সাহিত্য

দিকচক্রবাল

বর্ষাতির হুডিটা মাথার উপর আরো একটু টেনে দেয় মেয়েটি। ঘন কালো রাত। সন্ধ্যা শেষ হয়েছে বেশিক্ষণ হয়নি। বৃষ্টির রাত বলেই হয়তো রাস্তায় মানুষজন কম। টানা দশ মিনিট হাঁটলে এক আধটা চা পুরীর দোকান আর ওষুধের ফার্মেসি খোলা পাওয়া যায়। টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে শহরের রাস্তাগুলোয় পানি জমে গেছে। কোথাও প্যাঁচপ্যাচে কাঁদা। সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। ঘন নীল রঙা বর্ষাতিটাকে এখন কালো মনে হচ্ছে। রেইন কোটের নিচে একটা ঢোলা পাজামা, পালাজ্জো না কী যেন নাম এর!

Advertisement

উৎপত্তিস্থল চায়না হবার সম্ভাবনা প্রবল। আজকাল পোষাকে পরিবর্তন আসছে ব্যাপক। ওয়েস্টার্ন-ইস্টার্ন মিলেমিশে একাকার। জগা খিচুড়ি। হাঁটতে হাঁটতেই মেয়েটি একটু হাসে। তবে এই পোষাক বর্ষণ দিনের জন্য বেশ লাগসই। উপরে টেনে ধরে রাস্তার জল কাঁদা ঠেকানো যায়। সালোয়ার অথবা জিন্সে সেই সুবিধা নেই। জগা খিচুড়ি শব্দটি মনে পরায় আরেক মুশকিল সামনে এসে দাঁড়ালো। খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে করছে। টমেটো শিম ফুলকপি ধনেপাতা দিয়ে রান্না গরম গরম ঢিলা খিচুড়ি। বৃষ্টির দিনে মা রান্না করতো। ঘরে বিফ অথবা চিকেন না থাকলে শুকনা মরিচ ভাজা আর শর্ষের তেলে ডিম ভাজাই সই।

বৃষ্টিটা আরো জেঁকে আসছে। হাতব্যাগে একটা ছাতা আছে। ব্যাগ খুলে বের করতে ইচ্ছে করছেনা। ভ্রূ’র উপর থেকে একফোঁটা জল ঠোঁটের উপর গড়িয়ে পড়লো। ঠোঁট ফাঁক করে আলগোছে জলটা জিবে নিয়ে এলো সে। তারপর আবার হাঁটতে থাকে। নির্জন রাস্তায় প্রায় একলা হাঁটছে মেয়েটি, লম্বা লম্বা পা ফেলে। কোনদিন কেউ সি সি টি ভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখলে থ্রিলার মুভির কোন দৃশ্য বলে মনে হতে পারে। ফটোশপ করে হাতে একটা চকচকে ছুড়ি ধরিয়ে দিতে পারলেই, ব্যস।

লোয়ার এবডোমেনে হালকা চিনচিনে ব্যাথাটা হঠাৎ আবার টের পাওয়া যাচ্ছে। স্যানিটারি ন্যাপকিন ভিজছে দ্রুত। বাসায় যেতে হবে। তারাতারি চেইঞ্জ না করলে লিক করতে পারে। আড়াই মাস পর শরীরে ভেজা ভেজা ভাব। মাথাটা খিঁচে ধরে আছে ব্যাথায়। অল্প বয়েসি সুন্দরী নার্স বলেছিলো, গায়ে হালকা জ্বর আসতে পারে। এসবের ওষুধ দেয়া আছে। আবারো লিকুইড ডিসচার্জ হচ্ছে, এবার ফ্লো অনেক বেশি। দু’পা চেপে দশ সেকেন্ড শুন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে সে। তরল আটকানোর মিছে প্রয়াস। আজ উচ্ছিষ্ট তরল, কাল শরীরে ছিলো। ইষদোষ্ণ ওভারির ভেতর। শরীর তার নিজের নিয়মেই যত্ন নিচ্ছিলো। তিনমাসে কী ছেলে অথবা মেয়ের অর্গান নির্ধারিত হয়? হয় হয়তো, হয়তো না। কী আসে যায়! আবার জলময় রাস্তায় সেন্ডেলে ছপ ছপ শব্দ তুলে একলা হাঁটে মেয়েটি। সাথে হাঁটে তার প্রায় কালো বর্ষাতি।

