মতামত

তারানা হালিম, আপনি বামনের দেশে অতিকায় মানবিকতায়

সুযোগ থাকলেও সব মানুষ, মানুষের পাশে দাঁড়ায় না। নিজের কথা ভাবে, অন্যের কথা ভাবে না। ভাবে, কী লাভ ভেবে অন্যের কথা? মানুষ মানুষের জন্য- তাত্ত্বিকভাবে শুনতে ভালো লাগবেও, বাস্তবতার চিত্র ভিন্ন কথা বলে। মানুষের পাশে দাঁড়ায় তারা, আসলে যারা সত্যিকার মানুষ। মানুষের মতো মানুষ।

Advertisement

প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, পূর্ণিমা শীলের পাশে দাঁড়িয়েছেন। পূর্ণিমা শীলকে তিনি কোন দান দক্ষিণা করেননি, অনুদান দেননি। যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি দিয়েছেন, কাজের সুযোগ করে দিয়েছেন। দিয়েছেন উপাজর্নেরও সুযোগ করে। পূর্ণিমা শীলকে সম্মান করেছেন প্রতিমন্ত্রী তারানা। স্যালুট, তারানা হালিম। আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। মনে হতে পারে তারানা হালিম একজন পূর্ণিমা শীলকে চাকরি দিয়েছেন, কাজের সুযোগ করে দিয়েছেন মাত্র। তা নয় কিন্তু। ঘটনাটি অতো ছোট নয়, আরও বড়, আরও মহৎ, আরও মহান। একজন তারানা হালিম, পূর্ণিমা শীলদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। অসংখ্য পূর্ণিমা শীলদের জন্য তারানা হালিম এখন একটি অনুপ্রেরণার উদাহরণ।

পূর্ণিমা আমাদের অনেকের স্মৃতিতেই নেই, ভুলে গেছি আমরা। ১৪ বছরের একটি মেয়ে পূর্ণিমা শীল। উল্লাপাড়া হামিদা পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী। ২০০১ সাল। ১ অক্টোবর। ভোটের দিন, উল্লাপাড়া পূর্ব দেলুয়া উচ্চ বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে মহিলা এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ হয়েছিল পূর্ণিমার। বিএনপি প্রার্থী এম আকবর আলীর কর্মী ও সমর্থকেরা ভোট যখন চলছিল তখনই জোর করে কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালট পেপার নিয়ে ধানের শীর্ষে সিল দেয়ার চেষ্টা করছিল।

বাধ সেধেছিল, প্রতিবাদ করেছিল এ অন্যায়ের- পূর্ণিমা। প্রতিপক্ষের সঙ্গে বচসাও বেধেছিল পূর্ণিমার। উপজেলা নির্বাচন অফিস আর প্রশাসনকেও সাহস করে জানিয়েছিল সে। এই সাহস, সততা আর প্রতিবাদই মেনে নিতে পারেনি, বিএনপি দলীয় সন্ত্রাসীরা। আকস্মিক হামলা চালিয়েছিল পূর্ণিমাদের বাড়িতে। আক্রমণকারীরা পূর্ণিমার বাবা-মা, ভাই-বোনদের বিনা কারণে বেধড়ক পেটায়। তার মায়ের হাত ভেঙে দেয়। তুলে নিয়ে যায় পূর্ণিমাকেও। পূর্ণিমার মা বাসনা রানীর পাথর ভাঙা আর্তনাদে সেদিন সন্ত্রাসীদের মনে কোন মায়া বা করুণার সামান্যতমও ছায়াসম্পাত ঘটেনি। মায়ের আর্তনাদ শুন্য আকাশে মেলায়।

Advertisement

এদেশে খুব সহজেই যাদের উপর নির্যাতন করা যায়, তারা সংখ্যালঘু। সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করতে কোনও ‘কারণ’ প্রয়োজন হয় না। তাদের ভিন্ন জাতের, ভিন্ন সম্প্রদায়ের মনে করা হয়। তা নয়তো মানুষে মানুষে এত বিভেদ কেন, মানুষ মানুষের উপর কিসের আধিপত্য, আক্রমণ? ‘উদারতা’, ‘মানবিকতা’ এসব শব্দ বলতে ভালো লাগে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বিশ্বাস করি ক’জন?

যে সমাজে বাস করি তা বড় কদর্য, বিকৃতিতে ঠাসা। ভাণ, ভণিতায় ভরপুর। মৌলিকতার চেয়ে লৌকিকতা বেশি। নেতার চেয়ে অভিনেতা বেশি। পোশাকের ভেতর, খোলসের ভেতর, মুখোশের ভেতর আমাদের বসবাস। ব্যথিত হই না, ব্যথার ভান করি। আহা, উহ্ করি লোক দেখাই। আর নির্যাতিত নারী? তাকে তো ভেতরে ভেতরে দলগতভাবে, সমবেতভাবে আবারও নির্যাতনের সুযোগ খুঁজে বেড়াই। তা নয় তো পূর্ণিমা শীলের নামে ফেইক ফেসবুক আইডি কেন খুলেছিলাম আমরা? পাশে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, নিষ্ক্রিয় থাকতে সুবিধা ও সাচ্ছন্দ্যবোধ করি। দর্শক হতে ভালোবাসি। ঝামেলা এড়াই, দায় এড়াই।

তারানা হালিম আমাদের অনেকের মতো দায় এড়াননি, দায়িত্ব নিয়েছেন। সচিবালয়ে তার ব্যক্তিগত অফিসার পদে নিয়োগ দিয়েছেন পূর্ণিমা শীলকে। নিজের ফেসবুক পেইজে লিখেছেন, পূর্ণিমা তোমাকে আমরা ভুলে যাইনি। জীবনের অন্ধকার রূপ তুমি দেখেছো, আলোর জগতে তোমায় স্বাগতম... শুরু হোক পথ চলা।

জীবন এমনই। থেমে থাকার নয়, এগিয়ে যাওয়ার। মানুষ হারতে হারতে জিতে যায়। জীবন কখনও হারে না। যারা পূর্ণিমাকে যৌন নির্যাতন, নিপীড়ন করেছিল, লজ্জা তাদের। আজ হেরে গেছে তারা, সেই দুর্বৃত্তরা। সেই সব সাম্প্রদায়িক মানুষেরা, যৌন নিপীড়কেরা, ধর্ষকেরা।পূর্ণিমা আপনি আলোকিত মানুষ। সৎ, মেধাবী, যোগ্য মানুষ। আর তারানা হালিম নিশ্চিতই বামনের দেশে অতিকায় উদারতা ও মানবিকতায়।

Advertisement

অভিনন্দন পূর্ণিমা, আবারও স্যালুট তারানা হালিম।

লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।

এইচআর/পিআর