দেশজুড়ে

ডিআইজি মিজানের ‘স্বর্ণকমল’ বাড়ি

অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে বিয়ে করাসহ নানা অপকর্মের জন্য প্রত্যাহার হওয়া ডিআইজি মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে তার গ্রামের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায়ও ক্ষমতার অপব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে।

Advertisement

ডিআইজি মিজানুর রহমানের ক্ষমতার দাপটে গত কয়েক বছর ধরে মেহেন্দিগঞ্জ থানা পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন তার ছোট ভাই মো. স্বপন এবং তিন ভগ্নিপতি। মেহেন্দিগঞ্জ থানা পুলিশের যাবতীয় তদবির বাণিজ্য, আসামি ধরা-ছাড়া, জিডি, মামলা, চার্জশিট সবই হতো ডিআইজি মিজানের ছোট ভাই স্বপন ও তার তিন ভগ্নিপতির ইশারায়। এমনকি ডিআইজি মিজানের ছোট ভাই স্বপনের অন্যায় আবদার না রাখায় ২০১৬ সালের মাঝামঝি সময়ে বদলি করে দেয়া হয় মেহেন্দিগঞ্জ থানার তৎকালীন এসআই শাহজাহানকে।

স্থানীয়রা জানান, মেহেন্দিগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে একটি ফার্মেসি রয়েছে মিজানের ছোট ভাই স্বপনের। ওই ফার্মেসিতে বসেই পুলিশের সব বিষয়ে খবরদারি করতেন তিনি।

স্থানীয়রা জানান, মেহেন্দীগঞ্জের পৌর শহরের আম্বিকাপুর এলাকার বাসিন্দা আলী আকবরের দুই ছেলে ও ছয় মেয়ের মধ্যে তৃতীয় মিজানুর রহমান। অভাব-অনটনে চলতো তাদের সংসার। তাদের ছিল ছনের (কাঁচা) ঘর। ওই ঘরে বৃষ্টির সময় পানি চুয়ে পড়তো। তবে দরিদ্র পরিবারের সন্তান মিজান ছোট বেলা থেকেই ছিলেন মেধাবী। ১৯৮০ সালে মেহেন্দিগঞ্জের পাতারহাট পিএম স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন তিনি। ৮২ সালে বরিশাল বিএম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। থাকতেন স্যার এফ রহমান হলে।

Advertisement

স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, মিজানের পুলিশ বিভাগে চাকরি হওয়ার পরই ভাগ্য খুলে যায় পুরো পরিবারের। দুই হাতে অর্থ কামিয়ে কয়েক বছর আগে মেহেন্দিগঞ্জ পৌর শহরের পাতারহাট-উলানিয়া সড়কের পাশে কালীকাপুর এলাকায় প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেন বিশাল বাউন্ডারি ঘেরা বিলাসবহুল দোতালা বাড়ি ‘আমেনা ভিলা’। মেহেন্দিগঞ্জের লোকজনের কাছে ওই বাড়িটি ‘স্বর্ণকমল’ হিসেবে পরিচিত। ঢাকার পল্টনসহ বিভিন্ন স্থানে নামে-বেনামে তার একাধিক ফ্লাট-বাড়ি রয়েছে বলে তার ঘনিষ্টজনরা জানিয়েছেন। অগাধ অর্থ সম্পদের মালিক মিজানের দুই ছেলেসহ স্ত্রী থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। তার দুই ছেলে পড়াশোনা করে সেখানে। অস্ট্রেলিয়ায় তিনি বাড়িও করেছেন বলে তার ঘনিষ্টজনরা জানিয়েছেন।

মেহেন্দিগঞ্জের এক সাবেক সংসদ সদস্য নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, শুধু মেহেন্দিগঞ্জে নয়, ঢাকা পুলিশ হেড কোয়ার্টারের যাবতীয় নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন ডিআইজি মিজান। অবৈধ এ বাণিজ্য করে অগাধ টাকার মালিক হন তিনি। মেহেন্দিগঞ্জে তেমন একটা আসা-যাওয়া না থাকলেও ঈদে এবং কোরবানির সময় এলাকায় আসতেন তিনি। এলাকার বিভিন্ন ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং দরিদ্রদের মধ্যে ডিআইজি মিজান অনেক দান-সদকা করতেন বলে জানিয়েছেন ওই সাবেক সংসদ সদস্য।

