মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের মানুষ যখন হত্যা ও গণহত্যার ভয়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেড়াতেন তখন আলবদর বাহিনী ও সেনা সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে ড. ওসমান ফারুক বিভিন্ন হুমকি দিতেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) শিক্ষকদের। তার হুমকি আর নিযার্তনের ভয়ে তটস্থ থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। হুমকি দিয়ে তার সহযোগী শিক্ষকদের মাধ্যমে বিভিন্ন মহল্লা ও বাড়ি থেকে সুন্দরী নারীদের তুলে আনতেন। পরে সেসব নারীদের ওপর নির্যাতন করত পাকিস্তানি নরপশুরা। মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত সংস্থার সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সূত্র আরও জানায়, ১৯৭১ সালের আগে থেকেই ময়মনসিংহ শহরের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বসবাস করার সুবাদে অনেক কিছু তার জানা ছিল। কারা মুক্তিযোদ্ধা এবং আওয়ামী লীগ করেন তা জানতেন তিনি। শিক্ষক, কর্মচারী ও আশপাশের এলাকার সুন্দরী নারীদের ধরে আনা হতো। নারীদের ধরে নিয়ে আসার পর কথা না শুনলে চলত নির্যাতন। এমন অভিযোগসহ নানা তথ্য ওঠে আসছে ড. ওসমান ফারুকের বিরুদ্ধে।
Advertisement
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত সংস্থার কো-অর্ডিনেটর এম সানাউল হক জাগো নিউজকে জানান, বিএনপি নেতা ড. ওসমান ফারুকের অপরাধ বিষয়ে অনুসন্ধান শেষে তদন্ত শুরু করার পর তা অব্যাহত রয়েছে। তার বিরুদ্ধে অপরাধের তথ্য মিলছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন জাগো নিউজকে জানান, তার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধের তথ্য ওঠে আসছে এবং অপরাধের সম্পৃক্ততা মিলছে। তদন্ত চলমান রয়েছে। আরো বেশ কিছু সময় ধরে তদন্ত কাজ চালিয়ে যেতে হবে। তিনি জানান, বিএনপির প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক মন্ত্রী ড. ওসমান ফারুকের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের ৪ জানুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করা হয়েছে। তার অপরাধ বিষয়ে জানার জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে ধর্মমন্ত্রী প্রিন্সিপাল মো. মতিউর রহমান, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন রেজিস্ট্রার, ডেপুটি রেজিস্ট্রার ও বর্তমান প্রো-ভিসিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং মুক্তিযোদ্ধা, প্রত্যক্ষদর্শীসহ ৪০ থেকে ৪৫ জনকে। জিজ্ঞাসাবাদ এবং দালিলিক প্রমাণ মিলিয়ে পাওয়া তথ্য উপাত্ত থেকে ওসমান ফারুকের অপরাধের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে, মামলার স্বার্থে সাক্ষীদের নাম প্রকাশ করা যাবে না। এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ইতোমধ্যে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লা ও মীর কাসেম আলীসহ ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে কারাদণ্ড ঘোষণার পর আপিল শুনানির সময় জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ও বিএনপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী আব্দুল আলিম মারা যান। এ ছাড়া জামায়াতের এক নায়েবে আমিরের অামৃত্যু কারাদণ্ড বহাল রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। বর্তমানে প্রভাবশালী বিএনপি নেতা ড. ওসমান ফারুকের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত চলছে। তার বিরুদ্ধে করা তদন্তে অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে বলেও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত তদন্ত সংস্থা সূত্রে তথ্য জানা গেছে। ড. ওসমান ফারুক বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী। তিনি বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন বলেও জানান তদন্ত সংস্থার সংশ্লিষ্ট সূত্র। তদন্তে ওসমান ফারুকের বিষয়ে অপরাধের তথ্য মিলছে বলে জাগো নিউজকে জানান তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এম. সানাউল হক। তিনি আরও জানান, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিনসহ আরও একজন গুরুত্বপূর্ণ তদন্তকারী কর্মকর্তা সহযোগীদের নিয়ে তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে ড. ওসমান ফারুকের অপরাধের বিষয়ে তার আগের কর্মস্থল (৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন) ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ আশপাশে ওই মহানগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে, যা এখনও চলছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তযোদ্ধা, ভিকটিম পরিবার, প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীসহ দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহের কাজ চলছে। এ মামলা প্রক্রিয়ার অগ্রগতি হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে অপরাধের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন জাগো নিউজকে জানান, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন গাঙ্গিনারপাড়, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ এলাকার অপদা মোড়সহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত গণকবর, পাকিস্তানি আমির ক্যাম্প ,প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে বিভিন্ন ঘটনা এবং অপরাধে জড়িত থাকার তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। তিনি আরও জানান, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজারেরও বেশি লোককে হত্যা করা হয়েছে। তাই সেখানে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন খালপাড় কমিউনিটি সেন্টার ও নদীর তীরে গণকবর রয়েছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাইস বর্তমান হলে পাক আর্মিদের ক্যাম্প ছিল বলে জানান তিনি।
তদন্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন জানান, মামলার জন্য যেসব সাক্ষী রয়েছেন তাদের সবাই জানিয়েছেন, ৭১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজাকার, আলবদর ও আর্মিদের সমন্বয়ে তৈরি করা ক্যাম্পে আটককৃতদের নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ট্রেন থেকে পাকিস্তানি আর্মিরা নেমে আসার সময় তাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য নির্মিত হলে থাকার জন্য বলা হয়। তখন পাক আর্মিরা সেখানে একটি ক্যাম্প স্থাপন এবং হলের কয়েকটি কক্ষে বসবাস করত। তিনি আরও জানান, তৎকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কক্ষে ক্যাম্প ছাড়াও বর্তমান ডাক বাংলোয় পাকিস্তানিদের ক্যাম্প ছিল, যা তদন্তে ওঠে এসেছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তৈরি করা এসব ক্যাম্পে আর্মিরা বসবাস করত এবং ময়মনসিংহ সদরের বিভিন্ন এলাকা থেকে নারীদের ধরে এনে নির্যাতন করত। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে আল-বদর সদস্যরাও নারীদের ধরে আনতে সহযোগিতা করত।
ওসমান ফারুকের মামলার সর্বশেষ অবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্র এবং শিক্ষকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের অবস্থান দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কারণে সাক্ষীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করার কাজ কিছুটা দেরি হচ্ছে। তাই এ মামলার তদন্তের প্রয়োজনে দেশের বিভিন্ন জেলায় সফর করতে হচ্ছে। অবসরপ্রাপ্ত এক শিক্ষকের বাড়ি রাজশাহী হওয়ায় চলতি সপ্তাহে সেখানে যাচ্ছেন ওই শিক্ষকের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য। এর আগে ২০১৬ সালের ৪ মে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট আমলের প্রভাবশালী এ মন্ত্রীর নাম মানবতাবিরোধীদের তালিকায় আসে বলে জানিয়েছিলেন তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এম. সানাউল হক মিয়া।
Advertisement
একাত্তরে সংঘটিত হত্যা, গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সানাউল হক বলেন, একাত্তরে সংঘঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত করতে গিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহের ১১ জন প্রফেসরের নাম পাওয়া গেছে, যারা স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ড করেছেন। তাদের মধ্যে ড. ওসমান ফারুকের নামও দেখতে পান অনুসন্ধানকারীরা। তখন তিনি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। তিনি বলেন, কাগজপত্রে দেখা যায়, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ওসমান ফারুকসহ ১১ জন শিক্ষক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছিলেন। সে সময় ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ নেন তারা।
এফএইচ/ওআর/আরআইপি