খেলাধুলা

মিডল অর্ডারে দুর্বলতা যেন চাঁদের গায়ে কলঙ্ক!

কথায় বলে ‘চাঁদেরও নাকি কলঙ্ক আছে’। এটা মূলতঃ প্রবচন। যার ভাব হলো- এমন যে অনিন্দ্য সুন্দর চাঁদ, যার স্নিগ্ধ আলোয় বিশ্বভূবন হয় আলোকিত। সেই চাঁদের গায়েও দাগ আছে। এটা রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়। আসল অর্থ হলো, বিশ্বের তাবৎ সৌন্দর্য্যরে মাঝেও কিছু না কিছু দাগ থাকে।

Advertisement

এবারের ত্রিদেশীয় সিরিজে বাংলাদেশের পারফরমেন্সটাও ঠিক তেমনি। ওপরে তামিম-সাকিব রান করছেন নিয়মিত। বোলাররা ভাইটাল ব্রেক থ্রু এনে দেয়ার পাশাপাশি শতভাগ সফল; কিন্তু প্রয়োজনীয় মুহূর্তে চরম ব্যর্থ মিডল ও লেট অর্ডার ব্যাটিং।

আজ (মঙ্গলবার) জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই সে দূর্বলতা প্রকট হয়ে দেখা দিল। জিম্বাবুয়ের সাথে দু’বার আর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একবার মিলে তিন ম্যাচে মাশরাফি বাহিনীর পারফরমেন্স দারুণ। এক কথায় ব্যাট ও বলে টিম বাংলাদেশকে দুর্দমনীয়ই মনে হচ্ছে।

ওয়ানডে ক্রিকেটে যে জায়গাগুলোর সাফল্য দলগত সাফল্যের পূর্বশর্ত হিসেবে ভাবা হয়, তার সবকিছুই প্রায় হচ্ছে। ওপেনাররা রান করছেন। এক নম্বর ওপেনার তামিম ইকবালের ব্যাটে রানের নহর বইছে। একজন ওপেনারের পক্ষে যত ভাল খেলা সম্ভব, এখন পর্যন্ত তিন ম্যাচে তামিম তেমন ভালই খেলেছেন। প্রতি ম্যাচে বিগ ফিফটি; ৮৪+৮৪+৭৬। ১২২.০০ গড় আর ৮১, ৩৩ স্ট্রাইকরেটে ২৪৪ রান।

Advertisement

তিন নম্বরে প্রমোশন পাওয়া সাকিবের ব্যাটেও রানের ফলগুধারা বইছে। প্রথমদিন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৩৭ রানে আউট হওয়া সাকিব পরের দুই ম্যাচে ঠিকই পঞ্চাশের ঘরে পৌঁছে গেছেন। আজও তার ব্যাট থেকে বেরিয়ে এসেছে ৫১ রান। আগের ম্যাচে সাকিব করেছিলেন ৬৭। ৫১.৬৬ গড় আর ৮২.০১ স্ট্রাইকরেটে তিন ম্যাচে সাকিবের রান ১৫৫।

প্রায় তিন বছর পর সুযোগ পাওয়া এনামুল হক বিজয় (১) আজ সুবিধা করতে না পারলেও আগের দুই ম্যাচে যথাক্রমে ১৯ ও ৩৫ রানের দুটি ইনিংস খেলেছেন। যার প্রথমটির স্ট্রাইকরেট ছিল ১৩৫.৭১। আর পরেরটির স্ট্রাইকরেট ৯৪.৫৯।

লক্ষ্য কম ছিল (১৭১), তাই চার নম্বর মুশফিক প্রথম ম্যাচে খুব অল্প সময় মাত্র ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন। পরের ম্যাচে সুযোগ পেয়েই জ্বলে ওঠা এবং ঠিক ফিফটি (৬২) করে ফেললেন তিনি। আজ তেমন সুবিধা হয়নি। তারপরও তিন ম্যাচে ৪৭.০০ গড় আর ৯৪.০০ স্ট্রাইকরেটে মুশফিকের রান ৯৪।

