বরিশাল-ঢাকা নৌরুটে যুক্ত হচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ যাত্রীবাহী অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর বিলাসবহুল লঞ্চ কীর্তনখোলা-১০। ইতোমধ্যে লঞ্চটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। চলছে উদ্বোধনের জন্য শেষ মুহূর্তের রঙ ও সাজসজ্জার কাজ। সবকিছু ঠিক থাকলে মার্চের প্রথম সপ্তাহে যাত্রী বহন শুরু করবে দেশের সবচেয়ে বেশি যাত্রী ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই লঞ্চটি।
Advertisement
এমভি কীর্তনখোলা-১০ লঞ্চের নির্মাতা দেশের অন্যতম আধুনিক ও বিলাসবহুল নৌযান প্রস্ততকারী প্রতিষ্ঠান সালমা শিপিং করপোরেশন।
যাত্রীদের আকৃষ্ট করতে কীর্তনখোলা-১০ লঞ্চে প্লে-গ্রাউন্ড, ফুড কোড এড়িয়া, বিনোদন স্পেস, বড় পর্দার টিভি, অত্যাধুনিক সাউন্ড সিস্টেম, ইন্টারকম যোগাযোগের ব্যবস্থা, উন্মুক্ত ওয়াইফাই সুবিধাসহ রয়েছে বিভিন্ন বিনোদনের ব্যবস্থা। আধুনিকতা ও প্রযুক্তি এবং আয়োজনের দিক থেকে কমতি নেই কীর্তনখোলা-১০ লঞ্চটিতে।
অভিজাত শ্রেণির বিলাসী যাত্রীদের জন্য লঞ্চটিতে থাকছে ১৭টি ভিআইপি কেবিন। কেবিনগুলো বানানো হয়েছে বিলাসবহুল আবাসিক তিন তারকা হোটেলের আদলে। ব্যয়বহুল ও দৃষ্টিনন্দন আসবাবপত্রে সাজানো প্রতিটি কক্ষ। প্রতিটি কেবিনের সঙ্গে রয়েছে সুবিশাল বারান্দা। এখানে বসে নদী, পানি, আকাশ আর আশপাশের মনোরম প্রকৃতি দেখার ব্যবস্থা রয়েছে। কক্ষের ভেতরে রয়েছে এলইডি টেলিভিশন। রিভার সাইটের কেবিনের ভেতর থেকেও সহজেই দেখা যায় বাইরের নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলি। লঞ্চের করিডরগুলোতে রয়েছে নান্দনিক ডিজাইন।
Advertisement
নকশা ও কারুকাজ যে কারো মন কারবে। ভিআইপি ও কেবিন যাত্রীদের জন্য রয়েছে আলাদা সুসজ্জিত খাবার হোটেল । চাহিদা অনুযায়ী বাবুর্চিরা যাত্রীদের সুস্বাদু সব খাবার পরিবেশন করবেন।
এছাড়া ২ হাজার যাত্রী ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই লঞ্চটিতে রয়েছে ৭০টি ডাবল ও ১০২টি সিঙ্গেল কেবিন।
৪ তলা এই লঞ্চটির ডেকের যাত্রীদের জন্য যাত্রা আরামদায়ক করতে নিচ তলা ও দুই তলায় বেছানো রয়েছে মসৃন কার্পেট। আলোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে অত্যাধুনিক ডিজিটাইল লাইট। বিনোদনের জন্য তৃতীয় শ্রেণির যাত্রীদের জন্য থাকছে বড় পর্দার টিভি এবং অত্যাধুনিক সাউন্ড সিস্টেম। খাবার জন্য কেন্টিন ও পর্যাপ্ত টয়লেট ব্যবস্থা রাখা হয়েছে লঞ্চটিতে। এছাড়া ডেকের যাত্রীদের জন্য রয়েছে মোবাইল চার্জের ১২৪টি পয়েন্ট। যেখানে ২৪৮টি মোবাইলে এক সঙ্গে চার্জ দেয়া সম্ভব হবে।
এছাড়া সর্ববৃহৎ যাত্রীবাহী এই নৌযানটিতে রোগীদের জন্য আইসিইউ, সিসিইউসহ মেডিকেল সুবিধা। যাত্রীদের নামাজের জন্য রয়েছে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত নামাজের স্থান। যেখানে এক সঙ্গে ৩০ জন নামাজ আদায় করতে পারবেন।
Advertisement
আর যাত্রীদের নিরাপত্তায় লঞ্চটিতে থাকবে একজন কমান্ডারসহ সশস্র আনসার সদস্যরা। এছাড়া পুরো লঞ্চটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসি) আওতাভুক্ত। আধুনিক অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ও পর্যাপ্ত লাইফ বয়া রাখা হয়েছে যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য।
