বিশেষ প্রতিবেদন

বেসরকারি মেডিকেল : তিন দশকেও আইন নেই, নীতিমালাতেই সর্বনাশ

রাজধানীসহ সারাদেশে ৯৫টি বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ পরিচালনার জন্য কোনো আইন নেই। বর্তমানে সারাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে ৬৯টি মেডিকেল কলেজ ও ২৬টি ডেন্টালসহ মোট ৯৫টি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ পরিচালিত হচ্ছে।

Advertisement

১৯৮৫ সালে দেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের মধ্য দিয়ে বেসরকারিভাবে মেডিকেল শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু সে সময় থেকে কোনো প্রকার বিধিবদ্ধ আইন না থাকা শুধু নীতিমালার ভিত্তিতেই এসব প্রতিষ্ঠান খেয়াল-খুশি মতো পরিচালিত হচ্ছে। এতে করে নিভৃতে দেশের চিকিৎসা শিক্ষার সর্বনাশ ঘটছে।

বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ স্থাপন নীতিমালা অনুসারে ৫০ আসনের নতুন যে কোনো বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্য মেট্রোপলিটন এলাকায় দুই একর এবং অন্য এলাকায় চার একর নিজস্ব জমি থাকতে হবে। সেই জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত কলেজের একাডেমিক ভবনে এক লাখ বর্গফুট এবং হাসপাতাল ভবনের জন্য এক লাখ বর্গফুট ফ্লোর স্পেস থাকতে হবে।

বেসরকারি ডেন্টাল কলেজের জন্য মেট্রোপলিটন এলাকায় দেড় একর ও অন্য এলাকায় চার একর নিজস্ব জমি থাকতে হবে। ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতালের ফ্লোর স্পেস এক লাখ বর্গফুট হতে হবে।

Advertisement

এছাড়া বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত হবে ১:১০। শিক্ষকদের নিয়োগ, যোগ্যতা, মেয়াদ ও অন্যান্য শর্ত নির্ধারিত হবে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের বিধিবিধান অনুযায়ী। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ দিতে হবে সার্বক্ষণিক।

তবে নীতিমালা থাকলেও আইন না থাকায় অধিকাংশ বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলো এখন চলছে যেমন খুশি তেমন স্টাইলে- এ অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

বর্তমানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রস্তুতকৃত মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ স্থাপন নীতিমালার ভিত্তিতে এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতর বিভিন্ন সময় নানা অভিযোগে একাধিক কলেজ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু বেসরকারি এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য কোনো আইন নেই বলে তারা আদালতে গিয়ে পার পাচ্ছে বারবার।

Advertisement

চিকিৎসা শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, সুনির্দিষ্ট আইন না থাকাতেই দেশে চিকিৎসা শিক্ষার নিরব সর্বনাশ ঘটছে। গত কয়েক বছর ধরেই বেশ কিছু মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ নীতিমালা কিংবা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো শিক্ষার্থী ভর্তি করছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভর্তি স্থগিতসহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলেও প্রতিটি কলেজ কর্তৃপক্ষ উচ্চ আদালতে রিট করে অবৈধ কার্যক্রম বৈধ করে নেয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের দুই দফায় মোট নয় বছরের শাসনামলে বেশ কয়েকবার বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ স্থাপন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।

সর্বশেষ ‘বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা আইন, ২০১৩’-এর খসড়া করে সংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া হয়। কিন্তু এ সংক্রান্ত একটি কমিটি থাকলেও তারা গত দুই বছরের মধ্যে মাত্র দু’একটি সভা করেছে। মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ স্থাপন নীতিমালা অনুসারে যে কোনো নতুন মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ স্থাপনের আগে ৫০ আসনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, শিক্ষক, শিক্ষা উপকরণ, ২৫০ শয্যার হাসপাতাল ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক রোগী থাকার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু একশ্রেণির অর্থলোভী লগ্নিকারক নীতিমালা ভেঙে বিভিন্নভাবে বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ তৈরি করে তা পরিচালনা করে আসছে।

এর সুযোগ নিয়েই প্রতি বছর এমবিবিএস কোর্সে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে নীতিমালা মেনে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশনা অনুযায়ী জাতীয় মেধাতালিকার ভিত্তিতে ভর্তি না করে নিজেদের ইচ্ছামতো শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। এতে করে মেধা যাচাই না করে শুধু টাকার জোরে মেডিকেলে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে অনুপযুক্তরা।

১৯৮৫ সালে রাজধানীতে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ স্থাপনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে মেডিকেল শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। ওই সময় হাতে গোণা দুই চারটি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ থাকায় নতুন নিয়ম প্রণীত হয়নি।

অভিযোগ আছে, বেশ কিছু কলেজের নিজস্ব জায়গা ও হাসপাতাল নেই। পর্যাপ্তসংখ্যক প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত শিক্ষকও নেই। প্রায়োগিক শিক্ষার জন্য তারা রোগী দেখার সুযোগ পায় না। কিন্তু ভর্তির সময় শিক্ষীর্থীদের থেকে ইচ্ছামত ফি নেয়া হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর স্বাস্থ্য অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়ের কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

এদিকে, বর্তমান সরকারের মেয়াদেও নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে বেশ কয়েকটি মেডিকেল কলেজ অনুমোদন পেয়েছে।

এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য এলাকাভেদে জমির পরিমাণ, বরাদ্দকৃত জায়গা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, শিক্ষকদের যোগ্যতা ও নিয়োগ, মেয়াদ ও অন্যান্য শর্ত বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের বিধিবিধান অনুযায়ী হবে বলে আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে।

সরকারের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহ-উপাচার্য ও বিশিষ্ট চিকিৎসক রশীদ-ই-মাহবুব। তিনি বলেন, বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোর ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আইনটি হলে কিছুটা অন্তত লাভ হবে।

মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনার জন্য কোনো আইন নেই। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটি বিধি আছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (চিকিৎসা, শিক্ষা ও জনশক্তি উন্নয়ন) শাহ আবদুল লতিফ (অতি সম্প্রতি তাকে ওএসডি করা হয়েছে) বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতর বিভিন্ন সময় নানা অভিযোগে একাধিক কলেজ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার কোনো আ্ইন না থাকায় তারা আদালতে গিয়ে পাড় পাচ্ছে। কিন্তু নীতি অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার নেয়া কোনো বিধান নেই।

তিনি বলেন, আইনের খসড়া নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক আলোচনা হওয়া দরকার। বেসরকারি এসব কলেজ যেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত না হয়, সেই সুরক্ষা আইনে থাকতে হবে।

এমইউ/এসআর/পিআর