কিছুদিন মাত্র আগে হিমালয়ের কাছাকাছি বেড়াতে গিয়েছিলাম। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন গুছানো একটি শহর দার্জিলিং। পুরো শহরটা পাহাড় কেটে কেটে বানানো। এখানে ছেলেমেয়ে সমান তালে কাজ করে। প্রধান জীবিকা ট্যুরিজম। দার্জিলিংয়ে একটা ট্যুরিস্ট পয়েন্ট আছে টাইগার হিল নামে। টাইগার হিল থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড় দেখা যায় খুব ভালো করে। আমরা খুব ভোরে রওনা করেও কুয়াশার জন্য টাইগার হিলে পৌঁছুতে কিছুটা বেলা হয়ে যায়। তাপমাত্রা তখন প্লাস পাঁচ/ছয়।
Advertisement
আমরা শীতে অভ্যস্ত জাতি নই। এই তাপমাত্রাতেই শীতে হু হু করে কাঁপতে কাঁপতে দেখছিলাম সুবর্ণ পাহাড়ের অপরুপ রুপ। হঠাৎ একটা ইচ্ছে নিজের মধ্যেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। বুঝতে পারি সেটা প্রবল ভাবেই। ইচ্ছেটা, কাঞ্চনজঙ্ঘার সোনালী চূড়োকে ছুঁয়ে দেয়ার।
আমি নিমেষেই আকাশ পাতাল ভাবতে শুরু করলাম। এবং সিদ্ধান্তে পৌঁছুলাম, এ আমার কাজ নয়। যে মেয়ে পাহাড় চূড়ো ছুঁবে সে ছেলেবেলা থেকে অন্যরকমভাবে বড় হয়। সেই মেয়ে কোন বাধাকে মেনে নেবেনা। সেই মেয়েটি আচারের অচলায়াতনে বন্দী থাকবে না কিংবা অধরা বলে কোন শব্দ তার অভিধানে থাকবে না।
আমরা বাংলাদেশের মেয়েরা খুব ছোটবেলা থেকে একটা উপমা শুনে শুনে বড় হই। উপমাটি হলো, “লক্ষ্মী মেয়ে”। লক্ষ্মী মেয়েরা সকলের কথা শুনে, পড়াশুনা করে, ঘর গেরস্থালির কাজে তার মাকে সাহায্য করে অথবা ইন্ডিপেন্ডেন্টলি নিজেই গৃহস্থালি কাজকর্ম করে। তাদের পড়াশুনা করার উদ্দ্যেশ্য থাকে ঘর সংসারকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে পরিচালিত করা। সন্তানের ভালোমন্দের দেখভালের কথা জানার জন্যও বিএ এমএ পাস করা জরুরি।
Advertisement
লক্ষ্মী মেয়েরা কখনো সখনো দু’চার ছত্র রোমান্টিক কবিতাও লেখে, হারমোনিয়াম বাজিয়ে প্রতিবেশির গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে গান গায়। মুরুব্বি গোত্রীয়রা আহা আহা করে লক্ষ্মী মেয়েটির প্রশংসা করে আর মনে মনে ছেলের বৌ বানিয়ে ঘরে তোলার স্বপ্নবীজ বপন করে। মেয়েটি একদিন লক্ষ্মী মেয়ের খোলস বদলিয়ে লক্ষ্মী বউ হয়। শ্বশুর সাহেবের হাই ব্লাড প্রেসারের ওষুধ খাইয়ে দেয় ঠিকঠাক সময়ে। ছেলের টিফিনে নতুন নতুন রেসিপি। রাতে ডিনার পার্টির ষাটজন অতিথি হাত চাটতে চাটতে বাড়ি ছাড়বে। আর রাত ঘন হলে স্বামীর সামনে লক্ষ্মী বউটি তখন চন্দ্র মল্লিকার ঝার।
