ধর্ম

তাবলিগের নেতৃত্ব জটিলতায় বিশ্বব্যাপী মতবিরোধ বাড়ছে

তাবলিগ জামাতের সবচেয়ে বড় আয়োজন বিশ্ব-ইজতেমা বাংলাদেশের তুরাগ তীরে অনুষ্ঠিত হয়। আগামী ১২ জানুয়ারি শুরু হবে ৫৩তম বিশ্ব-ইজতেমা।

Advertisement

দিল্লির নিজামুদ্দিন মসজিদ থেকে শতবছর আগে হজরত ইলিয়াছ (রাহ.) তাবলিগ জামাতের মেহনত, প্রচার ও প্রসার শুরু হয়। তাবলিগের প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে তাঁর উত্তরসূরিরাই এ দাওয়াতি কাজের নেতৃত্ব ও আঞ্জাম দিয়ে আসছেন।

বিগত বছরগুলোতে টঙ্গীর তুরাগ তীরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব-ইজতেমায় নিজামুদ্দিন মারকাজের উত্তরসূরি মাওলানা ইউসুফ (রাহ.) থেকে শুরু করে মাওলানা জুবায়েরুল হাসান (রাহ.) অংশগ্রহণ, মেহনত করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছর আপত্তির মুখেও শেষ পর্যন্ত নিজামুদ্দিন মারকাযের উত্তরসূরি মাওলানা সাদ স্কান্ধলভী নসিহত ও দোয়া মোনাজাত পরিচালনা করেছেন।

তাবলিগ জামাতের অন্যতম শীর্ষ মুরুব্বি, দিল্লি নিজামুদ্দিনের জিম্মাদার মাওলানা সাদের কিছু বক্তব্য ও একক নেতৃত্বের প্রশ্নে বেশ কয়েক বছর যাবৎ দেওবন্দসহ বিশ্বের অনেক আলেম-ওলামা ও তাবলিগের মুরুব্বিদের মাঝে অসন্তোষ বিরাজ করছে।

Advertisement

এ কারণেই মাওলানা সাদ স্কান্ধলভীর নেতৃত্ব এবং এবার বিশ্ব-ইজতেমায় অংশগ্রহণ নিয়ে বিশ্বব্যাপী চলছে পক্ষ-বিপক্ষ, বক্তব্য-বিবৃতি, চিঠি আদান-প্রদান। বাংলাদেশেও তৈরি হয়েছে পক্ষ-বিপক্ষ মতামত।

এ সমস্যার সমাধান কল্পে বাংলাদেশ থেকে ভারতের দেওবন্দ এবং নিজামুদ্দিনসহ তাবলিগের অন্যান্য মারকাযে প্রতিনিধি পাঠানো হয়েছে।

প্রতিনিধি মারকায শুরা বৈঠকে মাওলানা সাদ স্কান্ধলভী ও মাওলানা ইবরাহিম দেওলা এ বছর বিশ্ব-ইজতেমায় না আসার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তবে তাদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি আসতে পারবে বলে মতামত ব্যক্ত করা হয়।

এরপর থেকেই বিশ্ব-ব্যাপী মাওলানা সাদ-এর পক্ষালম্বন ও দেওবন্দের সমর্থন ইত্যাদি ইস্যুতে বিশ্বব্যাপী চিঠি ও বিবৃতি বিনিময় শুরু হয়। এ বিতর্কে অংশ নেয়, কানাডা, আমেরিকা, সাউথ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশ।

Advertisement

কানাডা, ইন্দোনেশিয়া মাওলানা সাদের প্রতি সমর্থন জানালেও সাউথ আফ্রিকা দেওবন্দের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। তাছাড়া আমেরিকা চায় মতপার্থক্য না করে সুন্দর ও সুচারুরূপে ইজতেমা ও তাবলিগের দাওয়াতি কাজ পরিচালিত হোক।

মালয়েশিয়া থেকে দুটি মতামত পাওয়া গেছে। যার একটিতে মাওলানা সাদকে সমর্থক করে। আর অন্যটি বাংলাদেশের মতামতকে সমর্থন দিয়েছে। তারা এ সব দেশের চিঠিগুলো বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশে দ্বন্দ্ব নিরসনে গঠিত ওলামা কমিটির কাছে প্রেরণ করা হয়।

