দেশজুড়ে

যশোরে ২৩শ’ গাছ কাটার সিদ্ধান্ত বহাল

যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের দু’পাশের শতবর্ষী গাছগুলোকে কেটে সড়ক বর্ধিতকরণের সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ দেশজুড়ে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রায় দু’শ বছরের পুরনো তিন শতাধিক রেইনট্রিসহ এ মহাসড়কের দু’পাশের প্রায় ২৩শ’ গাছ কেটে ফেলা হবে।

Advertisement

১৮৪২ সালে এ রেইনট্রি গাছগুলো লাগিয়েছিলেন যশোরের তৎকালীন জমিদার কালী পোদ্দার। যা এ মহাসড়কে ছায়া দেয়ার পাশাপাশি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

কর্তৃপক্ষ বলছে, গাছগুলোকে রেখে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযুক্তকারী এ আন্তর্জাতিক মহাসড়কটির প্রশস্তকরণ অসম্ভব। গত ৬ জানুয়ারি এ গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ‘যশোর রোড’র দু’ধারের প্রায় দু’শ বছরের প্রাচীন গাছগুলো কালের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। মহাসড়কটি পুনঃনির্মাণসহ সম্প্রসারণ করতে প্রাচীন এ গাছগুলো কাটার তোড়জোড় শুরু হয় গত বছরের মার্চে। কিন্তু গাছগুলো রাখার জোর দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। এরই প্রেক্ষিতে ওই বছরের জুলাই মাসে গাছগুলো বাঁচিয়ে রেখে মহাসড়কটি পুনঃনির্মাণের ঘোষণা দেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। কিন্তু সড়ক বিভাগের বিশেষজ্ঞরা গাছ রেখে রাস্তা প্রশস্তকরণ সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিলে পূর্বের ঘোষণা থেকে সরে আসে কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ গত ৬ জানুয়ারি যশোরে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের উচ্চপর্যায়ের একসভায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয় গাছগুলো কেটে ফেলার। সভায় উপস্থিত স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ অন্যান্য জনপ্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও মতো দেন গাছ কাটার পক্ষে।

সভায় জানানো হয়, মহাসড়কটি সম্প্রসারণের জন্য ইতোমধ্যে টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। শিগগিরই এ কাজ শুরু হবে। কিন্তু মহাসড়কটির দুই পাশে শতবর্ষী রেইন্ট্রি গাছ রয়েছে। সেগুলো রেখে মহাসড়ক সম্প্রসারণ করা সম্ভব না। সে কারণে জনস্বার্থে গাছ কাটতে হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পৌনে দু’শ বছরের পুরনো তিন শতাধিক রেইনট্রিসহ এ মহাসড়কের দু’পাশের প্রায় ২৩শ’ গাছ কেটে ফেলা হবে।

Advertisement

এ প্রসঙ্গে যশোরের জেলা প্রশাসক মো. আশরাফ উদ্দিন জানান, দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোলের সঙ্গে সংযুক্ত যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক দেশের ব্যস্ততম ও গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কের একটি। প্রতিদিনই এ মহাসড়কে পণ্যবাহী যান ও যাত্রীবাহী পরিবহনের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু সড়ক সংকীর্ণ হওয়ায় স্বাভাবিক যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। ইতোমধ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষ বেনাপোল বন্দর সম্প্রসারণের জন্য একটি প্রকল্প নিয়েছে। পাশাপাশি যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের পাশে দুই অর্থনেতিক অঞ্চল করার প্রস্তাবনা রয়েছে। সবমিলিয়ে এ মহাসড়ক সম্প্রসারণের কোনো বিকল্প নেই। আর এ মহাসড়কের পাশে যে পুরনো গাছগুলো রয়েছে এর অনেকগুলোই মরে গেছে, কিছু উপড়েপড়ে আছে। আর অনেকগুলোর ভেতরে নষ্ট হয়ে এর ‘উড ভেল্যু’ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন বৃহত্তর উন্নয়নের স্বার্থে এ গাছগুলো কাটা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।