Advertisement

বিয়ের পর ঘর সংসার ব্যাপারটা অনেকটা অভ্যাসের মত। আছি তো আছি। নেই তো নেই। সকালে ঘুম ভাঙ্গা চোখে আর্যকে দেখে রেবেকা। পাশবালিশে উবু হয়ে ঘুমোয়। ঘুমন্ত নিস্তেজ শরীর। আর্য ইনসমনিয়াক। রেবেকা ঘুমানোর অনেক পরে টেলিভিশনের ঘর থেকে সে ঘুমোতে আসে। আবার রেবেকা অফিস যাওয়ার অনেক পর আর্যর ঘুম ভাঙ্গে। অফিসে যাবার তাড়া নেই তার। নিজের অফিস। ওয়াটার পিউরিফায়ারের ব্যাবসা। চায়না পণ্য। ব্যাবসায় যে খুব প্রসার, বিষয় তেমন না। আরেক মেইজ ইম্পোর্টারের সাথে শেয়ার করা দু’কামরার মতিঝিলের অফিস। শেয়ার করা ম্যানেজার, পিওন, সিকিউরিটি গার্ড।

রেবেকা ঘুম চোখে টুথব্রাশে পেস্ট লাগায়। ডাভ শ্যাম্পুতে শাওয়ার শেষ করে। টুকিটাকি প্রসাধনীর পর ব্যাগপ্যাক কাঁধে ঝুলিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ে অনন্ত ঘুর্ণায়মান পৃথিবীর সাথে সামিল হবে বলে। রাস্তায় বেড়িয়েই রেবেকা টের পায়, লাল সাদা ব্যাগপ্যাক আর আর্যর মধ্যে মূলত কোন পার্থক্য নেই। দুটোই অভ্যস্ততা। ব্যাগপ্যাকটা কাঁধের উপর ঝুলে থাকে আর আর্য ঝুলে থাকে রেবেকার দিনরাতের সাথে। প্রশ্নবোধক কিংবা আশ্চর্যবোধক কিছুই না। আর্য আসলে একটা সরল রেখা। কোন বাঁক ঝাঁক ছাড়া।

বিয়ের তাড়াটা আর্যর ছিলো বেশি। আর্য গিটারিস্ট, বাঁশিও বাজাতো। মাঝে কিছুদিন সেক্সোফোন ট্রাই করেছিলো। বশেও এসেছিলো। কিন্তু কোনকিছু দীর্ঘদিন ধরে রাখাটা আসলে তার ধাতে নেই। রেবেকার সাথে ভাব ভালোবাসার বিয়ে। প্রেম ফুরিয়েছিলো বিয়ের ছ’মাস পর। ভালোবাসাটা এসে ঠেকেছে অভ্যস্ততায়। মনের দায়, শরীরের দায় তেমন কোনকিছুই রেবেকার নেই। রাতে ফিরে শুধু এনশিউর করা আর্য আছে। ব্যস আর কিছু না। কাজের যন্ত্রপাতি কিনতে আর্য প্রায়ই চায়না যায়। আট দশদিন থাকে। রেবেকা তখনই শুধু টের পায়, কিছু একটা নেই। না থাকলে খুব খারাপ লাগেনা আবার ভালোও লাগেনা।

স্কাইপের ভিডিও কলে কথা হয় টুকটাক। “কিছু লাগবে?” রেবেকা হয়তো বলবে, “তেমন কিছুনা। ভালো ফ্রাই প্যান পেলে এনো। আগেরগুলো তেমন কাজ করেনা” টাইপ কথাবার্তা। একলা ঘরে রেবেকা খানিকক্ষণ সিনেমা টিনেমা দেখে। কফিমেকারে শো শো শব্দ তুলে একমগ কফি বানায়। শেষ করে ঘুমোতে যায়। মনে হয় কিছু একটা নেই। কি নেই? পাশবালিশে নিস্তেজ একটা শরীর। একটু কি মন খারাপ হয় রেবেকার? না বোধয়। অতটুকু মন খারাপ পুরোনো কোন শাড়ি ফেলে দেবার পরও হয়। কি ছিলো, কি নেই!

