বলা হয়, ‘যত গর্জে তত বর্ষে না’। বাংলা প্রবাদবাক্যটি কী সত্যি সত্যি মিলে গেলো শ্রীলঙ্কার সঙ্গে! যদিও ত্রিদেশীয় সিরিজ কিংবা বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচের আগে লঙ্কানরা নিজেরা এতটা গর্জেনি। যা গর্জন হয়েছে ফেসবুকারদের মধ্যে। সোশ্যাল মিডিয়ায়। সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীর মধ্যে। সবার মধ্যেই এক ধরনের শঙ্কা কাজ করছিল, হাথুরুসিংহে না আবার ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ হয়ে যান। কল্পনার রাজ্যে তাকে ‘ফ্রাঙ্কেস্টাইনে’র রূপ দিয়ে নিজেদের মধ্যেই স্নায়ুর উত্তেজনা তৈরি করেছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকরা।
Advertisement
তবে যত যাই হোক, হাথুরুর ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া শ্রীলঙ্কাকেই দেখতে চেয়েছিল সবাই। সবারই ধারণা ছিল, এই শ্রীলঙ্কা হয়তো বা কিছুটা হলেও বদলে যাবে; কিন্তু বাংলাদেশের বিপক্ষে দেখা গেলো ক্রমশ তলানীতে নামতে থাকা শ্রীলঙ্কাকেই। কোথায় বদলে যাওয়া লঙ্কানদের ‘প্রতিরোধ’, বরং উল্টো দেখা গেলো অসহায় আত্মসমর্পন করা একটি দলকে।
যদিও মাত্র কয়েকদিনে একটি দলের খোলনলচে একেবারে পাল্টে দেয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের দায়িত্ব যখন হাথুরুসিংহে নিয়েছিলেন, তখন এই দলটি আফগানিস্তানের কাছেও হারছিল। টানা হারতে থাকা দলটির দায়িত্ব নেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সাফল্য উপহার দিতে পারেননি তিনি। সাফল্য এসেছে তার দায়িত্ব নেয়ার ৫-৬ মাস পর।
জিম্বাবুয়ের কাছে শ্রীলঙ্কা মাত্র ১২ রানে হেরেছিল। জিম্বাবুয়ে করেছিল ২৯০ রান। জবাবে শ্রীলঙ্কা ভালোই লড়াই করেছে। গিয়েছিল ২৭৮ রান পর্যন্ত। বোলাররা ভালো করতে পারলে ওইদিন হয়তো জিম্বাবুইয়ানদের কাছে হারতে হতো না লঙ্কানদের। এরই মধ্যে লঙ্কান দলের মানসিকা ভেঙে গিয়েছে মূলতঃ অধিনায়ক অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউজের ইনজুরি। দুই ম্যাচ খেলতে পারছেন না তিনি ইনজুরির কারণে।
Advertisement
তবুও লঙ্কান এই দলটির মধ্যে তো প্রতিভার অভাব নেই। দারুণ লড়াই করার মানসিকতাও আছে। সবাই ভেবেছিল এই মানসিকতাই হয়তো হাথুরুসিংহে উসকে দিতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশের সামনে দেখা গেলো শ্রীলঙ্কা এবং হাথুরু- পুরোপুরিই কাগুজে বাঘ। যার কোনো নখ-দন্ত নেই।
টস জিতে ব্যাট করতে নামা বাংলাদেশ শুরু থেকেই সাবধানি এবং সতর্ক। একটাই কারণ, এই বাংলাদেশের হাঁড়ির খবর তো জানেন হাথুরুসিংহে (!)। তামিম আর বিজয়ের সেই সাবধানী জুটিতেই দারুণ সূচনা পেয়ে গেলো বাংলাদেশ। জুজুর ভয়টাও বুঝি কেটে গেলো তখন! ৩৫ রান করে বিজয় ফিরে গেলেও তামিম আর সাকিব জুটি বাংলাদেশকে শক্ত অবস্থানে নিয়ে যায়।
