যশোর রোডকে ১ লেইন থেকে ৪ লেইনে রুপান্তর করার পরিকল্পনা নিয়েছে স্থানীয় প্রসাশন। আর এই উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কাটতে হবে প্রায় আড়াই হাজার গাছ। এই যশোর রোডকে নিছক একটি সড়ক আর সড়কের দুই ধারের গাছগুলোকে নিছক বৃক্ষরাজি বললে অসম্মান করা হবে। কেননা যশোর রোড ও এই সড়কের শতবর্ষী বৃক্ষের সাথে মিশে রয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই পথ ধরেই পূর্ব বাংলার প্রায় এক কোটি বাঙালি আশ্রয় নিয়েছিলো কোলকাতার শরণার্থী শিবিরে।
Advertisement
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে এই শতবর্ষী গাছের ছায়ায় হয়তো ক্লান্ত শরণার্থীরা দু'দণ্ড বসে শুকিয়ে যাওয়া গলায় দম নিয়েছেন। হয়তো কোন গর্ভবতী নারী তার প্রসব বেদনা সহ্য করতে না পেরে আশ্রয় নিয়েছিলেন এই গাছের নিচে। কত বৃদ্ধ পথ চলতে না পেরে পরিবার পরিজনকে হারিয়ে হয়েছেন বিচ্ছিন্ন। কত শিশুর আর্তচিৎকারে বাতাস হয়েছিলো ভারী। ১৯৭১ সালে নিজ দেশের শরণার্থীদের দেশান্তর আমরা তরুণ প্রজন্ম দেখিনি, কিন্তু সম্প্রতি আমরা রোহিঙ্গাদের দেশান্তরী হতে দেখেছি। রোহিঙ্গাদের দেশান্তরী হবার দৃশ্য গণমাধ্যমে দেখে কিছুটা অনুভব করতে পেরেছিলাম এক কোটি বাঙালি ভারতের শরণার্থী শিবিরে যাবার পথে কি পরিমাণ দুর্ভোগের মধ্যদিয়ে শত শত মাইল পথ পাড়ি দিয়েছিলো এই যশোর রোড দিয়ে।
শুধু খেয়াল করুন সম্প্রতি দশ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে আসার পথে কতজন গর্ভবতী মা সন্তান জন্ম দিয়েছেন? এক কোটি বাঙালি পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিমবঙ্গে গেছেন এই যশোর রোড ধরে। কত বাঙালির জন্ম হয়েছে আর কত শিশু-বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে এই যশোর রোডে, আমাদের সেই তথ্য জানা নেই। এই পথের প্রতিটি ইঞ্চিতে রয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। আমাদের গায়ে কী কাঁটা দিয়ে উঠে না সেইসব স্মৃতির কথা মনে করে? শতবর্ষী এই বৃক্ষগুলো রক্ষায় আমরা গত অর্ধ শতাব্দী ধরে ইতিহাস সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ নিইনি। কারো কারো কাছে এই যশোর রোডের শতবর্ষী গাছ গুলো হয়তো নিছক বোঝা কিন্তু এই আড়াই হাজার গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এর ঐতিহাসিক মূল্যকে কি আমরা কখনো বিবেচনায় নিয়েছি?
