হঠাৎ করেই আলোচনায় উঠে এলো একটি নাম। সরাসরি রাজনীতির মানুষ না হয়েও আওয়ামাী লীগ বা কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী না হয়েও তাকে মন্ত্রী করাতেই সবখানেই তাকে ঘিরে আলোচনা। পথে-ঘাটে, বাসে-ট্রেনে, চায়ের দোকানে গত পরশু থেকে উচ্চারিত হচ্ছে তার নাম। কে তিনি? কী করেন? কেন তাকে বিশেষভাবে মন্ত্রিত্ব দেয়া হলো?
Advertisement
অবাক হবার কিছু নেই। যে দেশে অনার্স পড়ুয়া শিক্ষার্থী জানে না ২১ ফেব্রুয়ারির মাহাত্ম, ২৬ মার্চের গুরুত্ব, সেদেশে বিজয় বাংলা কীবোর্ডের প্রতিষ্ঠাতা প্রযুক্তিবিদকে না চেনাটা দোষের মধ্যে ফেলা যায় না। তাই সবাই তাকে নিয়ে ঘাঁটছেন। জানার চেষ্টা করছেন তার নাম, পরিচয়, অসাধারণ কর্মজীবনের গল্প, ও কম্পিউটারে বাংলা লেখার অনন্য এক ইতিহাসের কথাও।
তিনি মোস্তাফা জব্বার। টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেয়েছেন নন্দিত এই প্রযুক্তিবিদ। ২ জানুয়ারি তিনি শপথ নেন মন্ত্রী হিসেবে। বুধবার ৩ জানুয়ারি তাকে ডাক, যোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
সহজ করে মোস্তাফা জব্বারকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় একজন বাংলাদেশি তথ্যপ্রযুক্তিবিদ হিসেবে। তাকে কম্পিউটারে বাংলা ভাষা যুক্ত করার পথপ্রদর্শক বলা হয়। তার প্রতিষ্ঠানের বিজয় বাংলা কিবোর্ড ১৯৮৮ সালে প্রকশিত হয়, যা প্রথম বাংলা কিবোর্ড এবং ইউনিকোড আসার পূর্বপর্যন্ত বহুল ব্যবহৃত হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ও সাধারণ বিষয়ের ওপর অনেকগুলো বইয়ের লেখকও তিনি।
Advertisement
তবে অনেকেই জানেন না তার অজানা এক অধ্যায়ের কথা। মোস্তাফা জব্বার পেশায় ছিলেন একজন সাংবাদিক। দেশ স্বাধীনের পরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থাতেই তিনি দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। একটা সময় তিনি চলচ্চিত্র সাংবাদিকতাতেও জড়িয়ে পড়েন। সিনেমাপাড়ায় মোস্তাফা জব্বার বহুল পরিচিত এক নাম।
মজার ব্যাপার হলো- চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা সম্পাদনার মধ্য দিয়েই প্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বারের উত্থান বলে মনে করেন অনেকে। এর আগ পর্যন্ত তার পরিচয় ছিল একজন তুখোড় ছাত্র রাজনীতিবিদ, জনপ্রিয় সাংবাদিক। কিন্তু ১৯৮৭ সালে ‘আনন্দপত্র’ নামে সিনেমা ম্যাগাজিন প্রকাশ করে কম্পিউটারে বাংলা লেখা প্রথম পত্রিকার যাত্রা শুরু করেন তিনি। আর সেই ইতিহাস সৃষ্টির মধ্য দিয়েই নিজেকে নিয়ে যান অন্য উচ্চতায়, পরিচিত হন ‘প্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার’ হিসেবে। যে পরিচয়ের হাত ধরে আজকের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী। যদিও নিজেকে তিনি প্রযুক্তিবিদের চেয়ে বাংলা ভাষার প্রেমিক ভাবতেই বেশি পছন্দ করেন।
২০১৬ সালের ৫ জুন ভোরের কাগজে নিজের লেখা এক কলামে মোস্তাফা জব্বার লিখেছিলেন, ‘সবাই জানেন ১৬ মে ১৯৮৭ তারিখে বাংলা সাপ্তাহিক আনন্দপত্র প্রকাশ করে আমি কম্পিউটার দিয়ে বাংলা পত্রিকা প্রকাশ করার যুগে প্রবেশ করি। তখন আমরা সৈয়দ মাইনুল হাসানের মাইনুল লিপি ব্যবহার করেছিলাম। মুনীর কি-বোর্ডকে অনুসরণ করে ৪ স্তরের কি-বোর্ড বানিয়েছিলাম যার নাম ছিল জব্বার-আমার বাবার নামে নাম। কিন্তু কি-বোর্ডটির সমস্যা ছিল ১৮৮টি বোতাম মুখস্থ রেখে