বিশেষ প্রতিবেদন

শিক্ষার বৈষম্যকে প্রতিপালন করছে রাষ্ট্রই

অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক,ঔপন্যাসিক। অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইংরেজি বিভাগে। শিক্ষক আন্দোলন, প্রশ্নপত্র ফাঁস, কোচিং বাণিজ্য, দুর্নীতিসহ শিক্ষা খাতের নানা বিষয় নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হয়েছিলেন জাগো নিউজের সঙ্গে। শিক্ষা নিয়ে রাষ্ট্রের পশ্চাদপদ চিন্তাই জাতিকে পেছনে ঠেলছে বলে মত দেন। উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, শিক্ষার উন্নয়ন ঘটাতে হলে অবশ্যই বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সংবিধানের আলোকে এবং শিক্ষানীতির সঠিক বাস্তবায়ন করতে না পারলে অন্ধকার আরও ঘনীভূত হবে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু। আজ থাকছে প্রথম পর্ব।

Advertisement

জাগো নিউজ : বেতন বৈষম্য কমিয়ে আনতে শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন। স্বাধীনতার অর্ধশত বছরেও এমন আন্দোলন! শিক্ষা নিয়ে আমাদের কোথায় যাওয়ার কথা ছিল, যেতে পারলাম কোথায়?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আমাদের কোথায় যাওয়ার কথা ছিল, তার অনেকগুলো দিক নির্দেশনা তৈরি ছিল। সংবিধানে যে ধরনের শিক্ষার কথা বলা আছে, তা অত্যন্ত অগ্রসরমূলক চিন্তা বলে মনে করি। সংবিধানে একমুখী এবং সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থার কথা আছে। সবার জন্য শিক্ষা অধিকার থাকবে, তা সংবিধান নিশ্চিত করেছে। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনও একটি অগ্রগামী চিন্তা ছিল। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর সে প্রতিবেদনও বাতিল করল। ওই সময়ের সরকার নিজেদের চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়ে শিক্ষার বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে থাকল।

ওই সময়েই সংবিধানের মৌলিক আদর্শগুলো বাধাগ্রস্ত হতে থাকল এবং একমুখী শিক্ষার পরিবর্তে চারমুখী শিক্ষার প্রবর্তন শুরু হলো। আশির দশকে এ ধারা তীব্র হলো। ওই সময়ে প্রতিষ্ঠা পেল ধনীর সন্তানেরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়বে। মধ্যম আয়ের পরিবারের সন্তানেরা পড়বে সাধারণ শিক্ষায়। আর হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা পড়বে মাদরাসায়। শিক্ষায় এ শ্রেণিগত বিভাজন সর্বনাশ ডেকে আনলো। অভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা না থাকার কারণেই সমাজে বৈষম্য বাড়ছে এবং শিক্ষার মান কমছে।

Advertisement

জাগো নিউজ : তার মানে শিক্ষার সঙ্কটের জন্য রাষ্ট্রই প্রধানত দায়ী?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : রাষ্ট্র ক্রমাগতভাবে শিক্ষা খাতের বৈষম্যধারাকে পুষ্ট করেছে। শিক্ষার বৈষম্যকে প্রতিপালন করছে রাষ্ট্রই। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা হয়তো ইংরেজি ভালো জানছে। কিন্তু বাংলাসহ অন্যন্য বিষয়ে খুবই দুর্বল। আমি দেখেছি, ইংরেজি মাধ্যমে যে ইতিহাস পড়ানো হয়, তা ভারতীয় ইতিহাস। সেখানে বাংলাদেশের কোনো স্থান নেই। বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস যদি শিক্ষার্থীদের না পড়ানো হয়, তাহলে সে শিক্ষার্থীরা কীভাবে দেশপ্রেম শিখবে।

আবার বাংলা মাধ্যমও যে খুব ভালো হচ্ছে তা নয়। আমাদের সময় বাংলা এবং ইংরেজি দুটোই চমৎকারভাবে পড়ানো হতো। এখন বাংলা, ইংরেজি কোনোটিই ভালো না। মাদরাসায় আরবি ভালোভাবে শিখানো হয়। কিন্তু বাংলা, ইংরেজি ভালো শেখানো হয় না। আবার গণিতেও কাঁচা।