যশোর রোডের বর্তমান পরিস্থিতি জানতে একাত্তর টেলিভিশনের যশোর প্রতিনিধি এম ফরহাদ হোসেনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম গত এক যুগে এই সড়কে গাছ পড়ে নিহত হয়েছেন প্রায় ৫০ জন। গত বছর একসাথে ১১ জনের মৃত্যুর পরই মূলত প্রসাশন এই পুরাতন গাছগুলো কেটে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। চলতি বছর ৬ জানুয়ারি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে যশোর রোডকে ৪ লেইনে রুপান্তর করতে হলে আড়াই হাজার গাছ কেটে ফেলা ছাড়া বিকল্প নেই।
Advertisement
ফরহাদ হোসেন আরো জানালেন, যশোর রোডে মূল ৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পথে ভারতে আসা যাওয়া করে প্রতিদিন প্রায় ৬ হাজার যাত্রী। এছাড়াও পণ্য পরিবহের জন্য প্রতিদিন ৫০-৬০ টন ওজনের তিনশ পণ্যবাহী ভারী যানবাহন চলাচল করে এই সড়কে। এক লেইনের এই সড়কে এতো ভারী যানবাহন চলাচলের কারণে শতবর্ষী রেইনট্রি গাছ গুলোর গোড়ার মাটি সরে গেছে। তাই সড়কে যাত্রী কিংবা পণ্য পরিবহন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
গত ৬ জানুয়ারি জেলা প্রসাসন, সড়ক ও জনপদ, স্থানীয় সুশীল সমাজ, পরিবহন মালিক, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এমনকি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার, স্থানীয় প্রেসক্লাবের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হয়। মূলত ৬ জানুয়ারির এই সিদ্ধান্তের পর থেকেই ফেসবুকে যশোর রোডের গাছ কাটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠে সাধারণ মানুষ। ফেসবুকের প্রতিক্রিয়া দেখে সহজেই অনুমান করা গেছে যশোর রোড সম্পর্কে বাঙালির আবেগ কত গভীরে।
এখন কথা হচ্ছে যশোর রোডের সকল সিদ্ধান্ত দেওয়ার এক্তিয়ার স্থানীয় প্রসাশনের এটি যেমন বাস্তবতা তেমনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এই সড়কটি সংরক্ষণের দায়িত্ব কিন্তু সরকারের। সরকারের উচিত হবে না বিষয়টি নিয়ে জাতীয়ভাবে আলোচনা না করে স্থানীয় প্রশাসনের সিদ্ধান্ত চোখ বন্ধ করে বাস্তবায়ন করা। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে এই সড়কের গুরুত্ব বুঝে যদি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেওয়া হতো তাহলে এই গাছগুলো শত বছরেই এতো ঝুঁকিপূর্ণ হতো না। যশোর বেনাপোল সড়কে শতবর্ষী গাছগুলোর অধিকাংশই রেইনট্রি ও শিশুগাছ। সাধারণত রেইনট্রি ও শিশু গাছের গড় আয়ু ২০০ থেকে আড়াইশ বছর। গোত্রবিশেষে রেইনট্রি ৫শ বছরও বাঁচে। এখন বিষয়টা খুব সহজেই অনুমেয় যশোর রোডের এই বৃক্ষগুলো তাদের অর্ধেক জীবনে এসে মরতে বসেছে শুধু অযত্ন আর অবহেলায়।
গত কয়েক বছর আগে স্ট্র্যাটফোর্ড আপন এ্যাভনে গিয়েছিলাম সেক্সপিয়ারের বাড়ি দেখতে। সেখানে গিয়ে দেখলাম, বৈঠকখানায় প্রবেশ পথে একটা ফায়ার প্লেইসে (শীতের দিনে বাড়ি গরম রাখতে ব্রিটেনের প্রায় অধিকাংশ বাড়িতেই সেই সময়ে ফায়ার প্লেইস থাকতো) একটা ঝাড়ু রাখা, সেখানে লেখা আছে 'সেক্সপিয়ার্স ব্রুম' আমি ঝাড়ুটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলাম। ঝাড়ু হাতে ছবিও তুললাম। তবে সেই ঝাড়ু দেখে আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি ঝাড়ুটি মূলত সেক্সপিয়ারের ঝাড়ুর আদলে তৈরি ঝাড়ু।
Advertisement
এভাবে সেক্সপিয়ারের সময় ব্যবহৃত বিছানা বালিশ, রকিং চেয়ার কিংবা রান্নাঘরের ছুড়ি সবই তৈরি করা হয়েছে শেক্সপিয়ারের সময়ে ব্যবহৃত জিনিসপত্রের আদলে। যশোর রোডের গাছ নিশ্চয়ই দুইশ বছর পরে মারা যাবে, কিন্তু এই স্থানটিকে যদি বিশেষ ভাবে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্য হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পৃথক বরাদ্দ দেওয়া না হয়, তাহলে এই সড়কের স্মৃতি রক্ষা দুরূহ হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমন পুরনো বৃক্ষ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য আলাদা ট্রাস্ট রয়েছে। যারা এধরনের ঐতিহ্য রক্ষায় নিয়োজিত থাকেন।
