স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার পর বেশ কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে বাংলাদেশকে। এর মধ্যে বড় আকারে দুই ধরনের ঝুঁকি রয়েছে।
Advertisement
বৃহস্পতিবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের (বিডিএফ) বৈঠকে এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন গবেষণার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
বহুজাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংকের মতে, দুটি বড় ঝুঁকির একটি হলো স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ বর্হিবিশ্ব থেকে এখন যতটা সহজ শর্তে ঋণ পায়, উন্নয়নশীল দেশ হয়ে গেলে সেটি পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ার সুবাধে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কানাডার বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা (জিএসপি) পাওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি হবে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) আয়োজিত বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের বৈঠকের শেষ দিন বৃহস্পতিবার মোট চারটি কর্ম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। তার মধ্যে একটি ছিল ‘এলডিসি থেকে উত্তরণ: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’। সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব কাজী শফিকুল আযম ও বাণিজ্য সচিব শুভাশিষ বসু।
Advertisement
প্রতিবেদনে ড. জাহিদ উল্লেখ করেন, জাপান, চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশ সরাসরি (অফিসিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স-ওডিএ) যেসব ঋণ পায়, উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেলে সেসব ঋণের শর্ত কঠিন হয়ে যাবে। স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ এখন রফতানিতে বিশেষ ভর্তুকি দিয়ে থাকে। যা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডাব্লিউটিও) আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। উন্নয়নশীল দেশে গেলে রফতানিতে বিশেষ ভর্তুকি দেয়ার সুযোগ থাকবে না। স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশ উন্নত বিশ্ব থেকে অনুদান পেয়ে থাকে। উন্নয়নশীল দেশ হয়ে গেলে সে অর্থায়নও বন্ধ হবে। দরিদ্র দেশ হওয়ায় জাতিসংঘকে কম চাঁদা দিতে হয় বাংলাদেশকে। উন্নয়নশীল দেশ হলেচাঁদা দেয়ার হার দিগুণ হবে। এছাড়া জাতিসংঘের বিভিন্ন সভায় অংশগ্রহণ করতে সরকারি প্রতিনিধি দল বিনা পয়সায় যাওয়ার যে সুযোগ পেয়ে থাকে, সেটিও বন্ধ হবে।
প্রবন্ধে ড. জাহিদ বলেন, বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হোক- এটা সবার চাওয়া। কিন্তু এলডিসি থেকে বের হলে কী ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে, তার কোনো উদাহরণ ও অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের সামনে নেই। শুধু অনুমান করতে পারি।
১৯৯১ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত সময়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়া পাঁচটি দেশের উদাহরণ দিয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বতসোয়ানা, মালদ্বীপ, সামোয়া, গিনি ও কেপভার্দে- এই পাঁচটি দেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে গেছে। এসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করলে ভুল হবে। কারণ, পাঁচটি দেশের জনসংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। দুই থেকে তিন কোটি। আমাদের শুধু ঢাকা শহরেই দুই কোটি মানুষের বসবাস।
ড. জাহিদ মনে করেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ হলেই যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়বে, এমন ধারণা করা ঠিক হবে না। তার মতে, এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণা পরিবর্তন আসবে। কিন্তু এফডিআই বাড়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব কাজ করবে না। কারণ, এফডিআই বাড়ার ক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিবেশ, নীতি কৌশল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, অবকাঠামো প্রাকৃতিক সম্পদ- এসব কিছুর নির্ভর করে। এছাড়া উন্নয়নশীল দেশ হলেই প্রবাস আয় বেড়ে যাবে এমন ধারণাও ঠিক নয়। কারণ, প্রবাস আয় বাড়ার ক্ষেত্রে এলডিসিস্ট্যাটাস নির্ভর করে না। নির্ভর করে রেমিটেন্স পাঠানোর সুযোগ সুবিধা, নিরাপত্তা, প্রবৃদ্ধি ও আয়- এসব বিষয়ের ওপর। উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেলে রফতানিতে অতিরিক্ত সাত শতাংশ ট্যারিফ চার্জ দিতে হবে। এতে করে বাংলাদেশের রফতানি সাড়ে পাঁচ শতাংশ থেকে সাড়ে সাত শতাংশ কমে যাবে। ডলারে হিসেব করলে তা ১৫০ কোটি ডলার থেকে ২২০ কোটি ডলার।
Advertisement
তবে উন্নয়নশীল দেশে গেলে এসব সুবিধা বাংলাদেশ যাতে না হারায়, সেজন্য বিকল্প কিছু প্রস্তাবও দিয়েছেন তিনি। তার মতে, বিশ্বের অনেক দেশ আছে যারা এলডিসিভুক্ত দেশ না হয়েও এলডিসির সুবিধা পেয়ে থাকে। আবার অনেক দেশ আছে যারা এলডিসিভুক্ত দেশ হয়েও সুবিধা পায় না। বাংলাদেশ যখন এলডিসি থেকে বের হবে, তখন উন্নত বিশ্ব বাংলাদেশের কাছে আসবে এসব সুবিধা বাতিলের বিষয়ে কথা বলতে। তখন তাদেরকে বোঝাতে হবে, ঋণের শর্ত কঠিন করলে, জিএসপি বাতিল করলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়বে। মানুষ আবার দারিদ্রসীমার নিচে নেমে আসবে। তাদেরকে বোঝাতে পারলে তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ উন্নত বিশ্ব সুবিধা বহাল রাখতে পারে।
এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে বাংলাদেশ কী কী সুবিধা পাবে সে বিষয়ে ড. জাহিদের মত, আত্মবিশ্বাস বাড়বে দেশের। সম্মান বাড়বে। ভিয়েতনামের মতো অনেক দেশের সঙ্গে এফটিএ করতে পারবে। জিএসপি প্লাস সুবিধাও পেতে পারে।
বিডিএফ বৈঠক শেষে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এলডিসি থেকে উত্তরণে ঝুঁকির বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
তবে ইআরডি সচিব কাজী শফিকুল আযম বলেন, এলডিসে থেকে উত্তরণে আমরা প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করেছি। ইতোমধ্যে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে বাংলাদেশ কোথায় কোথায় সমস্যায় পড়বে, সেসব বিষয়ে কাজ করবে টাস্কফোর্স।
এমএ/বিএ