রেকর্ড ভেঙে এবার শীত নামলেও গায়ে পড়ার মতো বাঘ নেই দেশে। এ শীতে সুন্দরবনে বাঘের হাড় কাঁপছে কি-না? এ সংক্রান্ত খবরাখবরও নেই। এর মূল কারণ বাঘই ‘নাই’ হয়ে যাওয়ার পথে। তবে গরু-ছাগলসহ অন্যান্য পশু ও জন্তুর সংখ্যা বাড়ছে। আপডেট হিসাব বলছে, কমতে কমতে সুন্দরবনে বাঘ এখন মাত্র শ খানেক। সুন্দরবন ছাড়া দেশের আর কোথাও বাঘের বসবাস নেই। অন্যদিকে বাড়তে বাড়তে দেশে গরু-ছাগল, মহিষ-ভেড়ার সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি। তথ্যটির সংবাদমূল্য অনেক। বাঘের সংখ্যা অব্যাহতভাবে কমতে থাকার নিউজভ্যালুও কম নয়।
Advertisement
বাঘ জগতের এক অনন্য সৃষ্টি। নামের সঙ্গে এর বাহার প্রতীকে-আভিজাত্যেও। বাংলার বাঘ বা রয়েল বেঙ্গল টাইগার শুনতেও গর্বের মতো। যে কারণে সৃষ্টির সেরা জীব হয়েও কোনো মানুষকে টাইগার নামক পশু বললে আপত্তি করে না। বরং একটু খুশিই হয়। কিন্তু আফসোস আর উদ্বেগের খবর হচ্ছে, সুন্দরবনে এখন বাঘ আছে মাত্র ১০৬টি। এ বাঘগুলোও ভুগছে অস্তিত্ব সংকটে। মানুষরূপী হিংস্র প্রাণি, চোরাকারবারিদের হাত থেকে বাঁচার পথ পায় না। সুদূর অতীত থেকেই বাঘ শিকারকে বীরত্বের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। এ বীরত্বের দিনও শেষ হয়ে আসছে। বাঘই যদি না থাকে শিকার হবে কোথায়? গর্বেরই বা তখন অবশিষ্ট থাকবে কোথায়?
বাংলাদেশে বাঘের মাংস, হাড়, চামড়া, চর্বি, তেল নিয়ে কিছু বাণিজ্য রয়েছে। এই কারবারিরা সুন্দরবন এলাকায় বাঘ হত্যা ও চোরাকারবারিদের চাঙ্গা রাখছে। সুন্দরবনসহ আশপাশে এ নিয়ে একটি চক্র গড়ে ওঠেছে। এদের না দমালে ভবিষ্যতে গোনা বা শুমারি করার মতো বাঘ মিলবে না। তথ্য কিন্তু তেমন আভাসই দিচ্ছে।
বনবিভাগ বলছে, ২০০০ সাল থেকে ২০১৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত ৩০টি বাঘকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু হয় ১৩টি বাঘের। ২০১০ সালে টাইগার সামিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৩টি বাঘসমৃদ্ধ দেশের সরকার প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। ওই সামিটে মূল বিষয় ছিল ২০২২ সালে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার। প্রতিটি দেশেকে বাঘ সংরক্ষণে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করার। কিন্তু ক্রিয়া-কর্ম কি সেদিকে? তবে, আশা জাগানিয়া পদক্ষেপ গরু-ছাগলে।
Advertisement
অব্যাহতভাবে দেশে গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়ার উৎপাদন বাড়ছে। এ কাজে বাড়ছে মানুষের আগ্রহও। কয়েক বছরে মাংসের দাম বেড়ে যাওয়ায় গবাদিপশু পালনে আগ্রহী খামারিরা। তরুণ শ্রেণির মধ্যে পশু খামার গড়ার ঝোঁক লক্ষ্য করার মতো। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষে দেশে গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৪৭ লাখ ৪৫ হাজারে, যা আগের বছরের চেয়ে ৩ লাখ ৮৮ হাজার বেশি। এর মধ্যে গরু ২ কোটি ৩৯ লাখ, মহিষ ১৪ লাখ ৭৮ হাজার, ছাগল ২ কোটি ৫৯ লাখ এবং ভেড়া ৩৪ লাখ। এ সংখ্যা প্রতিবছরই বাড়ছে। দেশে গরু পালনের গরজটি আসে ভারত সরকার সীমান্ত দিয়ে গরু ঢুকতে কড়াকড়ির জেরে। ২০১৪ সালে মে মাসে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর গরু পাচার রোধে সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। এর আগে আনুষ্ঠানিক হিসাবে দেশে বছরে ২০ লাখের মতো গরু ভারত থেকে আসত।
মানব বা মানুষও প্রাণি স্যোসাইটির অর্ন্তভুক্ত। এরপরও গুণ-মান, বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব বিবেচনায় মানবসম্পদ আর প্রাণিসম্পদে একটু তফাৎ করা হয়। গরু, ছাগল, ভেড়া, বাঘ-ভালুক, হাঁস-মোরগ পশু-প্রাণী সম্পদের আওতাভুক্ত। দেশ, সমাজ, সভ্যতা, উন্নয়নের জন্য প্রাণী সম্পদের গুরুত্বও কম নয়। প্রাণিসম্পদ গরহাজির থাকলে মানবকল্যাণে, মানব উন্নয়ন ও সেবা কল্পনা করাও কঠিন।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে নিকট অতীতের চেয়ে দুধের উৎপাদন ৩ গুণের বেশি। মাংস ৭ গুণের বেশি। আর ডিম উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৮ গুণ। সরকারের ভিশন-২০২১ টার্গেটে জনপ্রতি প্রতিদিন দুধ ১৫০ মিলিলিটার, মাংস ১১০ গ্রাম এবং বছরে ১০৪টি ডিমের চাহিদার অংক করা হয়েছে।
এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক হবে। গ্রামীণ কর্মশক্তির ২০ শতাংশ প্রাণিসম্পদ খাতে সম্পৃক্ত। ৪৪ শতাংশ আমিষ পাওয়া যাচ্ছে এ খাত থেকে। দেশকে মধ্যম আয় ও উন্নত দেশে পরিণত করতে হলে প্রথম দরকার মেধা। আর মেধার জন্য প্রাণিজ আমিষের বিকল্প এখন পর্যন্ত আবিস্কার হয়নি। তাই মেধাবী জাতি গঠনে এ খাতটির গুরুত্ব অস্বীকার বা অবহেলা করলে তা হবে সত্যের সঙ্গে অসত্যের লড়াই। সৃষ্টির সঙ্গে বখিলি। এসডিজির বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণের চেষ্টার সঙ্গে বেইমানি।
Advertisement
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচঅার/আরআইপি