ওই সভায় থাকা যশোর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল জানান, গাছগুলোর মালিকানা জেলা পরিষদের। জেলার বৃহত্তর উন্নয়নের স্বার্থে তারা গাছগুলো কেটে ফেলার সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত। তবে মহাসড়ক সম্প্রসারণের পর সড়কের দু’পাশে নতুন করে গাছ লাগিয়ে বনায়ন করারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এদিকে, গেল ৩১ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যশোরে জনসভা থেকে যশোর-বেনাপোল রাস্তার কাজ উদ্বোধন করেন। ৩২৮ কোটি ৯২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা ব্যয়ে রাস্তার কাজ দ্রুত শুরু হবে। কিন্তু গাছ থাকলে মহাসড়ক সম্প্রসারণ আদৌ সম্ভব না। এজন্য গাছ কাটার ব্যাপারে উপস্থিত সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা কেউ দ্বিমত করেননি।

যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২১ মার্চ একনেকের সভায় ৩২৮ কোটি ৯০ লাখ ৫৫ হাজার টাকা ব্যয়ে যশোর-বেনাপোল জাতীয় সড়কের (দড়াটানা-বেনাপোল পর্যন্ত) ৩৮ দশমিক ২ কিলোমিটার সড়ক যথাযথমানে প্রশস্তকরণ প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের নকশা অনুযায়ী ‘মহাসড়কের প্রস্থ ৭ দশমিক ৩ মিটার থেকে বৃদ্ধি করে ১০ দশমিক ৩ মিটার করা হবে। একই সঙ্গে সড়কের উভয় পাশে ১ মিটার করে মাটির জায়গা রাখা হবে। এতে সড়কের প্রস্থ দাঁড়াবে ১২ দশমিক ৩ মিটার। সব মিলিয়ে রাস্তার দুই পাশে পাঁচ মিটার সম্প্রসারণ করা হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে মহাসড়কের উভয় পাশের মোট ২ হাজার ৩১২টি গাছ কাটতে হবে।

যশোরের নাগরিক আন্দোলনের আহ্বায়ক মাস্টার নূর জালাল বলেন, মহাসড়ক সম্প্রসারণে গাছ কাটার সিদ্ধান্তে আমি একমত। মহাসড়কের পাশে বড় গাছ থাকলে দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনা এড়াতে মহাসড়কের পাশেই এক মিটার ড্রেন, তারপর চারমিটার কাঁচা রাস্তা আকারে রাখা যেতে পারে। এরপর গাছ লাগানো যেতে পারে। তবে মহাসড়কের পাশেই গাছ রাখা ঠিক হবে না বলে মনে করি।

Advertisement

যশোরের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হারুন অর রশিদ বলেন, গত বছর গাছ কাটার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। আমরা আন্দোলন করে বন্ধ করেছিলাম। আবার গাছ কাটার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। লুটপাটের স্বার্থে আমলাদের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিরাও গাছ কাটার সিদ্ধান্তে একমত হয়েছে। এটা দেশবিরোধী সিদ্ধান্ত বলে আমি মনে করি।

যশোরের বিশিষ্ট পরিবেশবাদী কবি ও সাংবাদিক ফখরে আলম বলেন, ঐতিহাসিক গাছগুলো খুবই মায়ার। ১৮৪০ সালে জমিদার কালীবাবু এ গাছগুলো রোপণ করেছিলেন। ইতিপূর্বে গাছগুলো রক্ষা করতে আমরা আন্দোলন সংগ্রাম করেছিলাম। কিন্তু ঐতিহাসিক গাছগুলোর অনেকগুলো গাছ ঝড়ে পড়ে গেছে, দুর্বৃত্তরা কেটে নিয়ে গেছে, অনেকগুলো মরে পড়ে আছে, বড় অংশের উড ভেল্যু নষ্ট হয়ে গেছে। এখন যেহেতু এ মহাসড়ক এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযুক্ত ও সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাই আমরা এ গাছগুলো কেটে মহাসড়ক সম্প্রসারণের পক্ষে মত দিয়েছি। তবে অবশ্যই মহাসড়কের পাশে নতুন করে গাছ লাগিয়ে সবুজের সমারোহ ফিরিয়ে আনতে হবে।

মিলন রহমান/এমএএস/এমএস