অন্যদিকে বোলারদের বৃহস্পতি তুঙ্গে। গড়পড়তা সবাই ভাল করছেন। কেউ কোন ম্যাচে ৫ উইকেটের পতন ঘটাতে পারেননি সত্য; কিন্তু সব বোলার সাধ্যমত চেষ্টা করছেন। নিজের সামর্থ্যরে সবটুকু উজাড় করে দিয়ে সমীহ আদায়ের পাশাপাশি সাফল্যও তুলে নিচ্ছেন।

Advertisement

তারপরও বোলারদের সাফল্যের মিছিলের অগ্রভাগে সাকিব। তিন ম্যাচের প্রতিটিতেই ৩টি করে উইকেট দখল করে সবার ওপওে তিনি। এ ছাড়া আরেক বাঁ-হাতি স্পিনার সানজামুলও দুই ম্যাচে পতন ঘটিয়েছেন তিন উইকেটের।

পেসারদের মধ্যে অধিনায়ক মাশরাফি, বাঁ-হাতি মোস্তাফিজ আর রুবেল হোসেন সবাই ভাল লাইন ও লেন্থে বল ফেলে উইকেট পাচ্ছেন নিয়মিতই। তিন পেসারই সমান ৫ উইকেট করে দখল করেছেন।

আজ আরও একটি ভাল দিক উন্মোচিত হলো। তামিম (৭৬) আর সাকিব (৫১) দ্বিতীয় উইকেটে ১০৬ রান যোগ করার পরও বড় ধরনের মড়ক লেগে বসল। এক সময় মনে হচ্ছিল, স্কোর ১৭০-১৮০‘র মধ্যেই আটকে যাবে।

১৪৭ রানে তৃতীয় উইকেট পতনের পর ২৩ রানে ৬জন আউট হবার পর সে সম্ভাবনাই দেখা দিয়েছিল; কিন্তু নয় নম্বর ব্যাটসম্যান সানজামুল ইসলাম নয়ন আর ১০ নম্বরে ক্রিজে যাওয়া রুবেল হোসেনের দৃঢ়তায় শেষ দুই উইকেটে যুক্ত হয় ৪৬ রান।

যাতে বাঁ-হাতি স্পিনার সানজামুল ইসলাম নয়নের সংগ্রহ ছিল ২৪ বলে ১৯। আর বাঁ-হাতি পেসার মোস্তাফিজ নট আউট থাকেন ২২ বলে ১৮ রান করে। তাদের দৃঢ়তায় স্কোর গিয়ে ঠেকে ২১৬’তে।

শেষ পর্যন্ত ৯১ রানের বড় জয় ধরা দিয়েছে, তবে সেটা অবশ্যই বোলারদের সাঁড়াসি ও কার্যকর বোলিংয়ের কারণে; কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, শেষ দিকে সানজামুল-রুবেল মাথা তুলে না দাঁড়ালে ফল অন্যরকম না হলেও জয় এত বড় ও সহজ হতো না।

সব মিলে মনে হচ্ছে টাইগারদের বৃহস্পতি তুঙ্গে। কোন ফাঁক-ফোকর নেই। সত্যিই কি তাই? কোনই দূর্বলতা, ঘাটতি বা শূন্যতা নেই বাংলাদেশ দলে? নিশ্চয়ই আছে। সেটা আজকের ম্যাচেই যা দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়েছে। উইকেট স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল ব্যাটিংয়ের জন্য আদর্শ ছিল না। তারপরও এই উইকেটে তামিম ও সাকিব বড় ইনিংস খেলেছেন। শেষ দিকে সানজামুল আর রুবেলও ইচ্ছেমত হাত খুলে ব্যাট করেছেন।

