৫ জানুয়ারি, বাংলাদেশের রাজনীতির এক অতি আলোচিত-সমালোচিত দিন। বিএনপি দিনটি পালন করে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে। তাদের দাবি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি প্রার্থীবিহীন, ভোটারবিহীন প্রহসনের নির্বাচনে আসলে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে। আর আওয়ামী লীগ দিনটি পালন করে ‘গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’ হিসেবে। তাদের দাবি, বিএনপি না আসলেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের কোনো বিকল্প ছিল না। ৫ জানুয়ারি নিয়ে দুই পক্ষের অবস্থানেই যথেষ্ট যুক্তি আছে।
Advertisement
বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় ছিল। কিন্তু সংবিধান সংশোধনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার সুযোগ এবং ইচ্ছা কোনোটাই ছিল না আওয়ামী লীগের। আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্রসহ অন্তত ৫টি মন্ত্রণালয় দিতে চাইলেও বিএনপি শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে যেতে রাজি হয়নি। আওয়ামী লীগও বিএনপির পেছনে সময় নষ্ট না করে জাতীয় পার্টিকে কৌশলে ম্যানেজ করে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন করিয়ে নেয়। আওয়ামী লীগের যুক্তিটা ছিল সহজ। বিএনপি নির্বাচনে না এলে তো তাদের কিছু করার নেই। সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থেই নির্বাচন অনিবার্য ছিল। নইলে ওয়ান ইলাভেনের পুনরাবৃত্তি হতে পারতো।
আওয়ামী লীগের দৃষ্টিতে অনিবার্য সেই নির্বাচন আইনের দৃষ্টিতে হয়তো সঠিক ছিল, কিন্তু নৈতিকভাবে খুব গ্রহণযোগ্য ছিল এমনটি বলা যাবে না। এটা আওয়ামী লীগও আড়ালে-আবডালে স্বীকার করে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার বলেছেন, আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হবে। তার মানে আগের নির্বাচনটি অত গ্রহণযোগ্য ছিল না। একতরফা নির্বাচন যেমন আওয়ামী লীগের জন্য ভালো ছিল না, তেমনি নির্বাচন বর্জন করাটাও ভুল ছিল বিএনপির জন্য। সেই ভুলটি বুঝতে অবশ্য বিএনপির একবছরেরও বেশি সময় লেগেছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করলেও প্রতিহত করতে পারেনি বিএনপি। ২০১৫ সালে সেই নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে টানা ৯২ দিন গোটা দেশকে অবরুদ্ধ করে রেখে, পেট্রল বোমা আর সন্ত্রাস চালিয়ে সেই ভুলের পাহাড়কে আরো উঁচু করে বিএনপি। এরপর অবশ্য বিএনপি স্বীকার না করলেও সন্ত্রাসের পথ ছেড়ে গঠনমূলক ধারায় ফিরে আসে। কিন্তু ফিরে এলেও অতীত সন্ত্রাসের দায়ে সরকারের কাছ থেকে যথেষ্ট গণতান্ত্রিক স্পেস পাচ্ছে না তারা।
Advertisement
অনেকে ভেবেছিলেন, ৫ জানুয়ারির মত একটা একতরফা, ভোটারবিহীন, এমনকি প্রার্থীবিহীন নড়বড়ে নির্বাচন দিয়ে আওয়ামী লীগ বেশিদূর যেতে পারবে না। কিন্তু সবার সব আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। নির্বাচন নড়বড়ে হলেও সরকার ছিল দৃঢ়। শেখ হাসিনা দলে, সরকারে, জাতীয় রাজনীতি, এমনকি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও নিজের এবং দেশের অবস্থান আগের চেয়েও অনেক দৃঢ় করেছেন। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে গঠিত সরকার দৃঢ় পায়েই পঞ্চম বছরে পা রাখছে।
আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতে মিলবে না। কিন্তু সবাইকেই নিজ নিজ মতপ্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। ‘গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’এ আওয়ামী লীগ ঢাকায় দুটি সমাবেশ করেছে, আসলে তারা সমাবেশ করেছে তিনটি। ঢাকা উত্তর-দক্ষিণের উদ্যোগে বনানী ও বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে দুটি আর ইসলামী পার্টির নামে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ। ৫ জানুয়ারি বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু পুলিশ বিএনপিকে অনুমতি না দিয়ে অখ্যাত ইসলামী পার্টিকে অনুমতি দেয়। সেই নামকাওয়াস্তে পার্টির সমাবেশে ৫ জন বক্তার মধ্যে ৪ জনই ছিলেন আওয়ামী লীগের। লোক এসেছিল কয়েকশ।
আর ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’এ বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তো দূরের কথা এমনকি তাদের অফিসের সামনেও সমাবেশ করতে দেয়া হয়নি। অনুমতি না দেয়ার জন্য পুলিশের যুক্তি ছিল, নয়াপল্টনে বিএনপির অফিসের সামনের রাস্তায় সমাবেশ করলে জনগণের ভোগান্তি হবে। গণমুখি পুলিশের ভাবনাটা অনেক ভালো, কিন্তু একতরফা। বিএনপি সমাবেশ করলেই বুঝি জনগণের ভোগান্তি হয়, আওয়ামী লীগ যে ঢাকায় দুটি সমাবেশ করলো; তাতে বুঝি জনগণের ভোগান্তি হয়নি?
আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’ হিসেবে পালন করে। কিন্তু দেশের একটি অন্যতম জনপ্রিয় দলকে সমাবেশ করতে না দিলে গণতন্ত্র রক্ষা হয় কিভাবে? একটি পত্রিকায় পড়লাম ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ এই বিশেষণে সরকারি দলের আপত্তি। বিএনপি কী বলবে, কী করবে, কোন দিবসকে কী নামে ডাকবে তাও আওয়ামী লীগ ঠিক করে দেবে? আর বিরুদ্ধ মতকে এভাবে পিষে রাখলে তো গণতন্ত্রকে হত্যাই করা হয় আসলে।
Advertisement
আরেক পত্রিকায় দেখলাম, ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্রা হত্যা দিবস’ নামে, বিএনপিকে কোনো সমাবেশ করতে দেয়া তো হবেই না। বরং টানা ৭ দিন রাজপথ দখল রাখবে আওয়ামী লীগ। রাজপথ দখল রাখার মানে তো পরিষ্কার- বিভিন্ন সংগঠনের নামে মিছিল-সমাবেশ করা হবে। আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে পুরোনো এবং গণমুখি দল। তারা কি জানে না, রাজপথ দখলের নামে একের পর মিছিল-সমাবেশ করলে আসলে জনগণের ভোগান্তি হয়। তাদের মিছিল-সমাবেশের কারণে সৃষ্ট জ্যামে বসে মানুষ কী ভাষায় তাদের গালিগালাজ করে, সেটা কি কখনো কান পেতে শুনেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
আওয়ামী লীগ রাজপথ দখলে রেখে মানুষকে বিরক্ত করবে, আর বিএনপি ঘরে বসে সেই নেগেটিভ সহানুভূতি পেয়ে যাবে। সমাবেশ করতে না দেয়ায় বিএনপি এমনিতেই অনেকের সহানুভূতি পেয়েছে। বিএনপি এখন অনেক কৌশলী। চাইলে হয়তো তারা সমাবেশ করতে না দেয়ার প্রতিবাদে নানা সহিংসতা চালাতে পারতো। তাতে নষ্ট হতো তাদের প্রতি জনগণের সহানুভূতি। তারা খুব কৌশলে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছে। আর অতীতে সন্ত্রাস করে দেখেছে, তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি। তাই রাজপথ দখলে রাখার মাথা মোটা কর্মসূচির আবেদন ফুরিয়েছে অনেক আগেই।
ডিজিটাল বাংলাদেশে এখন আর লাখ লাখ মানুষের জমায়েত করা কার্যকর কৌশল নয়। আওয়ামী লীগ হোক আর বিএনপি; রাজপথ নয়, ভাবতে হবে জনগণের হৃদয় দখল করার কর্মসূচি নিয়ে। নির্বাচন সামনে রেখে সেটাই হবে কার্যকর কৌশল।
৬ জানুয়ারি, ২০১৭probhash2000@gmail.com
এইচআর/এমএস