যশোর বেনাপোল রোডের দৈর্ঘ্য ৩৬ কিলোমিটার হলেও মূলত ঝিকরগাছা থেকেই শবতর্ষী রেইনট্রি গুলোর অবস্থান। এই ঝিকরগাছা থেকে বেনাপোলের প্রায় তিন কিলোমিটার আগে পর্যন্ত পথের দূরত্ব ১২ থেকে ১৫ কিলোমিটার হবে। সরকার চাইলে এই অংশটুকু যাত্রী ও পণ্য পরিবহন নিষিদ্ধ করে এই পথটিকে বিশেষ পর্যটন অঞ্চল ঘোষণা করতে পারে। ঝিকরগাছা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত অন্তত ১৫ কিলোমিটার এলাকায় আশেপাশের খালি জমি অধিগ্রহণ করে বেনাপোল স্থলবন্দরের বিকল্প সংযোগ সড়ক তৈরি করতে পারে।
সরকার ৩৬ কিলোমিটার ৪ লেইনের সড়কের জন্য যদি ৬ হাজার কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ করতে পারে তাহলে যশোর রোডের এই ১৫ কিলোমিটারকে বিশেষ পর্যটন এলাকা হিসেবে সংরক্ষণ করে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষায় আরো বাড়তি কিছু বরাদ্দ দিলে, আমার বিশ্বাস দর্শণার্থীদের প্রদত্ত অর্থেই এই বিশেষ পর্যটন কেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ উঠে আসবে। আমার সহকর্মী স্থানীয় সাংবাদিক ফরহাদ হোসেন আমাকে নিশ্চিত করেছেন ঝিকরগাছা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার সড়কের আশেপাশের জমি অধিগ্রহণ করে যশোর রোডে বেনাপোল সীমান্ত পর্যন্ত বিকল্প সড়ক নির্মাণ সম্ভব।
অনেকের কাছে মনে হতে পারে শুধু গাছ দেখতে যশোর রোডে যাবে মানুষ? তাদের একটু জানিয়ে রাখি, পূর্ব বাংলার সাথে পশ্চিম বাংলার একমাত্র সংযোগ সড়ক এই যশোর রোড দিয়ে নিজের ভিটে মাটি ছেড়ে নিজের জীবনকে হাতে নিয়ে যারা মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পশ্চিম বঙ্গের কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে যশোর রোড সীমান্তে এসেছিলেন বিখ্যাত পর্যটক মার্কিন কবি এ্যালেন গিন্সবার্গ।
পরবর্তীতে এ্যালেন গিন্সবার্গের লেখা কবিতা 'সেপ্টেম্বার অন যশোর রোড'কে গানে রুপান্তর করে কনসার্ট ফর বাংলাদেশে গান গেয়েছিলেন শিল্পী বব ডিলান। সেই কনর্সাট নজর কেড়েছিলো বিশ্ববাসীর। শুধুমাত্র শতবর্ষী বৃক্ষের জন্য আমাদের কান্না নয়, বৃক্ষের পাশাপাশি আমাদের আর্তনাদ মুক্তিযুদ্ধে ঐতিহ্য রক্ষার জন্যে। এই প্রজন্মের তরুণরা নিশ্চয়ই এই ইতিহাসের অনেক কিছুই জানে না। প্রতিবছর সেপ্টেম্বরে যশোর রোডে হতে পারে মুক্তিযুদ্ধ মেলা। একটি জাদুঘর স্থাপন করে যশোর রোডের স্মৃতিশালা গড়ে তোলা যায়।
খুব শিগগিরই পদ্মাসেতু উদ্বোধন হবে। পদ্মাসেতুর কারণে বেনাপল, যশোর, নড়াইল, মাওয়া হয়ে পদ্মাসেতুর সাথে সংযুক্তির জন্য আরো ব্যস্ত হয়ে হবে এই যশোর বেনাপোল সড়ক। তাই যাওয়া আসার পথে এই যশোর রোড হতে পারে অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারতের অংশেও কিন্তু যশোর রোডের আদলে শতবর্ষী রেইনট্রি গাছ রয়েছে। বেনাপোল অংশে পেট্রাপল হয়ে কোলকাতার দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার। ভারত কিন্তু এই শর্তবর্ষী গাছগুলোকে অক্ষত রেখেই তাদের সড়ক উন্নয়ন করেছে। এখন যশোর রোডকে বাঁচাতে আমাদের কতটুকু সদিচ্ছা রয়েছে তার উপর নির্ভর করবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার ভবিষ্যত।
লেখক : কারেন্ট এফেয়ার্স এডিটর, চ্যানেল এস টেলিভিশন লন্ডন। একাত্তর টেলিভিশনের যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি।tvjournalistuk@gmail.com
এইচআর/এমএস