দেশের সর্ববৃহৎ যাত্রীবাহী অত্যাধুনিক এই লঞ্চটি নিয়ে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। বিশাল আকারের অত্যাধুনিক বিলাসবহুল এই লঞ্চটি নির্মাণ হয়েছে বরিশাল নগরীর কীর্তনখোলা নদীর তীরে বেলতলা ফেরিঘাট এলাকায় বাগেরহাট শিপ বিল্ডার্স নামের একটি ডক ইয়ার্ডে। সেখানে প্রায় প্রতিদিনই ভিড় করছে উৎসুক মানুষ।
লঞ্চটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সালমা শিপিং করপোরেশনের সহকারী ব্যবস্থাপক (এজিএম) মো. রিয়াজুল করিম জানান, এরই মধ্যে কীর্তনখোলা-১০ লঞ্চের নির্মান কাজ শেষ হয়েছে। আগামী দু-এক সপ্তাহের মধ্যে ইঞ্জিন পরীক্ষার জন্য নদীতে ভাসানো হবে। সব কিছু ঠিক থাকলে মার্চের প্রথম সপ্তাহে বরিশাল-ঢাকা নদী পথে যাত্রী পরিবহন শুরু করতে পারবে।
এজিএম মো. রিয়াজুল করিম জানান, বিশেষজ্ঞ নৌ-স্থাপতির নকশায় সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের প্রকৌশলীদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে প্রায় দু’বছর ধরে কীর্তনখোলা-১০ লঞ্চের নির্মাণ কাজ চলছে। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৮০ জন শ্রমিকের নিরলস পরিশ্রমে নির্মাণ কাজ এখন শেষের পথে। ৩শ ফুটেরও বেশি দৈর্ঘের এ নৌযানটির প্রস্থ ৫৯ ফুট। এর লোয়ার ডেক, আপার ডেক ও দু’শতাধিক কেবিন মিলিয়ে দেশের সর্ববৃহৎ এই লঞ্চটি দুই হাজারেরও বেশি যাত্রী ধারণ করতে পারবে।
এছাড়াও দুই শতাধিক টন পণ্য পরিবহনের সুবিধাও রয়েছে নৌযানটিতে। জাপানের একটি কোম্পানির তৈরি ৩ হাজার ২০০ অশ্বশক্তির ২টি মূল ইঞ্জিন ছাড়াও নৌযানটির বাতানুকূল প্রথম শ্রেণি ও ভিআইপি কক্ষসহ ডেক যাত্রীদের জন্য পর্যাপ্ত আলো ও বাতাস নিশ্চিতকরণে ৩টি জেনারেটরসহ আরও একটি স্ট্যান্ডবাই জেনারেটরও সংযোজন করা হয়েছে।
কীর্তনখোলা-১০ লঞ্চ এর হুইল হাউজে (চালকের কক্ষ) সম্পূর্ণ অত্যাধুনিক প্রযুক্তির নির্ভর যন্ত্রাংশ সংযোজন করা হয়েছে। এর রাডার-সুকান ‘ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক’ ও ম্যানুয়াল দ্বৈত পদ্ধতির।
পাশাপাশি নৌযানটিতে আধুনিক রাডার ছাড়াও জিপিএস পদ্ধতি সংযুক্ত করা হয়েছে। ফলে লঞ্চটি চলাচলরত নৌপথের ১ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে গভীরতা ছাড়াও এর আশপাশের অন্য যেকোনো নৌযানের উপস্থিতি চিহ্নিত করতে পারবে। এমনকি ঘন কুয়াশার মধ্যেও নৌযানটি নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারবে বলে জানিয়েছে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ। কীর্তনখোলা-১০ লঞ্চ পরিচালনার জন্য দক্ষ মাস্টার অফিসার ও ইঞ্জিন অফিসার ছাড়াও অর্ধশতাধিক বিভিন্ন শ্রেণির ক্রু থাকছে।
