ফিচার

বাবার অনুপ্রেরণায় আঁকাআঁকির সঙ্গে সখ্যতা : নাজনীন চামেলী

চাঁদপুরের মেয়ে নাজনীন চামেলী। ত্রিনদীর বাঁধন ঘেরা এ শহরে নিভৃত প্রকৃতির সঙ্গে সখ্যতায় বড় হয়েছেন তিনি। শিশুবেলার অবোধ মনে গাছ-গাছালি, ফুল, পাখি, প্রজাপতি আঁকার নেশায় হাতে তুলে নিয়েছিলেন পেন্সিল আর রংতুলি। চিত্রশিল্পের চর্চার তখন থেকেই শুরু। এখন তিনি আমেরিকার টেক্সাস প্রবাসী। সংসার জীবনে ২ সন্তানের জননী। কিন্তু থেমে নেই তার চিত্রসাধনা। মনের অনেক ধূসর বিবর্ণ স্মৃতিকেও তুলে নিয়ে রঙে সাজিয়ে তোলেন তার ক্যানভাসে। আমেরিকায় খ্যাতিমান দু’জন চিত্রশিল্পী ক্যাভিন হিল আর রব রুসের কাছে তালিম নিয়েছেন আঁকাআঁকির ওপরে। গতবছর গ্রুপ এক্সিভিশনে ঢাকার উত্তরায় তার আঁকা চিত্রকর্মের প্রদর্শনী হয়েছে। জীবনে নানা বাঁকে মুখোমুখি হওয়া কঠিন বাস্তবতার মাঝেও তার এই শিল্পীজীবন নিয়ে কিছু কথা বলার ইচ্ছায় মুখোমুখি হয়েছেন জাগো নিউজের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রবাসী সাংবাদিক মিরন নাজমুল-

Advertisement

জাগো নিউজ: কখন থেকে কী কারণে আঁকাআঁকির নেশাটা তৈরি হলো?নাজনীন চামেলী: দিন-তারিখ সঠিকভাবে মনে পড়ছে না। আমি যখন ক্লাস থ্রি-তে পড়ি; তখন থেকেই আঁকাআঁকির ব্যাপারটা আমাকে খুব বিমোহিত করতো। যা দেখতাম, আঁকার চেষ্টা করতাম। সেটা সঠিকভাবে হোক বা না হোক।

জাগো নিউজ: আঁকাআঁকির ক্ষেত্রে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কিনা?নাজনীন চামেলী: আসলে এ ক্ষেত্রে আমার বিশেষ প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। আমার আঁকার প্রতি এই নেশার কারণে আমাদের উদয়ন শিশু বিদ্যালয়ের অঙ্কন ক্লাসের শিক্ষক ওমর ফারুক স্যার আমাকে মৌলিক নিয়মগুলো ধরিয়ে দিতেন। সেই শিক্ষা এবং নিজের চেষ্টায় ভালো শিল্পীদের আঁকা দেখে দেখেই আমি শিখেছি। আসলে শেখার জন্য যে নেশাটা; সেটা ধরে রেখেছি বলেই আমি আঁকার জগতটা তৈরি করে নিতে পেরেছি বলে আমার মনে হয়।

জাগো নিউজ: রঙের ব্যবহার শিখেছেন কোথায় বা কার কাছে?নাজনীন চামেলী: রঙের কাজ করছি প্রায় এক বছরের বেশি হবে। আমেরিকায় আমার দু’জন প্রিয় আর্টিস্ট আছেন। ক্যাভিন হিল এবং বব রুস। তাঁদের কাছে আমি রঙের ব্যবহার শিখেছি। তারা প্রফেশনাললি অদ্ভুত সুন্দর সব পেইন্টিং করেন। তাদের ছবি আঁকা দেখতাম বিমুগ্ধ হয়ে। তাদের রঙের ব্যবহার দেখতে শুরু করলাম। মনের ক্যানভাসে কল্পনায় আঁকার চেষ্টা করতে করতে বাস্তবে একদিন সাহস করে সত্যি অয়েল পেইন্টিং শুরু করলাম। তারা আমাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন শেখার জন্য।

Advertisement

জাগো নিউজ: এ পর্যন্ত কতটি চিত্রকর্ম সৃষ্টি করেছেন?নাজনীন চামেলী: গতবছর অয়েল পেইন্টিংয়ে কাজ করেছি ২শ’র মতো হবে। আর পেন্সিল স্কেচ করেছি অনেক- হিসেব মিলিয়ে বলতে পারবো না।