দু’জন ৯৯ রানের জুটি গড়ার পর ব্যক্তিগত ৮৪ রান করে তামিম ফিরে যান। এরপর সাকিবও পৌঁছান হাফ সেঞ্চুরির মাইলফলকে। তিনি ৬৭ রান করে আউট হন। এরপর হাফ সেঞ্চুরি উঠে এলো মুশফিকের ব্যাটেও। তিনি করলেন ৬২ রান। এই তিন-চারটি ইনিংসেই বাংলাদেশের স্কোর চলে যায় শ্রীলঙ্কার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
শেষ দিকে ব্যাট হাতে ঝড় তুললেন সাব্বির রহমান। শেষ ওভারে তো নিলেন ১৯ রান। সব মিলিয়ে লঙ্কানদের সামনে দাঁড়িয়ে গেলো ৩২০ রানের পাহাড় সমান স্কোর।
Advertisement
ওয়ানডেতে বর্তমান সময়ে যদিও এই স্কোর খুব বড় কিছু নয়; কিন্তু বাংলাদেশের চার পেসার আর দুই স্পিনারের সামনে এই রান তাড়া করে জেতার কল্পনা শুধু ‘অলীক কল্পনা’ই হতো। তবুও শ্রীলঙ্কার হাতে ব্যাটসম্যানের অভাব নেই। লড়াইটাতো অন্তত করতে পারে তারা! কিন্তু বাঁ-হাতি দুই ওপেনার কুশল পেরেরা এবং উপুল থারাঙ্গার বিপক্ষে অফ স্পিনার নাসিরকে দিয়েই আক্রমণ শুরু করলেন মাশরাফি।
এই কৌশল বেশ কাজ দিলো। তৃতীয় ওভারে এসেই সাফল্য পেয়ে গেলেন নাসির। ব্রেক থ্রু এনে দিলেন তিনি পেরেরাকে বোল্ড করে। থারাঙ্গা আর কুশল মেন্ডিসকে নিজেই ফিরিয়ে দিলেন মাশরাফি। নিরোশান ডিকভেলাকে যেভাবে বোল্ড করে ফিরিয়ে দিলেন মোস্তাফিজ, তাতে তার শুরুর দিকের কথাই মনে হচ্ছিল বারবার। এভাবে যে বহুদিন কোনো ব্যাটসম্যানকে স্ট্যাম্প উড়িয়ে দিতে দেখা যায় না!
ভাগ্য আরও বেশি খারাপ হলো লঙ্কানদের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক দিনেশ চান্দিমাল হলেন রানআউট। তখন তার রান ছিল ২৮। অ্যাশেলা গুনারত্নে, থিসারা পেরেরা এবং ওয়ানিদু হাসারাঙ্গাকে ফেরালেন সাকিব। থিসারা পেরেরা হঠাৎ মারমুখি হয়ে উঠেছিলেন; কিন্তু দারুণ বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সাকিব আউট করলেন তাকে। সুরঙ্গা লাকমালকে বোল্ড করলেন রুবেল হোসেন। অথ্যাৎ বাংলাদেশের পুরো বোলিং ফোর্সই খড়গহস্ত হলেন লঙ্কানদের ওপর।
যার ফলশ্রুতিতে ১৫৭ রানেই অলআউট হয়ে গেলো শ্রীলঙ্কা। ১৬৩ রানের বিশাল জয় পেয়ে গেলো বাংলাদেশ। নিজেদের ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জয়টিও একই সঙ্গে পেয়ে গেলো বাংলাদেশ। এর আগে ১৬০ রানের সবচেয়ে বড় জয়টি ছিল খুলনায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে, ২০১২ সালে।
একসময় যে লঙ্কানদের সামনে হাঁটু কাঁপতো বাংলাদেশের, লঙ্কান পেসার চামিন্দা ভাস কিংবা স্পিনার মুত্তিয়া মুরালিধরনরা বলে-কয়ে উইকেট নিতেন- সেই শ্রীলঙ্কা এখন চলে গেলো পুরনো সেই বাংলাদেশের জায়গায়। আর বাংলাদেশ ধীরে ধীরে সেই শ্রীলঙ্কার জায়গাটাই দখল করতে যাচ্ছে।
আইএইচএস/পিআর