মহাঢেউ নদীর এপার থেকেই লিঙ্কন দূরে দেখিয়ে দেয়, ঐ পাহাড়সারির শেষেই চান্দু ডিঙ্গা। দলের অন্য সদস্যদের সঙ্গে আলাপ সেরে রাখলাম, সময় পেলে উঁকি দেওয়া যাবে। পুরোটা পথ পায়ে হেঁটেই যাওয়া হবে। যাচ্ছি রামনাথপুরে আমাদেরই পরিচিত রেংচেংয়ের বাড়িতে। মূলত শিক্ষা পরিস্থিতি নিয়ে একটা তথ্যচিত্র বানাতে নেত্রকোণা জেলার কলমাকান্দা উপজেলায় গিয়েছিলাম গতবছর। রামনাথপুরে যাওয়া ঐ এলাকার আদিবাসীদের সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথা বলতে।
Advertisement
সকালে বড়ুয়াকোণায় লিঙ্কনের বাড়িতে ভরপেট নাস্তা করে হাঁটা দিলাম। ঝাঁ চকচকে রোদেলা সকাল, গতকালও তাই ছিল। তবে আগের কয়েকদিন বেশ বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তাঘাট বেহাল। তাই স্যান্ডেলের চেয়ে উন্মুক্ত পায়ে হাঁটাকে গুরুত্ব দিল দলের কেউ কেউ। মহাঢেউ এ এখন হাঁটু পানি। খুব সহজেই পারি দিলাম। বহুদিন পর, কারও কারও ক্ষেত্রে জীবনে প্রথমবার গ্রাম্য রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটায় সবাই জীবনের মানেগুলো একটু উল্টেপাল্টে দেখলো। পথে যেতে যেতে এলাকাবাসীর অদ্ভূত চাউনি যাত্রাকে দিলো অন্য মাত্রা।
কখনো কাঁচা রাস্তার মূল সড়ক, কখনো ধানক্ষেতের আলপথ, কাদায় পা ডুবে যাওয়া, জোঁকের ভয় (ডেনিকে দুটো জোঁক ধরেছিলো), সম্মিলিত কণ্ঠে গান, হাস্যরস। এ সবগুলোই প্রচণ্ড রোদ ও হাঁটার কষ্ট ভুলিয়ে দিচ্ছিলো। আমি অবশ্য ট্রেক করে অভ্যস্ত, লিঙ্কন ও অঙ্কনের বড় হওয়া গ্রামেই। যাই হোক, যেটুকু পথ পেরোলাম, ৪-৫ কিলোমিটার তো হবেই, তার নিকটবর্তী দূরেই দাঁড়িয়ে আছে চান্দু ডিঙ্গা। ঘড়ির দিকে তাকালাম। হাতে সময় কম, কেননা জনের বাড়িতে গিয়ে আবার বড়ুয়াকোণা ফিরতে হবে। সবাইকে দ্রুততম সময়ের ভেতর চান্দু ডিঙ্গা দেখার আহবান জানালাম।
চান্দু ডিঙ্গা পড়েছে চান্দু ডিঙ্গা গ্রামেই, নামানুসারেই গ্রাম। আসলে চান্দু ডিঙ্গার পাদদেশ বাংলাদেশে, চান্দু ডিঙ্গা ভারতের মেঘালয়ে। প্রতিদিন অনেক মানুষ এখানে বেড়াতে আসেন, পূজা-মানত করতে আসেন। আর মনসা পূজার সময় বেশ আড়ম্বর আঙ্গিক হয়। আমরা আগে শুধু শুনেছি, এবার নিজ চোখে দেখছি। মূলত চান্দু ডিঙ্গা, নৌকা থেকে নরম পাথরে পরিণত হয়েছে কালের বিবর্তনে, এটাই বিশ্বাস। ছোট একটি খাল পেরিয়ে চান্দু ডিঙ্গার পাদদেশে পৌঁছালে এর তত্ত্বাবধায়ক শুভ্র পোশাক, শুভ্র কেশ-শ্মশ্রু মণ্ডিত মধ্যবয়স্ক রফিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ। চান্দু ডিঙ্গার কাহিনী ধর্মীয় বিশ্বাস আর মিথ নির্ভর। মনসামঙ্গল কাব্যেও আছে এর বর্ণনা।
Advertisement
রফিক বলছিলেন, মনসা দেবী তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে নাকি এখানকার তত্ত্বাবধায়ক হতে বলেছেন। ভারত সরকার বহুবার চেষ্টা করেও এখান দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া দিতে পারেননি, নানারকম বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কারণটা হলো স্থানটা পবিত্র এবং মনসাদেবীর বেশ প্রভাব এখানে।
ডেনি চান্দু ডিঙ্গার শরীরে ইট দিয়ে আঁচড় কেটে বলছিলো, ওটা নরম, কেন জানি তার মিথটা বিশ্বাস হচ্ছে। চান্দু ডিঙ্গার গায়ে অসচেতন আবেগী পর্যটকদের লেখার দাগ। এ আর নতুন কী? আমরা যত্ন নিতে জানি না ও পারি না, ক্ষতি থেকেও রক্ষা করতে পারি না। হাতে সময় কম থাকায় দ্রুত ছবি টবি তুলে জনের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম। যাওয়ার পথে পিছন ফিরে বারবার দেখছিলাম চান্দু ডিঙ্গা।
কীভাবে যাবেনঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে রাতের বাসে গেলে সবচেয়ে ভালো। রয়্যাল ডিলাক্স, মামনিসহ কয়েকটি বাস আছে পাঁচগাঁও গামী। রাত ১১টায় ছাড়ে, পৌঁছায় ভোরে। ভাড়া সাড়ে ৩শ’, এসি বাস চলে না ঐ লাইনে। পাঁচগাঁও বাজারে নেমে অটোরিক্সায় চান্দুডিঙ্গা ৩০-৪০ টাকা নিবে জনপ্রতি, মোটরসাইকেলে ১০০ টাকা জনপ্রতি। খাওয়া বাজারেই সারতে পারবেন, খাবার মোটামুটি মানের।
কোথায় থাকবেনপাঁচগাঁও নেত্রকোণা জেলার কলমাকান্দা উপজেলায় অবস্থিত। থাকতে হবে কলমাকান্দায়। হোটেল আছে কয়েকটি, রুমভাড়া ২শ’-৩শ’ টাকা। উপজেলা ডাকবাংলো আছে, রুমভাড়া ১শ’ টাকা। সেক্ষেত্রে চান্দুডিঙ্গা দেখে মোটরবাইকে করে কলমাকান্দা পর্যন্ত জনপ্রতি ১৫০ টাকা নিবে, ২ জন উঠলে ১০০ করে। খাবার পাঁচগাঁও এবং কলমাকান্দায় সারা যাবে। মোটামুটি মানের খাবার। নদীর মাছ ও শুটকি খেতে ভুলবেন না।
Advertisement
কী কী দেখবেনচান্দুডিঙ্গা ছাড়াও মহাঢেউ নদী দর্শন এক অনন্য অভিজ্ঞতা। নদীতীরবর্তী ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা কয়েকটি গ্রাম, গ্রামের মানুষ বিশেষ করে গারো, হাজংদের জীবনধারা, গির্জা, এসব দেখা, কোনদিক দিয়েই বিফলে যাবে না ঐ অঞ্চলে ভ্রমণের। তবে বরাবরের মতোই স্থানীয় মানুষের মূল্যবোধকে শ্রদ্ধা করতে হবে, তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করতে হবে।
এএ/আরআইপি