চার ধাপের যে শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, তার মধ্যে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরাই বেশি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে থেকে দেশের সেবা করার মনোবৃত্তি কিন্তু তাদের মধ্যে কম।

Advertisement

ইংরেজি মাধ্যমে থেকে বের হয়ে বিদেশে চলে যাওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়। পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বৈষম্য আছে। পলিটেকনিক এবং ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের প্রতি অবজ্ঞা আছে। সব খানেই বিভাজন।

জাগো নিউজ : এর জন্য শিক্ষানীতিকে কতটুকু দায়ী করবেন?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : ২০১০ সালের শিক্ষানীতি অনেকটাই কুদরাদ-ই-খুদার শিক্ষার আলোকে হয়েছে বলে মনে করি। মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়নের কথা বলা আছে। গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে একটি ভালো শিক্ষানীতি বলেই আমি মনে করি। কিন্তু প্রয়োগ তো দেখছি না। শিক্ষার প্রসার ঘটেছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। নারী শিক্ষায় বড় অগ্রগতি হয়েছে এবং এটি আমাদের জন্য বিশাল অর্জন।

সমস্যা হচ্ছে, আমরা শিক্ষার মানের দিকে নজর দেইনি। আমরা শিক্ষার সৃজনশীলতাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছি। মুখস্ত নির্ভর সনদমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হয়েছি। কোচিং বাণিজ্য মূলধারার শিক্ষার সমান্তরালে যাচ্ছে। শ্রেণিকক্ষকে পাশ কাটিয়ে কোচিংমুখী হচ্ছে শিক্ষা। বাণিজ্যিক ধারার শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি হলে তখন নির্ভর করতে হয় পরীক্ষার ওপর। পরীক্ষা যদি পাবলিক হয় তাহলে পাসের জন্য আরও তাড়া থাকে।

২০১০ সালের শিক্ষানীতি তৈরি করল সরকার, অথচ ওই শিক্ষানীতিকে পাশ কাটিয়েই পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণির দুটি পাবলিক পরীক্ষা চালু করল। এতে করে কোচিং বাণিজ্য এখন গ্রাম পর্যায়ে চলে গেছে এবং প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হচ্ছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় চরম দুর্নীতি ঢুকেছে, অনৈতিকতার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। শিক্ষকরা আনন্দ নির্ভর পাঠদানের চেয়ে মুখস্তনির্ভর শিক্ষা দান করছেন। এ কারণে সৃজনশীলতায় বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি হয়েছে। বিশ বছর আগেও প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তখন কোচিং বাণিজ্য গ্রামে যায়নি। তখন শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীলতা ছিল।

শিক্ষার্থীরা আর নিজস্ব চিন্তার বিকাশ ঘটাতে পারছে না। ক্রমাগতভাবে গণিতে খারাপ করা মানেই শিক্ষার্থীদের বুদ্ধির লোপ পাওয়া। অন্য বিষয় মুখস্ত করা গেলেও গণিত সেভাবে মুখস্ত যায় না। বিশ্ব দরবারে চ্যালেঞ্জ দেয়ার মতো শিক্ষা হচ্ছে না, আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জও নিতে পারছেন না। এমনকি দেশের বাজারেও চ্যালেঞ্জ নিতে পারছেন না।

দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের ঘরে। অথচ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর সুপার ম্যানেজার দেশের বাইরে থেকে আসা। ভারত, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া বা শ্রীলঙ্কা থেকে আসা মেধাবীরা এসব জায়গায় দায়িত্ব পালন করছেন। ৫ লাখ ভারতীয় বৈধভাবে বাংলাদেশে কাজ করছেন।

যারা আসছেন তারা ব্যবস্থাপনায় দক্ষ, যোগাযোগে দক্ষ, আত্মবিশ্বাসী, যা আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কমে আসছে। শিক্ষার চলমান সঙ্কটগুলোই এ নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