বাংলা টাইপ করতে হতো। বিজয়ের জন্মের পেছনে প্রযুক্তিগত প্রধান কারণ এটি। টাইপ রাইটার, সিসার কম্পোজ বা ফটোটাইপ সেটারে বাংলা লিখতে গিয়ে অনুভব করেছি যে, রোমান কি-বোর্ড দিয়ে অবিকৃতভাবে বাংলা বর্ণমালা তৈরি করা সত্যি সত্যি এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। হাজার বছরের বাংলা ভাষার ইতিহাসে এই সংকট মোকাবেলায় বাংলা অক্ষর কমানো, যুক্তাক্ষর বর্জন, অর্ধবর্ণ ব্যবহার এবং রোমান বা আরবি হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগগুলোর অন্যতম একটি কারণ ছিল বাংলা যুক্তবর্ণ। আমি স্বপ্ন দেখতাম, কবে, কেমন করে এই যুক্তবর্ণের শেকল থেকে মুক্তি পাব। বিজয় সৃষ্টি করে সেই শেকলটা আমি ভেঙেছি।’
‘আনন্দপত্র’ পত্রিকাটি সম্পাদনার মধ্য দিয়ে একদিকে বাংলাদেশে একটা নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন মোস্তাফা জব্বার। পাশাপাশি, দারুণ এক ইতিহাসের সঙ্গে তিনি দেশের চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্র সাংবাদিকতাকেও জড়িয়ে দিয়েছেন। তার অসাধারণ এই ভূমিকার জন্য চ্যানেল আইয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রবর্তিত চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার উপর ফজলুল হক স্মৃতি পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছিলেন তিনি। ২০১৬ সালের ২৬ অক্টোবর তার হাতে পুরস্কার তুলে দেন ফজলুল হকের সহধর্মিণী ও বরেণ্য কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুন।
Advertisement
মন্ত্রিসভায় মোস্তাফা জব্বারের অন্তর্ভুক্তিতে দারুণ উচ্ছ্বসিত দেশের তরুণ সমাজ। উচ্ছ্বসিত জব্বারের পিতৃভিটা নেত্রকোনার খালিয়াজুরির আকাশ-বাতাস। তাকে মন্ত্রিসভায় দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন দেশের চলচ্চিত্র সাংবাদিকরাও। তাদের মতে, দেশের চলচ্চিত্রকে মনে-প্রাণে ভালোবাসতেন বলেই আশি-নব্বই দশকের নানা প্রতিকূল সময়ে তিনি শুধু চলচ্চিত্রের ওপর একটি রঙিন সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করার সাহস দেখিয়েছিলেন, উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার কাছে চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার অনেক ঋণ।
মোস্তাফা জব্বারকে অভিনন্দন জানিয়ে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির সভাপতি আবদুর রহমান বলেন, ‘সত্যি দারুণ এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দিলেন মোস্তাফা জব্বার। নিজের প্রতি সততা, বাংলা ভাষার প্রতি নিখাদ প্রেম তাকে এই সম্মান দান করেছে বলে মনে করি আমি। সেইসঙ্গে চলচ্চিত্র সাংবাদিকের মন্ত্রীপদে আসীন হওয়ায় চলচ্চিত্র সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে তাকে অভিনন্দিত করি। তিনি আমাদের গর্বিত করেছেন।’
মন্ত্রিসভায় মোস্তাফা জব্বারের ঠাঁই পাওয়ার গল্প যতবার এই দেশে উচ্চারিত হবে ততবার উচ্চারিত হবে চলচ্চিত্রবিষয়ক সাপ্তাহিক ‘আনন্দপত্র’ রঙিন পত্রিকাটির নাম, ততবারই উঠে আসবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার কথা।
প্রত্যয়ী, পরিশ্রমী, একাগ্র মানসিকতার মানুষ মোস্তাফা জব্বারের হাত ধরে আরও অনেক নন্দিত ইতিহাসের জন্ম হোক, তার হাত ধরে সাফল্য আসুক দেশের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে। অভিনন্দন মিস্টার মিনিস্টার।
এলএ/এমএস/এমএস