তবে মাওলানা সাদ স্কান্ধলভীর নেতৃত্ব ইস্যুতে বাংলাদেশে তাবলিগের কাকরাইল মারকাজও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যাদের এক পক্ষ মাওলানা সাদের একক নেতৃত্বের প্রতি আস্থা প্রকাশ করেন। আরেক পক্ষ দেওবন্দের অনাস্থার পতি সমর্থন জানিয়ে মাওলানা সাদের বিরোধিতা করে।

বিরোধীপক্ষের দাবি, মাওলানা সাদকে তার বিতর্কিত বক্তব্যের বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। প্রকাশ্যে ভুল স্বীকার করে তওবা করতে হবে। আর তাবলিগের দাওয়াতি কাজের পরিচালনায় নেতৃত্ব একক নয়, বরং তা হতে হবে শুরাভিত্তিক। যেভাবে তাবলিগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর মৃত্যুর পর শুরাভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় তাবলিগ চলে এসেছে, সেভাবেই চলবে।

তাবলিগ জামাতের বর্তমান দ্বন্দ্ব নিরসনে বাংলাদশেয় পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠিত হয়েছে। তাদের শুরাভিত্তিক পরামর্শক্রমে ভারতের মারকাজ ও দেওবন্দে প্রতিনিধি পাঠানো হয়। প্রতিনিধিদের তথ্য ও বাংলাদেশের আলেমদের মতামতের ভিত্তিতে ওলামা-মাশায়েখ মাওলানা সাদের না আসার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

উল্লেখ্য যে, গত ৭ জানুয়ারি যাত্রাবাড়িস্থ জামিয়া ইসলামিয়া দরুল উলুম মাদানিয়ায় ওলামায়ে কেরাম, কাকরাইল মারকাজের শুরা উপদেষ্টা ও ভারত সফরকারী প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

এ বৈঠকে কাকরাইলের শুরার উপদেষ্টা কমিটির যোগাযোগ ও সমন্বয়ের জিম্মাদার আল্লামা মাহমূদুল হাসান সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকে ২১ আলেম উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে ১৩ জন মাওলানা সাদ স্কান্ধলভীর না আসার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন।

তারা হলেন-বেফাকের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাওলানা আশরাফ আলী, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার মুহাদ্দিস মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক, তাবলিগের শুরা সদস্য মাওলানা মোহাম্মাদ যোবায়ের, মাওলানা মুহাম্মাদ হোসাইন ও মাওলানা ফারুক, বেফাকের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুস, আল্লামা আহমদ শফির প্রতিনিধি মাওলানা আনাস মাদানি, তাবলিগের শুরা সদস্য মাওলানা উমর ফারুক ও মাওলানা রবিউল হক, শাইখ জাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক মাওলানা মিজানুর রহমান সাঈদ, হাটহাজারী মাদরাসার মুফতি কেফায়াতুল্লাহ, আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসউদের প্রতিনিধি মাওলানা মুফতি মোহাম্মাদ আলী, ভারত সফরকারী প্রতিনিধি দলের সদস্য মুফতি মাহফুজুল হক।

তবে তারা নিজামুদ্দীন মারকাজের মুরব্বি মাওলানা সাদ ও মাওলানা ইউসুফ এবং নিজামুদ্দীনের বাইরের মাওলানা ইবরাহিম দেওলা ও মাওলানা আহমাদ লাট এই ৪ জনের পরিবর্তে তাদের পক্ষে প্রতিনিধি আসার ব্যাপারে মতামত দেন।

উপস্থিত বাকি ৭ জন মাওলানা সাদ স্কান্ধলভীর বিশ্ব-ইজতেমায় আসার পক্ষে মতামত প্রদান করেন। যারা আসার পক্ষে মতামত দেন তারা হলেন-

তাবলিগের শুরার সদস্য সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম, মাওলানা আবদুল হামিদ মাসুম, মুহাম্মাদ খান শাহাবুদ্দিন নাসিম, মাওলানা জিয়া বিন কাসেম, ইউনুস শিকদার, মাওলানা মোশাররফ হোসাইন ও আনওয়ার হোসাইন।

উক্ত সভায় বৈঠকের সভাপতি কাকরাইলের শুরার উপদেষ্টা কমিটির যোগাযোগ ও সমন্বয়কারী জিম্মাদার আল্লামা মাহমুদুল হাসান ২১ আলেমের সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে মাওলানা সাদ স্কান্ধলভীসহ উল্লেখিত ৪ জনের বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রণ না করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেন।

আলেমদের বৈঠকের এ সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গত ৭ জানুয়ারি রাতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের হাতে হস্তান্তর করা হয়।

এমএমএস/পিআর