জাগো নিউজ : মেধার নিম্নগামীতা তো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) আমার ইংরেজি বিভাগে যারা ভর্তি হয়, আমি প্রায় পনের বছর থেকে তাদের একটি পরীক্ষা নেই এবং সেটা শুরুতেই। দশটি বাংলা বাক্য এবং দশটি ইংরেজি বাক্য লিখতে দেই। গভীরভাবে লক্ষ্য করছি, এ পরীক্ষায় দিনে দিনে খারাপ করছে শিক্ষার্থীরা। কোনো কালেই দশটি বাক্য কেউ শুদ্ধ লিখতে পারেনি। আগে হয়ত ছয় কি সাতটি ইংরেজি বাক্য শুদ্ধ লিখত। এখন দুটি কি তিনটি বাক্যও শুদ্ধ লিখতে পারে না। বাংলা আগে হয়ত কারো কারো আটটি কি সাতটি বাক্য শুদ্ধ হতো। এখন তিনটি, চারটিও শুদ্ধ হয় না। তার মানে মাতৃভাষাতেও অদক্ষ বা ভালোভাবে শিখতে পারছে না। অথচ তারা জিপিএ-৫ পেয়েছে, ভর্তি পরীক্ষায় অনেক নম্বর পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষকরাও একই কথা বলেন।

মেধার দিকে না তাকিয়ে রাষ্ট্র শিক্ষার্থীদের সনদ দেওয়ার ব্যবস্থা করছে। সনদ মিলছে পঞ্চম শ্রেণিতেও। এ সনদ দিয়ে কী হবে? এর চেয়ে সৃজনশীলতায় কিছুটা জ্ঞান দিতে পারলে শিক্ষার্থীদের কাজে আসত।

জাগো নিউজ : এ পরিস্থিতির মূলে কোনো বিষয়কে গুরুত্ব দেবেন?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : শিক্ষা খাত নিয়ে গতানুগতিক চিন্তা থেকে আমরা বের হতে পারিনি। শিক্ষকরা মোটামুটি হতদারিদ্র হবেন, এমন চিন্তা সমাজ এখন ধারণ করে। প্রাইমারি স্কুলের একজন সহকারী শিক্ষক শহীদ মিনারে অনশন করতে আসেন। ভাবুন, তাদের চাকরি জীবনের অর্জন নিয়ে। অবসরে যাওয়ার আগেও তারা সহকারী শিক্ষক হিসেবেই থেকে যান। কোনো পদোন্নতির সুযোগ নেই। এটি কল্পনা করা যায়? সহকারী সচিব থেকে সচিব হওয়ার সুযোগ না থাকতো তাহলে কী পরিস্থিতি দাঁড়াতো একবার কল্পনা করতে পারেন? অথবা ক্যাপ্টেন থেকে কেউ যদি আর উপরে উঠতে না পারতো, তাহলে সেটা সেনাবাহিনীর সদস্যরা মানতো?

যারা মানুষ গড়ার কারিগর, সারা জীবন তাদেরকে একই জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখলেন। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা যে বেতন পান, তার চেয়ে সরকারি অফিসের একজন ড্রাইভারের বেতন বেশি। জীবনে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য আজ শিক্ষকরা এমপিওভুক্তি চাইছেন, আমরণ অনশন করছেন। তারা বাঁচতে চায়, এটিই তাদের অপরাধ। রাষ্ট্র তাদের অনশনে ঠেলে দিয়েছে। এমপিওভুক্ত করতে ২ হাজার কোটি টাকা লাগবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অথচ সোনালী ব্যাংকের উদাও হয়ে যাওয়া চার হাজার কোটি টাকাকে অর্থমন্ত্রী টাকাই মনে করলেন না। দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এমপিওভুক্ত করার জন্য ২২বার শিক্ষকদের আশ্বাস দেয়া হলো।

শিক্ষকদের এমন একটি আন্দোলনই কি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার গলদ তুলে ধরে না? আমরা যে শিক্ষা ব্যবস্থাকে একেবারে অপাংতেয় করে রেখেছি, তার প্রমাণ মিলছে সম্প্রতি শিক্ষকদের আন্দোলন। ভালো শিক্ষক ছাড়া কোনোদিন ভালো শিক্ষার্থী তৈরি হবে না। আমরা বারবার বলে আসছি, শিক্ষকদের নিয়ে আলাদা কমিশন গঠন করুন। যোগদানের সময় জুনিয়র সহকারী শিক্ষক পদ থাকতে পারে। এরপর সহকারী, সিনিয়র সহকারী, সহকারী প্রধান, প্রধান শিক্ষক পদে ধাপে ধাপে প্রমোশন হতে পারে। এভাবে কাজের স্বীকৃতি পেলে তৃপ্তি মিলবেই। অথচ যোগদানের সময় যা, অবসরে যাওয়ার আগেও তা।

এএসএস/আরএস/আরআইপি