জাগো নিউজ: কোনো প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন কি?নাজনীন চামেলী: ২০১৭ সালে বাংলাদেশের গ্রুপ এক্সিভিশনে আমার বেশ কয়েকটি চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে। ঢাকার উত্তরায় স্পটলাইট আর্ট গ্যালারি এর আয়োজন করেছিল। এছাড়া আমি যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি; তখন আমার একক প্রদর্শনী হয়েছিল চাঁদপুর কচিকাঁচার মেলার আয়োজনে। সেটা আমার জন্য অনেক উৎসাহব্যঞ্জক ছিল। আমার কিশোরী মনে সেটা অনেক স্মৃতিময় ঘটনা ছিল।

জাগো নিউজ: আঁকতে গিয়ে কোনো বাধার সম্মুখীন হয়েছেন?নাজনীন চামেলী: আমার স্কুল জীবনে পড়াশোনার পাশাপাশি আঁকাআঁকিটা চালিয়ে যাওয়াটা কঠিন ছিল। আর সংসার জীবনের ব্যস্ততায় নিজের ইচ্ছামাফিক চালিয়ে যেতে পারিনি আঁকার অভ্যাসটা।

জাগো নিউজ: এ কাজের ক্ষেত্রে কে বা কারা বেশি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন?নাজনীন চামেলী: এ ক্ষেত্রে আমার বাবার কথা বলবো প্রথমে। বাবার অনুপ্রেরণায় রং পেন্সিল আর তুলির সঙ্গে সখ্যতা তৈরি হয়েছে। রং, ক্যানভাস- যেটাই প্রয়োজন হতো, তিনি কিনে দিতেন। এগুলো কেনার ক্ষেত্রে কোনদিন কার্পণ্য করেননি। লিপি কাকিমা আমাকে অনুপ্রেরণা জোগাতেন আঁকার জন্য। এখন আমেরিকায় খুব কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পাই আমার বড় আপু, বড় দুলাভাইয়ের কাছ থেকে। আমার বন্ধুরা আমার আঁকায় প্রশংসা করে আমাকে সাহস জোগায়। এ মানুষগুলোর জন্য আমি আবার আঁকতে শুরু করি। তাই যারা আমাকে আঁকার জন্য সাহস ও উৎসাহ জুগিয়েছে সবার কাছে আমি অনেক কৃতজ্ঞ।

Advertisement

জাগো নিউজ: আঁকাআঁকি নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?নাজনীন চামেলী: আমি মাঝেমধ্যে ভাবি, আমার আমার জন্ম হয়েছে ছবি আঁকার জন্য। আমি আমার আঁকা ক্যানভাসের মাঝে বেঁচে থাকতে চাই। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশি শিল্পী পরিচয়ে দেশের নামটি উজ্জ্বল হোক- এটা আমার প্রথম চাওয়া। দেশে আমার একটা প্রদর্শনী করার খুব ইচ্ছা আছে। সেটা যদি চাঁদপুরে করতে পারি তাহলে খুব ভালো হতো। সেখানে আমার শৈশব কেটেছে।

জাগো নিউজ: উল্লেখযোগ্য কোনো স্মৃতি বা অর্জন থাকলে বলুন-নাজনীন চামেলী: একটা স্মৃতি আমার খুব মনে পড়ে। তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। আমার একক প্রদর্শনী হয়েছিল চাঁদপুর কচিকাঁচার মেলার আয়োজনে। সেখানে প্রদর্শনের জন্য একটা মেয়ের অবয়ব আঁকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার মুখমণ্ডল যেমনটা চাচ্ছি; তেমন করে আঁকতে পারছিলাম না কেন জানি। হতাশ হয়ে অবশেষে আমি মুখের অংশটা কালো রঙ দিয়ে অন্ধকার করে দেই। সেই ছবিটা প্রদর্শনীতে দিয়ে দিলাম। দর্শকরা সবাই দেখে প্রশ্ন করছে, ‘এটা আবার কেমন ছবি, চেহারা কালো রঙে ঢাকা?’ আমি জবাব দিচ্ছিলাম, ‘আমাদের দেশের মেয়েরা এখনো অন্ধকারে আছে। আমি এই ছবিতে সেটাই বোঝাতে চেয়েছি।’ ব্যাখ্যা শুনে সবাই আমার খুব প্রশংসা করেছিল। বিষয়টি মনে পড়লে এখনো নিজের অজান্তে হেসে ফেলি।

এসইউ/এমএস