কিন্তু পারেননি মিডল অর্ডাররা। মুশফিক (১৮) দু’অংকে পৌঁছালেও মাহমুদউল্লাহ (২), সাব্বির (৬) ও নাসির (২) কিছুই করতে পারেননি । তিনজনই আউট হয়েছেন উইকেটের গতি-প্রকৃতি না বুঝে শটস খেলতে গিয়ে।

উইকেটে বল থেমে আসছিল, এটা দেখে-বুঝেও অভিজ্ঞ মুশফিক গেলেন স্লগ সুইপ খেলতে। যা হবার তাই হলো। প্রত্যাশার চেয়ে দেরিতে আসা বল গিয়ে লাগলো ব্যাটের ওপরের দিকে। মিস টাইমে আকাশে ক্যাচ। এরপর জিম্বাবুইয়ান লেগস্পিনার ক্রেমারের গুগলিতে লেগবিফোর উইকেটের ফাঁদে মাহমুদউল্লাহ। অফস্ট্যাম্পের ঠিক বাইরে থেকে ভিতরে আসা বলকে ফরোয়ার্ড ডিফেন্স করতে গিয়ে ব্যাটে আনতে না পেরে আউট তিনি।

খালি চোখে মনে হচ্ছে জিম্বাবুইয়ান ফিল্ডার আরভিনের দুর্দান্ত ক্যাচের শিকার সাব্বির। সত্যিই পেসার জার্ভিসের বলে পুল খেলতে গিয়ে শর্ট মিড উইকেটে আরভিনের অসাধারণ ক্যাচে সাজঘরে ফেরেন সাব্বির; কিন্তু স্লো উইকেটে বল যে তার ভাবনার চেয়ে দেরিতে এসেছিল!

আর সবচেয়ে দৃষ্টিকটু ছিল নাসিরের আউট। অযথা অফ স্ট্যাস্পের বাইরে বলে ব্যাট পেতে উইকেটের পিছনে ক্যাচ দিয়ে ফিরেছেন তিনি। অধিনায়ক মাশরাফিও এদিন সুবিধা করতে পারেননি। বিপিএলে অনেক বাঘা বাঘা বোলারের বিপক্ষে সাহস ও আস্থায় ব্যাট করলেও আজ দলের প্রয়োজনে ব্যাট হাতে ভুমিকা রাখতে পারেননি তিনি।

লেগস্পিনার ক্রেমারের আদর্শ লেগ ব্রেকে ব্যাট সরাতে গিয়েও সরাতে না পেরে কট বিহাইন্ড টাইগার অধিনায়ক। বল তার ব্যাট ফাঁকি দিয়ে পিছনে চলে যাবার আগে যে গ্লাভস ও ব্যাটের ওপরের অংশ ছুঁয়ে গেছে তা নিশ্চিত ছিলেন না মাশরাফি। রিভিউ নিয়েওছিলেন; কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। মোট কথা, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ, সাব্বির, নাসির ও মাশরাফি- ব্যর্থতার মিছিল করেছেন।

তাদের মানে- মিডল ও লেট অর্ডারের রান করতে না পারা এ সিরিজে এখন পর্যন্ত টিম বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দূর্বলতা বলেই পরিগণিত হচ্ছে। আজ হয়ত দুই বোলার সানজামুল আর মোস্তাফিজ মিলে শেষ ৪৬ বলে ৪৬ রান তুলে স্কোরবোর্ডটাকে একটা পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছেন।

অন্যদিন তা নাও হতে পারে। ফাইনালের আগে মিডল ও লেট অর্ডারের দূর্বলতা কাটিয়ে উঠতেই হবে। প্রতিদিন তো আর তামিম বিগ ফিফটি হাঁকাবেন না। সাকিবও পরপর বড় ইনিংস খেলতে পারবেন না। কাজেই মিডল অর্ডারে অন্তত দুজনার ব্যাটে লম্বা ইনিংস দরকার। এমন কাঁচ-ভঙ্গুর মিডল অর্ডার নিয়ে শেষ হাসি হাসা যাবে না।

এআরবি/আইএইচএস/এমএস