মেহেন্দিগঞ্জের পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন খান বলেন, এক সময় ছাত্রলীগ করতেন মিজান। পরে পুলিশে চাকরি নেন। এলাকায়ও তেমন আসেন না। তবে মেহেন্দিগঞ্জে একটা সুন্দর বাড়ি করেছেন। সবাই বলে ‘এসপি সাহেবের’ বাড়ি আবার কেউ বলে ‘স্বর্ণকমল’। সেই হিসেবে মিজানকে নামে চেনেন তিনি। মেহেন্দিগঞ্জের একজন সন্তান পুলিশের বড় পদে চাকরি করায় এতদিন তাকে নিয়ে গর্ব করতেন স্থানীয় মানুষ। কিন্তু ঢাকায় নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ায় এখন সবাই ছি-ছি- করছে। এটা নিয়ে সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে। এটা লজ্জার বিষয়।

স্থানীয়রা জানান, ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে মেহেন্দিগঞ্জ থানার তৎকালীন এসআই শাজাহান পাতারহাট বন্দরে কাগজপত্রবিহীন একটি মোটরসাইকেল আটক করেন। ডিআইজি মিজানের ক্ষমতাধর ভাই স্বপন মোটরসাইকেলটি ছেড়ে দিতে বলেন। কিন্তু এতে রাজি হননি এসআই শাজাহান। ডিআইজি মিজানের ভাইয়ের অন্যায় আবদার না রাখায় এসআই শাজাহানকে তাৎক্ষণিক প্রত্যাহার করে শাস্তিমূলক বদলি করা হয় বাবুগঞ্জের আগরপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে।

Advertisement

ডিআইজি মিজানের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং তার ভাই ও তিন ভগ্নিপতিদের দাপটের বিষয়ে ওই সময়ে স্থানীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশ করা হলে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মিজান ও তার ভাই। ওই সংবাদের প্রেক্ষিতে স্থানীয় এক ব্যক্তিকে দিয়ে মেহেন্দিগঞ্জের তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে একটি চাঁদাবাজি মামলা করান ডিআইজি মিজান। ওই মামলায় বরিশালের পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) এক কর্মকতার ওপর অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র পর্যন্ত দাখিল করানোর অভিযোগ রয়েছে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে। যদিও পরবর্তীতে ওই মামলার বাদী আদালত থেকে মামলা তুলে নেয়ায় ডিআইজি মিজানের রোষানল থেকে বেঁচে যান স্থানীয় তিন সাংবাদিক।

মিজানের রোষানল থেকে বেঁচে যাওয়া মেহেন্দিগঞ্জের সাংবাদিক সঞ্জয় গুহ জানান, ডিআইজি মিজানের ক্ষমতার দাপটের বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করার পর ডিআইজি মিজান ও তার ভাই স্থানীয় সাংবাদিকদের দেখে নেয়ার হুমকি দেন। এর এক সপ্তাহ পর তার অনুগত ইউপি সদস্য মনির চাপরাশীকে দিয়ে স্থানীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আক্তার হোসেন খোকন, তিনি (সঞ্জয় গুহ) এবং সঞ্জয় দেবনাথের বিরুদ্ধে আদালতে চাঁদাবাজি মামলা করান। ওই মামলায় আদালত পিবিআইকে তদন্ত প্রতিদেন দেয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু পিবিআই’র তৎকালীন পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন সরেজমিন তদন্ত না করেই ডিআইজি মিজানের প্রভাবে বরিশালে বসেই তাদের তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগে আদালতে প্রতিবেদন দেন।

সাইফ আমীন/আরএআর/আরআইপি