বছর দশেক পর মেয়েটি খাবারের বাক্স হাতে করে ছেলের এসএসসি পরীক্ষার হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। ছেলে পরীক্ষা শেষ করে হল থেকে বেরিয়ে এসে মাকে জরিয়ে ধরে বলে, “আম্মু তুমি লক্ষ্মী।” লক্ষ্মী মেয়েটি নিজের নাম হারিয়ে “লক্ষ্মীবউ” “সোনাবউ” হয়, “লক্ষ্মী আম্মু” হয়। দাদু দীদা হয় তারপর একদিন টুপ করে মরে যায়। তার নাম কেউ মনে রাখেনা কারণ শিক্ষালয় ছাড়ার পর থেকে তাকে কেউ আর নাম ধরেই ডাকে না।
কিছু কিছু মেয়ে এরকম হয় না। কিছু কিছু মেয়ের চোখে স্বপ্ন থাকে। পাথর ভাঙা স্বপ্ন। আটপৌরে জীবন তাকে টানেনা। সবাই তাকে হতচ্ছাড়া মেয়ে বলে গাল দেয়। আর হতচ্ছাড়া মেয়েটি যতই গাল খায় ততই সে তার হতচ্ছাড়া জীবনকে ভালোবাসতে থাকে, নিজের মানুষ জীবনকে ভালোবাসতে থাকে।
পড়ার বইগুলো তাকে আরো জানতে আগ্রহী করে। মেয়ে আরো আরো জানতে চায়। গুগল থেকে, উইকি থেকে। বরফের পাহাড় পায়ে দলে, ডাক্তারি বিদ্যাটা হাসিল করে, ক্যামেরা হাতে জ্বলন্ত পোশাক কারখানার লালাভ আগুনের একহাত দূরে থেকে ছবি তোলে। মিডিয়া, বিশ্ব, ক্ষুধা, দারিদ্র্য রক্তপাত সব কিছুকে মেয়েটি তার নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়। মেয়েটির অভিধানে “না” বলে কোন শব্দ তখন আর বর্তমান থাকে না।
Advertisement
মেয়েটির মার্কারি রঙা স্বপ্নগুলো সত্যি করা খুব সহজ কাজ নয়। বরং বলা যায় ভয়াবহ কঠিন। আজকাল প্রায়ই দেখা যায় আটদশজন ছেলে একসাথে কোথায় কোথায় ট্রাভেলে চলে যাচ্ছে! নিজেদের জানার বিস্তৃতি বাড়িয়ে চলছে। সেই একই ইচ্ছেতে মেয়েটি যখন একটা দুর্গম অঞ্চল ভ্রমণে যেতে চায় তখন তাকে বলা হয়, “তুমি মেয়ে, তুমি পারবে না।" মেয়েটির তখন সমাজ সংসারের দশজন মানুষকে প্রমাণ দিতে হয়, “আমি পারবো।"
পড়াশুনা শেষ করে মেয়েটি যখন কোন চ্যালেঞ্জিং পেশা বেছে নেয় তখন তাকে বলা হয়, “এটা ছেলেদের পেশা, তুমি পারবে না।" তাকে আবারো প্রমাণ দিতে হয়, “আমি পারবো।" কাজে নামার পর একশ পুরুষ কুংফু/কারাটা পোজে দাঁড়িয়ে থাকে বার বার মনে করিয়ে দিতে, “তুমি মেয়ে, এ তোমার কাজ নয়।" অথচ আসল কথাটি তারা বলেনা। আসল কথাটি হলো, “এ আমার জায়গা, তোমাকে ছেড়ে দেবো কেনো?” মেয়েগুলো খাবি খায়। কারো কারো স্বপ্ন ভেঙে যায়। ঘরের লক্ষ্মী মেয়ে ঘরে ফেরে। আর যে নস্যির মত এসকল বাধাকে গুঁড়িয়ে দিতে পারে, ফুঁয়ের মত বাতাসে উড়িয়ে দিতে পারে সেই মেয়েই এভারেস্ট জয় করে। সবাই পারেনা কিন্তু কেউ কেউ পারে।
বলছি না, সকল মেয়েকে এভারেস্টের চূড়া ছুঁয়ে দিতেই হবে। একশজনের মধ্যে অন্তত একজন স্বপ্নবাজ মেয়ের প্রয়োজন। সংখ্যাটা কোনদিন একে নেমে আসবে। আমি বিশ্বাস করি।
লেখক : সাহিত্যিক।
এইচআর/এমএস