সালমা শিপিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মঞ্জুরুল আহসান ফেরদাউস বলেন, সালমা শিপিং করপোরেশনের এটি তৃতীয় লঞ্চ। কীর্তনখোলা-১০ লঞ্চটি তৈরির সময় যাত্রী ও নৌযানের নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। জাহাজ নির্মাণের অন্যতম কাঁচামাল ইস্পাতের তৈরি নতুন পাত আমদানি করা হয়েছে। এছাড়া ইঞ্জিন, প্রপেলারসহ সব কিছুই নতুন আমদানি করা হয়েছে। জাপানের তৈরি ৩ হাজার ২০০ অশ্ব শক্তির ২টি মূল ইঞ্জিনের কারণে লঞ্চটি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৫ নটিক্যাল মাইল বেগে চলতে সক্ষম। আর জাহাজটির ঝুঁকিমুক্ত চলাচলের জন্য জিপিআরএস সিস্টেম, রাডার, ইকোসাউন্ডার, এক জাহাজ থেকে একই কোম্পানির আরেক জাহাজে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য ভিএইচএফ এবং জাহাজের অভ্যন্তরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সার্বক্ষণিক কথপোকথনের জন্য ওয়কিটকির ব্যবস্থা রয়েছে। কয়েক স্তর বিশিষ্ট স্টিলের মজবুত তলদেশ থাকায় দুর্ঘটনায় তলদেশ ফেটে লঞ্চডুবির আশঙ্কা নেই। অর্থাৎ এ জাহাজটিতে সম্ভাব্য সব ধরনের প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা থাকবে।
তিনি আরও বলেন, সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিতে পেশাদার ইন্টেরিয়র ডিজাইনার দিয়ে লঞ্চের কেবিন, করিডরসহ ভেতরের বিভিন্ন অংশে নান্দনিক ডিজাইন ও ডেকরেশন করানো হয়েছে। এসব নকশা ও কারুকাজ যে কারো মন কাড়বে। যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে এই প্রথমবারের মতো বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ব্রোঞ্জ ও সুসজ্জিত দরজার ব্যবস্থা করা হয়েছে। লঞ্চের কেবিনগুলো অন্য যে কোনো লঞ্চের কেবিন থেকে প্রশস্ত করা হয়েছে। এক একটি সিঙ্গেল কেবিনে দু’জন মানুষ অনায়াসে থাকতে পারবেন। এছাড়া একজন চিকিৎসকসহ হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য লঞ্চে করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) ও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রসহ (আইসিইউ) ৩ বেডের একটি মিনি হসপিটালের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
নতুন এই লঞ্চ যাত্রীদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নতুন একটা ধাপে নিয়ে যাবে। ২ বছর ধরে নির্মাণ করার পর এই নতুন সর্ববৃহৎ লঞ্চটি মার্চের প্রথম সপ্তাহেই যাত্রীদের সামনে হাজির করা হবে। আমরা আত্মবিশ্বাসী, এই সেবা যাত্রীদের চমকে দেবে। তবে নৌযানটি বিলাসবহুল হলেও ভাড়ায় তেমন পরিবর্তন হবে না। সব শ্রেণির যাত্রী ভাড়া অন্যসব নৌযানের মতোই থাকবে।
মো. মঞ্জুরুল আহসান ফেরদাউস বলেন, সবচেয়ে বেশি যাত্রী ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ও আকারে বড় হওয়ায় কীর্তনখোলা-১০ লঞ্চটি দেশের সর্ববৃহৎ যাত্রীবাহী বিলাসবহুল লঞ্চ। তিনি বলেন, জাহাজ ব্যবসা ও নির্মাণ শিল্পে এখন মন্দা চলছে। বিলাসবহুল প্রযুক্তি নির্ভর এই লঞ্চটি নির্মাণে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে। অর্থ জোগাড়ে তাকে বিভিন্ন ব্যাংকে ধরনা দিতে হয়েছে। সহজ শর্তে ঋণ এবং সুদের হার কমানো হলে জাহাজ ব্যবসা ও নির্মাণ শিল্প এ অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থানে বড় ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি জাহাজ ব্যবসা ও নির্মাণ শিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারিভাবে এ শিল্পকে সহায়তা করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
সাইফ আমীন/এমএএস/আইআই