মতামত

জরিপে অরাজকতা গবেষণায় নাশকতা

 

নানা জরিপে আমাদের সাম্প্রতিক সাফল্য আকাশ ছোঁয়ার মতো। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশই কয়েকটি খাতে আমাদের কাছে ডিফিট খেয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, যোগোযোগ, বিদ্যুত, জ্বালানি, খনিজসম্পদ, নারীর ক্ষমতায়নসহ কয়েকটি খাতে আমাদের অর্জন অবশ্যই গর্বের। পাট গবেষণায় বিশ্বে অন্য বাংলাদেশ দেখেছে। ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে একদল তরুণ গবেষক পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন পরবর্তী সাফল্য হিসেবে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা পাট ও ছত্রাকের জিনগুলো শনাক্ত করেছেন। পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রথম ইউনিটের লাইসেন্স প্রাপ্তির মধ্যদিয়ে নিউক্লিয়ার নেশন হিসেবে বিশ্ব পরমাণু ক্লাবেও যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। ক্রয়ক্ষমতা, উৎপানশীলতার সাথে গর্ব করার মতো আশা জাগানিয়া আরো অনেক তথ্য রয়েছে আমাদের।

Advertisement

বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম চাল উৎপাদনকারী দেশ। ফলের ফলনও ঈর্ষণীয়। ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ, আম উৎপাদনে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে বাংলাদেশ। মাছ উৎপাদনেও চতুর্থ অবস্থান। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারক দেশের দাবিও করি। সারাবিশ্ব তা জানে। মানে। দেশি-বিদেশি অনেক অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ, বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের অভিমতেও আমাদের অর্জনের বিস্তর স্বীকৃতি রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক মোড়কে, কিসের মধ্যে কী পান্তা ভাতে কী স্টাইলে প্রচার করতে গিয়ে লেজেগোবরে করে ফেলা হচ্ছে অর্জনগুলোকে। এ সুযোগে সুবিধা বা জুইত মতো জরিপ-গবেষণার লোকাল গেমের বাজার আবার বেশ গরম।

বিভিন্ন দলকে জেতানো-হারানোর এ গেম নিয়ে মানুষের গরজ কম থাকলেও আলোচনার খোরাক হিসেবে মন্দ নয়। এর ফাঁকে মাঝেমধ্যে রাজনীতির বাইরেও নানান বিষয়েও মাথা ঢুকাচ্ছেন দেশি-বিদেশি জরিপকারক-গবেষকরা। কাস্টমার বুঝে তারা বাংলাদেশকে পেয়ে বসেছে আচ্ছা মতো। বেশ আদর-কদরও পাচ্ছে। এদিকে, নয় অন্যদিকে। জরিপ তৈরি ও প্রচারকারী প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাগুলোর সঙ্গে কার কি কানেকশন সেইসব তিতা-মিঠা কথাও চাপা থাকছে না। এরপরও বাজার ভালো। সামনে তাদের মৌসুম আরো জমে ওঠার লক্ষণ স্পষ্ট।

জরিপ মন মতো হলে বেদম খুশি। ধুমছে প্রচার। আর বিপক্ষে গেলে বেজার। এর তথ্য ও ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন। আর জরিপকারীদের গোষ্ঠি উদ্ধার। প্রতিষ্ঠানটির চরিত্র হনন। সম্ভব হলে এ নামে কোনো প্রতিষ্ঠানই নেই তা প্রমাণের চেষ্টা।

Advertisement

ইউনেস্কোর মতো প্রতিষ্ঠানও এ ধকল থেকে রক্ষা পায়নি। বাংলাদেশের কোনো কোনো বিষয়ে জরিপ, মতামত বা তথ্য দিয়ে কয়েকবারই আপদে পড়েছে জাতিসংঘের এ সংস্থাটি। মাস কয়েক আগে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়ে ক্ষমতাসীন মহলে যারপরনাই মারহাবা পেয়েছে ইউনেস্কো। বিএনপিসহ সরকারবিরোধী মহলের কাছে তা ভালো লাগেনি। মুখ খুলে না বললেও গা জ্বলেছে তাদের। আবার এই ইউনেস্কোই এর আগে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পকে ক্ষতিকর বলায় তারা খুশিতে বগল বাজিয়েছে। দিয়েছে জিন্দাবাদ। আর সরকার ও আওয়ামী লীগ থেকে তখন ইউনেস্কোকে দেয়া হয়েছে মুর্দাবাদ। বিএনপি-জামায়াত, পাকিস্তান ও রাজাকারের এজেন্টের কলঙ্ক শিরোপা। চাইলে দশমিকের অংকসহ এমন তথ্য-তত্বও পাওয়া যায়।