Advertisement

রেবেকা জামদানি শাড়ি ফ্রিক। ফ্রিক শব্দটি কি এক্ষেত্রে ঠিক আছে? জাম ফার্সি শব্দ। এর মানে ফুল। তারমানে জামদানির শাব্দিক অর্থ “ফুলদানি।” নাম যে বানিয়েছে, বুদ্ধিমান, কোন সন্দেহ নেই। বিয়ের পর প্রথম জন্মদিনে রেবেকার জন্য ভিন্ন ভিন্ন ফুলের ভিন্ন ভিন্ন রঙ্গের পাঁচটা জামদানি শাড়ি উপহার দিয়েছিলো আর্য। সেই প্রথম এবং শেষ। এরপর কোন দিবস বা পার্বন আর মনে করে রাখতে পারেনি আর্য। আর্য কোন দায়িত্বে জড়ায় না। দিন যায় রাত আসে ধরনের মানুষ।

আর্য বলেছিলো, ঘরে একজন শিশু প্রয়োজন। হ্যাঁ প্রয়োজন। জৈবিক প্রয়োজন। মানুষ স্বভাবতই স্বার্থপর প্রাণী। অন্যের যা আছে তা আমার চাই, ব্যাপারটা এরকম। অনাদিকাল থেকে মানুষ তার আপন প্রতিভূ দেখতে চায়। মানুষ মরে মাটিতে মিশে যায়। তারপর ফুল পাখি লতা পাতা। কিন্তু এভাবে সে তার নিজেকে ফুরিয়ে যেতে দিতে চায় না। তৈরি করে আরেকটা শরীর। যার মধ্যে সে আরেকবার বেড়ে উঠে, বেঁচে থাকে। প্রকৃতির রিফিল। আর্য টিপিক্যাল মানুষের বাইরের কেউ নয়। সে তার রিফিল চেয়েছে রেবেকার কাছে। ঘরে আতুর। বাতাসে জনসন বেবী পাউডার, পিয়ার্স সাবানের সুবাস। মাস ফুরোলে ডানো দুধের কৌটা। বুড়ো দোকানির কাছে তৃপ্ত মুখে ফিডারের দাম জিজ্ঞেস করার আনন্দই আলাদা।

তারপর বছর তিনেক গেলে সরু সরু মুখ করে নার্সারি স্কুলের প্যারেন্ট রুমে বসে অস্থির অপেক্ষা। ছেলে ওরাল এডমিশন টেস্ট শেষ করে এলে শিশু কোলে নিয়ে ফোঁস করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস। এসবে রেবেকারও আগ্রহ ছিলো সমান। কিন্তু সিদ্ধান্ত অন্য কোথাও লটকে থাকে। “দায়িত্ব” শব্দটিকে আর্যর আকাশে একফালি ঈদের চাঁদ হয়ে ঝুলে থাকতে দেখেছে রেবেকা সর্বদা। রেবেকা জানে, আর্যর কাছে শিশু জন্মদান মানে শুধুমাত্র কয়েক ফোঁটা বীর্যস্খলন। এরপর রেবেকা একে নিষিক্ত করবে, জন্ম দিবে, শিশু থেকে মানুষ বানাবে। সব কিছু তার একাকেই করতে হবে। হয়তো ঠিক করে করা হবেনা কিছুই। হয়তো কোথাও ফাঁক থেকে যাবে। কী দায়! কী দায়!

 

পিরিয়ডের ঠিকঠাক ডেট রেবেকা মনে করে রাখেনা কখনো। চেস্ট ড্রয়ারে স্ট্রবেরি ফ্লেবারের রাবার। ডেটগুলো তার নিজের নিয়মেই আসে যায়। জুন মাসের শেষের দিকে শরীরে অস্বস্তি বাড়ে। ঘুম চোখে জরিয়ে থাকে, ছেড়ে যায় না। নিজেকে মাতাল মনে হয়। সকালে হাটতে গেলে মাথার ভেতর টলে উঠে। দেয়ালগুলো কী মায়ায় আলগোছে দুলতে থাকে। বাটার ব্রেড মুখ পর্যন্ত যায় কোনমতে। তাপরপ শুরু হয় বিদ্রোহ। গলা দিয়ে নামেনা। রাজপথে বিরোধী দলের আমরণ অনশন। কী এক চেনাশুনা আতংকে রেবেকার ঠোঁটের কোনে বক্ররেখা। কপালের ভাঁজগুলো ঘনীভূত হয়।

