বছর ঘুরে আবারো এসেছে ২৪ জানুয়ারি। ৪৯ বছর আগের এই দিনটি বাংলাদেশের জন্মের ঐতিহাসিক দিনপঞ্জির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক নয়া যুগসন্ধিক্ষণের সূচনা করেছিল। পদ্মা মেঘনা যমুনার সমস্ত জল এক মোহনায় মিলিত হয়েছিল। অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। সমুদ্রের জোয়ার বা নদীর প্লাবন যেভাবে সবকিছুকে খড়-কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে যায়, সেদিন বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জোয়ারে তৎকালীন লৌহমানব ফিল্ডমার্শাল আইয়ুব খানকে পদত্যাগে বাধ্য করে।
Advertisement
১৯৬৯ সালের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের পুলিশের গুলিতে শহীদ হন নবকুমার ইনস্টিটিউটের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর। মতিউরের শহীদ হওয়ার সংবাদ বাতাসের মতো ছড়িয়ে যায় সারাদেশে। দীর্ঘদিন যাবৎ পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বাংলার ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সূচিত হয় মহান গণঅভ্যুত্থানের। এর আগে ২০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ও ডাকসু আহুত বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন শেষে মিছিল বেরুলে, সেই মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) গ্রুপের নেতা আসাদুজ্জামান। আসাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। কবির ভাষায় সেই দিনের স্লোগান ছিল ‘আসাদের রক্তমাখা শার্ট জাতির পতাকা’।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর থেকেই দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের ওপর থেকে বাঙালির মোহ কেটে যেতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালি জাতির ওপর জাতিগত ও অর্থনৈতিক শোষণ চালিয়ে যেতে থাকে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের জাতির পিতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দিলে পূর্ব পাকিস্তানে বিক্ষোভ শুরু হয়। বাংলা ভাষাভাষী জনগণ পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও জিন্নাহর এই ঘোষণা তাৎক্ষণিকভাবে বাংলার ছাত্রসমাজ-শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীসহ সচেতন জনগোষ্ঠী প্রতিবাদে নেমে পড়ে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ‘বাংলা আমার মায়ের ভাষা’ বাঙালির আত্মমর্যাদার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়। ভাষা শহীদদের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠা করার জন্য পৃথিবীতে কোনো জাতিকে এভাবে বীরের রক্তে শোণিত হতে হয়নি। এরপর ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর গণরায় যথার্থভাবে প্রতিফলিত হয়নি।
Advertisement
১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করেন। পাকিস্তানের ইতিহাস ধর্মের লেবাসে পরিচালিত সামরিক শাসনের ইতিহাস। ১৯৬২ সালে শিক্ষার আন্দোলন, ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ বাঙালি জাতির মধ্যে এই উপলব্ধি এনে দেয় যে, পশ্চিমাদের হাতে বাঙালির নাগরিক অধিকার শিক্ষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, জাতিগত পরিচয় কোনোটাই নিরাপদ নয়। মহান ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আবদুল মতিন, গাজিউল হকসহ অনেকে সেই আন্দোলনে বাঙালিকে পথ দেখিয়েছিলেন।
কিন্তু বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্গে পশ্চিমা জাতিসত্তার যে বিরোধ, সেই বিরোধের মর্মকথা যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তার নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বিকশিত হতে থাকে। অন্য নেতারা শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে শোষিত জনগোষ্ঠীর মূল দ্বন্দ্বটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগকে পরিকল্পিতভাবে আন্দোলন সংগ্রামে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাচ্ছিল। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে গঠিত হয়েছিল ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’।
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন ঐতিহাসিক ৬ দফা। এই ৬ দফা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। ৬ দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ যৌথভাবে দেশব্যাপী আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবিতে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। এরই পাশাপাশি মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এক আপসহীন সংগ্রাম পরিচালনা করেন। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি, মোজাফ্ফর আহমেদের নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) স্বকীয় ধারায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শামিল হয়।
পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব প্রকট আকার লাভ করায় সব রাজনৈতিক দল রাজনৈতিকভাবে কাছাকাছি অবস্থানে আসে। ১৯৬৮ সালে নভেম্বরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন তীব্রতর রূপ লাভ করে। এই আন্দোলনে বাংলাদেশের শ্রমিক-কৃষক-পেশাজীবী জনতা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা মূলত ছিল বাঙালি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিচ্ছায়া।
Advertisement
