচিত হন। সপ্তম সংসদে ১৯৯৬ সালের ১৩ জুলাই থেকে ২০০১ এর ১০ জুলাই পর্যন্ত ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব পালনের পর ২০০১ এর ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত স্পিকার হিসেবে সংসদ পরিচালনা করেন আবদুল হামিদ। নবম সংসদে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর দ্বিতীয়বারের মতো স্পিকার হন।
দ্বিতীয় মেয়াদে স্পিকার থাকার সময় রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানো হলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পান আবদুল হামিদ। পরে তাকেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়।
দেশে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি চালু হওয়ার পর থেকে একজন রাষ্ট্রপতি দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার নজির নেই। আসন্ন নির্বাচনে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে কামালপুরে অজপাড়া গাঁয়ে জন্ম নেয়া মো. আবদুল হামিদ দ্বিতীয় মেয়াদে দেশের ২১তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন এমন আশাবাদ কিশোরগঞ্জবাসীর।
নূর মোহাম্মদ/এএম/আরআইপি