প্রথমে নিজেই পরীক্ষা করে নিয়েছিলো, ফার্মেসি থেকে ইজি টেস্ট কিনে। ওয়ান রেড স্ট্রাইপ ফর নেগেটিভ, টু ফর পজেটিভ। রেবেকার বিস্ফোরিত চোখ দেখছিলো স্ট্র্যাপের লাল পারাটা এক থেকে ক্রমশ দুয়ে উঠে গিয়েছিলো। গলার কাছে আটকে থাকে বমি, চারিদিকে পোড়ামাটির সোঁদা গন্ধ!!

অফিসে মান্থ ক্লোজিং। একটু ফ্রি হয়ে চলে গিয়েছিলো বন্ধু সায়ানের ক্লিনিকে। সায়ান পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো পরমার সাথে। পরমা গাইনি ডাক্তার। এ্যাবরশনে তার হাত ভালো। ক্লিনিকের জানালার বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি। উত্তুরে বাতাসে জলো ঘ্রাণ। রেবেকা বৃহস্পতিবার বিকেলটাকে বেছে নিয়েছিলো। শুক্র শনি দুদিন ছুটি। একটু রেস্ট হবে। আজকাল ফোনপ্যাড টাচ করলে গাড়ি পাওয়া যায়। ক্লিনিক থেকে বের হয়ে উবারে বসার পর থেকে রেবেকা অপেক্ষা করতে থাকে নির্ভার হবার সেই দিনটির জন্য, সেই মহাস্খলনের।

বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আকারে ছোট হচ্ছে ক্রমশ। বাসার প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে রেবেকা। লিফটের কাছে এসে বর্ষাতিটা খুলে ফেলে সে। কলিংবেল চাপার মিনিটখানেক পর দরোজা খুলে দেয় আর্য। তারপর সে চলে যায় টিভি রুমের দিকে। রেবেকা বেডরুমের আলো জ্বালে। ভেজা কাপড় ছাড়ে। সাদা তোয়ালেতে বব করে কাটা ভেজা চুল শুকোয়। এ্যান্টিবায়োটিক ওষুধগুলো গেলার আগে তার কিছু খাবার প্রয়োজন। হঠাৎ মনে পরে, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ঢিলা খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে করছিলো। রেবেকা একটু গলা চড়িয়ে, জিজ্ঞেস করে,

: খুদা পেয়েছে, ঘরে খাবার কিছু আছে আর্য?

: রান্না করা কিছু নেই বোধয়। তেহারি টেহারি কিছু আনতে যেতে চেয়েছিলাম। বৃষ্টির জন্য যেতে পারিনি। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছি। কিছু একটা রাঁধো।

ফ্রিজে দুটা পাটিসাপটা পিঠা ছিলো। পিঠাঘর থেকে দিন কয়েক আগে কেনা। রেবেকা সেগুলো বের করে একটা খেয়ে নেয়। একগ্লাস গরম দুধের সাথে গুনে গুনে সাতটা বিভিন্ন জাতের ট্যাবলেট। ঘরের আলো নিভিয়ে শুয়ে পরে। আজ একটা কষ্টের দিন ছিলো। কষ্টটা শারীরিক। শরীরের লোয়ার পোর্শনে চাপচাপ ব্যথা। এখন অন্ধকার ঘরে শুয়ে শুয়ে কেমন একটা আনন্দ খেলা করে রেবেকার মনে! দায় মুক্তির আনন্দ! একটা শিশুকে ডেকে এনে তার উপর অবহেলাময় কষ্টদায়ক একটা দীর্ঘ জীবন চাপিয়ে দেবার দায় মুক্তি।

ঘুমের ভেতর রেবেকা একা একা হাঁটতে থাকে। তারপর সে একখণ্ড মেঘ হয়ে যায়। তারপর ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। তারপর বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ঘুমন্ত মেয়েটির চোখের কোণে লেগে থাকে চুপচাপ।

এইচআর/জেআইএম