অবশেষে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) চাঞ্চল্যকর নিয়োগ দুর্নীতি মামলার চার্জশিট অনুমোদন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দীর্ঘ তদন্তের পর এ মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন আরডিএ’র সাবেক চেয়ারম্যান (যুগ্ম-সচিব) আব্দুল মান্নান, কর্তৃপক্ষের সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুর রব জোয়ার্দ্দার ও বর্তমান সহকারী প্রকৌশলী শেখ কামরুজ্জামান।
Advertisement
যাচাই-বাছাই ও আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে গত ২ জানুয়ারি সাবেক ও বর্তমান তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চার্জশিট অনুমোদন করেছেন দুদকের কমিশনার (তদন্ত) এএফএম আমিনুল ইসলাম। এই তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিলের জন্য তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপ-পরিচালক (ডিডি) ফরিদুর রহমানকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এদিকে তদন্ত কর্মকর্তা ফরিদুর রহমান চার্জশিট অনুমোদনের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছেন, অভিযুক্ত তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর নিয়োগ দুর্নীতির চার্জশিট আদালতে জমা দেয়া এখন সময়ের ব্যাপার।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে ২০০৪ সালের ১৬ আগস্ট দৈনিক সোনালী সংবাদ পত্রিকায় একজন সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল), একজন নগর পরিকল্পক (এটিপি), একজন উপ-সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল), একজন নিম্নমান সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক, একজন কম্পিউটার অপারেটর, একজন গাড়ি চালক ও একজন নক্সকার, একজন সার্ভেয়ার , একজন এমএলএসএস, একজন প্রহরী ও একজন ঝাড়ুদার নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এই বিজ্ঞপ্তিতে সাড়া দিয়ে তিন শতাধিক চাকরি প্রার্থী আবেদন করেন। জানা যায়, প্রথম বিজ্ঞপ্তির পদগুলির মধ্যে ১ থেকে ৭নং পর্যন্ত পদ লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে ও দ্বিতীয় বিজ্ঞপ্তির সবগুলি পদ লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থীর যোগ্যতা যাচাই সাপেক্ষে নিয়োগ করার শর্ত উল্লেখ করা হয়।
বিজ্ঞপ্তির শর্তানুযায়ী ২০০৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শুধুমাত্র সহকারী প্রকৌশলী, সহকারী নগর পরিকল্পক, উপ-সহকারী প্রকৌশলী, নিম্নমান সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক, কম্পিউটার অপারেটর ও সার্ভেয়ার পদে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নাম ও ঠিকানা যথারীতি কর্তৃপক্ষের নোটিশ বোর্ডে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।
Advertisement
পরে ২১ সেপ্টেম্বর প্রয়োজনীয় মূল সনদ ও কাগজপত্রসহ উত্তীর্ণদের মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য নোটিশে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তার আগেই ১৯ সেপ্টেম্বর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান স্বাক্ষরিত একটি নোটিশে রহস্যজনকভাবে লিখিত পরীক্ষার ফলাফল বাতিল করে সকল আবেদনকারীকে শুধুমাত্র মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য আরডিএ ভবনে উপস্থিত হতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
দীর্ঘ অনুসন্ধান ও তদন্তে দুদক দেখতে পায় লিখিত পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া শেখ কামরুজ্জামানকে শুধুমাত্র মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে সহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া যারা লিখিত পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছিলেন তারা কেউ নিয়োগ পাননি। তবে যারা লিখিত পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছিলেন তাদের মধ্যে থেকেই বিজ্ঞাপিত পদগুলিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। দুদক তদন্তে আরো দেখতে পায়, শুধুমাত্র দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির লক্ষ্যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আবেদনকারী প্রার্থীদের বয়সসীমা উল্লেখ করা হয়নি। ৪৭ বছর বয়সের প্রার্থীকেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। দুদকের তদন্ত থেকে আরো জানা যায়, আরডিএর সাবেক চেয়ারম্যান (যুগ্ম-সচিব) ও নিয়োগ কমিটির সভাপতি আব্দুল মান্নানকে ২০০৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ওএসডি করা হলে তিনি তার শেষ কর্মদিবসে সবগুলি নিয়োগপত্রে স্বাক্ষর করে রাজশাহী ত্যাগ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিয়োগ বঞ্চিতদের অন্যতম ইকবাল হোসেন এই অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিকার চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে লিখিত অভিযোগ করেন। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত হওয়ায় দুদকের উপ-পরিচালক আব্দুল করিম ২০১১ সালের ১৭ জুলাই রাজশাহীর শাহমখদুম থানায় আব্দুল মান্নান, আব্দুর রব জোয়ার্দ্দার ও শেষ কামরুজ্জামানকে আসামি করে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় একটি মামলা করেন। তদন্ত শেষে দুদকের উপ-পরিচালক ফরিদুর রহমান কয়েক মাস আগে চার্জশিট অনুমোদনের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে আবেদন করেন। গত ২ জানুয়ারি দুদক কমিশনার এএফএম আমিনুল ইসলাম, চেয়ারম্যানের মতামত সাপেক্ষে তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চার্জশিট অনুমোদন করেন। ডিডি ফরিদুর রহমান জানান, এখন যেকোনো দিন তিনি আদালতে চার্জশিট দাখিল করবেন।
অন্যদিকে অভিযোগে জানা গেছে, অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে আরডিএতে যে ১৬ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তাদের নিয়োগ বিধিসম্মত না হওয়ায় তাদের বেতনভাতা বন্ধের জন্য সুপারিশ করা হলেও আরডিএর বর্তমান প্রশাসন তা কার্যকর করেনি। এছাড়া নিয়োগকৃত ১৬ কর্মকর্তা কর্মচারিদের মধ্যে নিয়োগের সময় যাদের বয়স ৩০ বছরের বেশি ছিল তাদের বয়স প্রমার্জনের সুযোগ নেই বলে আইন ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয় মতামত দিলেও আরডিএর বর্তমান চেয়ারম্যান তা আমলে নেননি। ফলে এই ১৬ কর্মকর্তা কর্মচারির বেতন ভাতা বাবদ প্রতি বছর কোটি টাকা সরকারের ক্ষতি হচ্ছে। দুদকের উপ-পরিচালক ফরিদুর রহমান বলেন, নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িতরা যে কোনো সময় গ্রেফতার হতে পারেন। এছাড়া চার্জশিট অনুমোদন হওয়ায় নিয়োগপ্রাপ্তদের বরখাস্ত করা কর্তৃপক্ষের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।
Advertisement
ফেরদৌস সিদ্দিকী/এফএ/এমএস