১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ১১ দফার ভিত্তিতে গঠিত হয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ। ডাকসুও এই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ৬ দফা ও ছাত্রসমাজের ১১ দফার মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য ছিল না। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) ও ডাকসুর সমন্বয়ে এই প্লাটফর্ম গঠিত হয়। ডাকসু ও ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আসাদের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে শহীদ কিশোর মতিউরের আত্মদানের মধ্য দিয়ে সূচিত হয় মহান গণঅভ্যুত্থান ২৪ জানুয়ারি ১৯৬৯।
গণঅভ্যুত্থান দমন করতে ব্যর্থ হয়ে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে বাধ্য হন। কিন্তু তাতেও জনতার বাঁধভাঙা জোয়ার ঠেকানো যায়নি। এই গণঅভ্যুত্থানের পথ ধরেই মুক্ত হন কারাবন্দি আগরতলা মামলার (রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব) আসামি শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্যরা। এরপর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগে নিরঙ্কুশ বিজয়, পশ্চিমাদের ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহা ও ষড়যন্ত্র বাঙালি জাতিকে অনিবার্যভাবে এক দফা অর্থাৎ বাঙালি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে (স্বাধীনতার) কেন্দ্রীভূত হয়।
ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ডাকসুর সহসভাপতি তোফায়েল আহমেদ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ( বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। সেই দিন থেকে শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন ও ছাত্রসমাজের আপসহীন অবস্থান আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে যা থেকে পিছিয়ে আসার আর কোনো পথ কারো জন্য খোলা ছিল না। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে অগ্রগ্রামী অংশটি জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা ও জয়বাংলা বাহিনী গঠন করে স্বাধীনতার আন্দোলনকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুমোদন ক্রমেই এসব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। উল্লেখ্য, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে ডাকসু ও ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতারাই মূল ভূমিকা পালন করেন।
আজকের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ৬৯-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের চেতনায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে আমাদের বিস্মৃত হলে চলবে না যে, আমরা চেয়েছিলাম গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ। সমাজতন্ত্র কালের বিবর্তনে শোষণমুক্ত সমাজ এই কথার মধ্যে বিবর্তিত হলেও ধর্মনিরপেক্ষতার স্থলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাষ্ট্রের ধর্ম। এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টায় লিপ্ত কোনো কোনো মহল। জঙ্গিবাদী হামলার মদদদাতা একটি মহল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টির অপপ্রয়াসে লিপ্ত।
এই মহলটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকেও বানচাল করার চেষ্টা করেছে। এদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে আওয়ামী লীগসহ এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মধ্যে। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এদের অবস্থান। তাই আজ বাঙালির হৃদয়ে গণঅভ্যুত্থানের চেতনা নতুনভাবে প্রোথিত হওয়া প্রয়োজন। যা আগামী নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে আরও শাণিত করবে।
চলতি বছরের ডিসেম্বর নাগাদ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যা কিনা জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে পা দিয়েছে। কোনো সূচকেই বাংলাদেশ আজ পিছিয়ে নেই। নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবে রূপলাভ করছে। শিক্ষা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, নারীমুক্তি, সামাজিক ন্যায় বিচার, দারিদ্র বিমোচন, মুক্তিযোদ্ধের কল্যাণকর বাস্তবমুখী পদক্ষেপ, গ্রামীণ অবকাঠামো যুগোপযোগী করাসহ সমস্ত ক্ষেত্রে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। তবুও আমাদের বিপদের শেষ নাই।
অপ্রত্যাশিতভাবে আমাদের আশ্রয় দিতে হয়েছে দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে। মানবিক কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের আশ্রয় দিয়েছেন। কিন্তু তাদের দীর্ঘ মেয়াদী অবস্থান কাম্য নয়। গেল বছর অকাল বন্যা, বন্যা ফসল উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। আমাদের হাওড় জনপদের মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছে এই অকাল বন্যায়। তবুও বাঙালি মাথা নোয়াবার নয়। আমরা চাই সংবিধান অনুযায়ী আগামী নির্বাচন সকলের অংশ গ্রহণের মাধ্যমে (একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বাদে) একটি অবাদ সুষ্ঠু নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে উন্নয়ন করেছেন সেই উন্নয়নের হাত ধরে বঙ্গবন্ধুর প্রতীক, আওয়ামী লীগের প্রতীক, শেখ হাসিনার প্রতীক নৌকা বিজয়ী হবে। বাংলাদেশ পৌঁছে যাবে তার অভীষ্ট লক্ষ্য উন্নয়নের মহাসোপানে। বাঙালির অগ্রযাত্রা রুধিবে কে? এ সাধ্য কার? জয় হোক বাংলাদেশের।
লেখক : নব্বইয়ের গণ অভ্যূত্থানে নেতৃত্বদানকীর অন্যতম ছাত্রনেতা। বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা।
এইচআর/জেআইএম