নকলে, কোচিংয়ে, নোট–গাইডে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ছারখার হয়ে গেছে- এ মর্মে তথ্যসহ জরিপ রয়েছে। এ নিয়ে সেমিনার, গোলটেবিলের শেষ নেই। গবেষণা রিপোর্টও প্রকাশ হয়েছে। এর পাল্টা আরো জোরালো গবেষণাও যে রয়েছে? যুক্তি- তথ্য-তত্ব দুদিকেই কড়া। এ সরকারের আমলে কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। সব গুজব! আর অপপ্রচার। সরকার ও শিক্ষা ব্যবস্থাও জিপিএ ফাইভ মানের। শিক্ষার মান বাড়ার কারণেই পাস এবং জিপিএ বাড়ে। আবার শিক্ষার মানের সঙ্গে কড়াকড়ি বাড়ায় কোনো কোনো বছর পাস ও জিপিএ কমে। শিক্ষার মানের সঙ্গে শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকদের মনের আনন্দ ও শারীরিক সাচ্ছন্দ্য বেড়েছে। তা যারা দেখবে না, মানবে না তারা অন্ধ, নইলে জ্ঞানপাপী।

কেবল শিক্ষা নয়। অশিক্ষা নিয়েও। কোন দল বা কোন নেতার পরিবারে শিক্ষার হার ও মান বেশি- এ সংক্রান্ত ছোটখাট জরিপ মাঝেমধ্যেই প্রচার হচ্ছে। স্বাস্থ্য, অসুখ-বিসুখ, সুখ-শান্তি, বাসস্থান, নিরাপত্তা ইত্যাদি নিয়েও জরিপের কমতি নেই। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম শান্তিপূর্ণ দেশ এমন জরিপ এসেছে বেশ কবার। আগে-পরে এসেছে একেবারে উল্টা জরিপও। বিশ্বের নিরাপদ শহরের মধ্যে বিভিন্ন অবস্থানে ঢাকার নাম এসেছে অনেকবার। সামান্য নয়, বিশাল তফাৎ এসব জরিপের ফলাফলে।

কোনোটির তথ্য মতে, রোজ কেয়ামত খুব কাছেই। ঢাকা বা বাংলাদেশে থাকলে কদিনের মধ্যেই দম-নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যু নিশ্চিত। আবার কোনো কোনোটির রেটিং বা তথ্য বিশ্বাস করলে বিপদ অবধারিত। সুইজারল্যান্ড, জাপান, কানাডা ছেড়ে শান্তির আশায় বাংলাদেশে চলে আসার লালসা সামলানো কঠিন হবে। সেইক্ষেত্রে অর্জনগুলোকে অর্জনের খাতায়ই রাখা দরকার। ভাড়াটে বা অতি উৎসাহী জরিপকারক, মতলবি প্রচারক দিয়ে অর্জনগুলোকে বিসর্জনের স্রোতে ঠেলে দেয়ার রোগ সারানো জরুরি।

Advertisement

মাথা পিছু আয় বৃদ্ধির জরিপ, গবেষণা ও গড়ের অংক নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা অনেক দিনের। তা কমে বা কমছে এমন তথ্য নাইয়ের খাতায় চলে গেছে কবেই। এবারও বেশ বেড়েছে। এ বিষয়ে একটি রসঘন কিন্তু নির্মম জোকস উল্লেখের লোভ সামলানো যাচ্ছে না। এক টোকাই তার নিয়মিত এক দাতাকে প্রশ্ন করেছে- আচ্ছা স্যার, এই যে সবসময় শুনিচ্ছি যে আমারে গড় আয় অনেক বাড়িছে। তা সেই গড় আয় কী জিনিস? ঐডা তো দেখতি পাই না।

ভদ্রলোকের জবাব: ধর তোর দৈনিক আয় ৪০০ টাকা। আর আমার ১০ লাখ টাকা। তাহলে আমাদের দুজনের দৈনিক মোট আয় হচ্ছে ১০ লাখ ৪০০ টাকা। একে দুই দিয়ে ভাগ করতে হবে। তাহলে পাওয়া যায় ৫ লাখ ২০০ টাকা। সেই হিসাবে তোর দৈনিক গড় আয় ৫ লাখ ২০০ টাকা। আমারও তাই।

এমন জবাব ও অংকে মুখ ভ্যাংচায় টোকাই। বলেই বসে: ধূর, কী কন! আমার ডেলি ইনকাম ৫ লাখ ২০০ টাকা! ধুর। ধনাঢ্য দাতার পরামর্শ: ধূর বললে তো হবে নারে মদনা। এটাই সত্যি। এটাই অংক। গড়ের হিসাব এভাবেই হয়। তোর দৈনিক ইনকাম অবশ্যই ৫ লাখ ২০০ টাকা। তা না মানলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অপরাধে তোর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলাও হতে পারে।

মাথাপিছু আয়ের মতো বেকার-আকারের জরিপ নিয়েও রয়েছে কিছু তথ্যমালা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৫-১৬ অনুসারে দেশে বর্তমানে বেকার সংখ্যা ২৬ লাখ। তাদের মধ্যে পুরুষ ১৪ লাখ। আর নারী ১২ লাখ। এ তথ্য তো জনসংখ্যাকে জনসম্পদ বলে আত্মতুষ্টির সঙ্গে যায় না। কিন্তু সংখ্যাটা আসলে কতো? ২৬ লাখই? বাকিদের কর্মসংস্থান বা চাকরি হয়ে গেছে? বিশ্বব্যাংক মনে করে, সরকার কম দেখালেও প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। এ হিসাবে ২ কোটি ২ লাখ লোক বেকার। তারওপর এখন প্রতিবছর শ্রমবাজারে নতুন করে যোগ হচ্ছে ১৩ লাখ। আইএলওর হিসাবে ২০১৫ সালে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। বেকারত্ব বাড়ছে এমন ২০টি দেশের তালিকার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্যমতে, গত এক দশকে বাংলাদেশে বেকারত্ব বেড়েছে ১ দশমিক ৬ শতাংশ হারে। সেই হারে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার কমেছে ২ শতাংশ। অর্থাৎ কর্মক্ষম মানুষের বৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থান কমতির হার বেশি। এভাবে চলতে থাকলে বেকারত্বের বোঝা আরও ভারি হবে। তাদের মতে, বাংলাদেশে বেকারত্ব বাড়ার হার ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। প্রতিবছর শ্রমবাজারে ঢুকছে প্রায় ২৭ লাখ। এর মধ্যে চাকরি পাচ্ছেন মাত্র ৭ শতাংশ, অর্থাৎ ১ লাখ ৯০ হাজার। বাকি প্রায় ২৫ লাখ বেকারই থাকছে। এদিকে, ইকোনমিস্ট-এর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। দক্ষিণ এশিয়ায় এর চেয়ে বেশি উচ্চশিক্ষিত বেকার আছেন কেবল আফগানিস্তানে, ৬৫ শতাংশ।

এর বাইরে ভারতে এর হার ৩৩ শতাংশ, নেপালে ২০ শতাংশের বেশি, পাকিস্তানে ২৮ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। দেশের অর্থনীতির আকার বাড়ছে। কম-বেশি বিনিয়োগও বাড়ছে। তবুও ব্যাপক সংখ্যক উচ্চশিক্ষিত বেকার। ক্রমবর্ধমান উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিনিয়োগ হচ্ছে না। অন্যদিকে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিতের ৯০ শতাংশই সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত, যার সঙ্গে শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার কোনো সম্পর্ক থাকে না। ফলে দেশের সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থানের জোগানদাতা বেসরকারি খাত তাদের ধারণ করতে পারছে না। অনিবার্য কারণেই চাপ পড়ছে সরকারি খাতে। যার জোগান নিশ্চিত করা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।

যথেচ্ছা জরিপবাজির রেশ না টানার কারণে জরিপ, গবেষণার সত্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সত্য তথ্যও সন্দেহে পড়ছে। গবেষণা ও গড়ের অংক নিয়ে আজেবাজে কথা রটছে। সিলেটের কৈলাশটিলায় চারটি, হরিপুরে তিনটি এবং রশিদপুরে ১০টিসহ মোট ১৭টি কূপ নিয়েও রয়েছে নানা কিছিমের তথ্য ও জরিপ। এরপরও ১৭টি কূপের কোথায় কি পরিমাণ তেল-গ্যাস রয়েছে, এখনো খোলাসা কোনো ধারণা পায়নি মানুষ। কেন এসব তথ্য দেয়া জরুরি হয়? কী এর উদ্দেশ্য? আগ বাড়িয়ে অজ্ঞাত কারণে সময়ে-অসময়ে এসব গবেষণা প্রচারকারীদের ব্যাপারেও তথ্য-সাবুদ রাখা দরকার।

দেশিদের সঙ্গে বিদেশিদেরও হায়ার করা হচ্ছে এ কাজে। আমাদের আলো-বাতাস, পানি নিয়েও তারা মাঝেমধ্যে ভয়ানক গবেষণা তথ্য ছড়ান। এতে আগামীকাল পর্যন্ত কতোজন বাঁচবে সেই শঙ্কার জন্ম হয়। ঠিক এর উল্টো রিপোর্টও বাজারজাত হচ্ছে। আরেকদল পারলে তারা তথ্য দেন, বাংলাদেশ এখন একজন হতদরিদ্রও নেই। অর্থনীতিবিদরা দারিদ্র্যসীমার নিচে লোকজন খুঁজতে গিয়ে থ হয়ে যাচ্ছেন। তাদের ক্যালকুলেটরে ধর্তব্যের মধ্যে কোনো সংখ্যাই আসছে না। গ্রাম আর শহরের জীবনযাত্রার মানে কোনো তফাতই নেই। সহস্রাব্দ উন্নয়ন টার্গেট পূরণে সরকার নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই অতিরিক্ত ৯২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার জোগান দিয়ে ফেলেছে।

জরিপ আর গবেষণার এই সর্বনাশা সিডরে চুম্বন পর্যন্ত বাদ পড়ছে না। চুম্বন না-কি মারণব্যাধি ভাইরাস ছড়ায়। জরিপটির সারাংশ হচ্ছে, বিশ্বে চুমোচুমি বেড়ে গেছে। এতে মানবদেহে পাপিললোমা নামের ভাইরাস ছড়িয়ে যাচ্ছে সুনামির মতো। বিশ্বসেরা চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে জরিপে বলা হয়েছে, এ ভাইরাসে পেলে শুরুতে মাথা ও ঘাড়ে ক্যান্সার হবে । এরপরই মরণ।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/আরআইপি