১৯৭৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর ‘বসুন্ধরা’ চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ইলিয়াস কাঞ্চনের প্রথম চলচ্চিত্র। বিপরীতে ছিলেন তখনকার মোস্ট গ্ল্যামারাস নায়িকা ববিতা। ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন সুভাষ দত্ত। ১৯৭৭ থেকে ২০১৭। গেল বছরের ৩১ ডিসেম্বর ৪০ বছরে পা রাখলো ইলিয়াস কাঞ্চনের চলচ্চিত্র জীবন। দিনটিকে বিশেষভাবে স্মরণ করতে একটি মিলনমেলার আয়োজন করেছিলেন এই নায়ক। রাজধানীর ঢাকা ক্লাবে গতকাল ১ জানুয়ারি সন্ধ্যার সেই আয়োজনে তার ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন চলচ্চিত্রের নানা প্রজন্মের মানুষেরা। সবাই ইলিয়াস কাঞ্চনকে চলচ্চিত্রের চল্লিশ বছরে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
Advertisement
আবেগঘন সেই সন্ধ্যায় তিন প্রজন্মের নায়ককে শুভেচ্ছা জানাতে হাজির হয়েছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুসহ চলচ্চিত্রের শতাধিক মানুষ। ফারুক, চম্পা, আহমেদ শরীফ, জাভেদ, কাজী হায়াৎ, মুশফিকুর রহমান গুলজার, সোহানুর রহমান সোহান, শাবনাজ, আমিন খান, শাবনূর, পপি, মিশা সওদাগর, জায়েদ খান, ফেরদৌস, পূর্ণিমা, ফাহমিদা নবীসহ ইলিয়াস কাঞ্চনের চলচ্চিত্র জীবনের প্রযোজক ও নির্মাতাদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানস্থল হয়ে উঠেছিলো এক টুকরো ফিল্মপাড়া।
অভিনন্দিত হয়ে নিজের বক্তব্য রাখতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে যান ইলিয়াস কাঞ্চন। তিনি কৃতজ্ঞতা জানান তাকে চলচ্চিত্রে নিয়ে আসা সুভাষ দত্তকে, তার প্রথম সিনেমার নায়িকা ববিতা ও ছবির কলাকুশলীদের। ঢাকাই চলচ্চিত্রের কাছে অনেক ঋণ স্বীকার কলে ‘কালপুরুষ’ ছবির এই নায়ক বলেন, ‘অনেক স্বপ্ন ছিলো অভিনয় নিয়ে। কিন্তু এতোবড় একটি জায়গায় কোনোদিন পৌঁছাতে পারবো আমি ভাবিনি। আপনারা অনেকেই বলে গেছেন, আল্লাহ আমাকে ইজ্জত দিয়েছেন। আমি আনন্দিত হই এইসব সুন্দর কথা শুনে। চলচ্চিত্র ইজ্জতেরই জায়গা। যদিও সাম্প্রতিক সময়টাতে এখানে ইজ্জতের অভাব দেখা দিয়েছে। দোয়া করি আল্লাহ আমাদের প্রিয় চলচ্চিত্রে আবার ইজ্জত ফিরিয়ে দিবেন। এখানে শান্তি, সুখ ও ব্যব্সার দিন ফিরবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দীর্ঘদিনের পথচলায় কতো ভালোবাসা পেয়েছি তার তুলনা নেই। আপনারা কেউ যদি আমার কাছ থেকে কোনো কষ্ট পেয়ে থাকেন মাফ করে দেবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন চলচ্চিত্রে এসেছি, আপনাদের সঙ্গে জীবন কাটিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি কিছুই শিখতে পারিনি। যা কিছু শিক্ষা আমার সবই এই চলচ্চিত্রে। মানবিকতা বলুন, প্রেম বলুন, সৌন্দর্য বলুন, রুচি বলুন, শিল্পই বলুন সব শিখিয়েছে চলচ্চিত্র। আমার এক জীবনে যা কিছু অর্জন তাও এই চলচ্চিত্রেই। আপনারা ভালোবেসে সেই সুযোগ করে দিয়েছেন বলেই আমি ইলিয়াস কাঞ্চন হতে পেরেছি। আর দেশের মানুষের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা নেই আমার। তারা আমাকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছেন ভালোবাসায়, এই প্রাপ্তিই আমাকে তৃপ্তি দেয়। তাই যেখানেই থাকি না কেন, এই চলচ্চিত্রের কাছেই আমার হৃদয় পড়ে থাকে।’
Advertisement
ইলিয়াস কাঞ্চন আরও বলেন, ‘আমি চলচ্চিত্র ছাড়া থাকতে পারি না। চল্লিশটি বছর কমতো নয়। এতগুলো দিন যেখানে, যাদের সঙ্গে কেটেছে তাদের ছাড়া কীভাবে থাকা যায়। আমার প্রযোজকেরা, নির্মাতারা, আমার প্রিয় চমৎকার সব নায়িকারা, সহশিল্পীরা, প্রতিটি ছবির টিম সদস্যরা- আমার কাছে অনেক ভালোবাসার। অনেকের সঙ্গে আজকাল যোগাযোগ নেই। কারো কারো কথা হঠাৎ মনে পড়ে। অনেকে চলে যাচ্ছেন পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে, কষ্ট পেয়ে নিরবে কাঁদি। রাজ্জাক ভাই চলে গেলেন গেল বছরে। মিজু ভাইও। আরও অনেকে নেই। সবাইকে ভালো রাখুন আল্লাহ।
কিন্তু এই চলচ্চিত্র ছেড়ে যেতে আমার ইচ্ছে করে না। কবিগুরুর কবিতার লাইনের মতোই আমার বারবার বলতে ইচ্ছে হয়, মরিতে চাই না আমি চলচ্চিত্রের ভুবনে। চলচ্চিত্রের কাছে চিরকাল থেকে যেতে চাই। মনে প্রাণে প্রত্যাশা করি চলচ্চিত্রের সংকট কেটে যাবে। আবারও সুদিন আসবে। আমরা যারা পুরনো হয়ে গেছি নতুন প্রজন্মের কাছে আবারও সবাই অভিনয়ে ফিরবো। অভিনয় করতে করতেই চলে যেতে চাই। এই দেশের চলচ্চিত্রে অনেক গুণী মানুষ রয়েছেন। তাদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেলে আমাদের একটা মজবুত প্রজন্ম গড়ে উঠবে বলে বিশ্বাস আমার।’
সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে কাঞ্চন বলেন, ‘আমার ডাকে আপনারা সাড়া দিয়ে যানজন ঠেলে এতদূর এসেছেন সেজন্য সবাইকে ধন্যবাদ। আমার জন্য দোয়া করবেন, আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন। আমিও আপনাদের জন্য দোয়া করি। সাবধানে পথ চলবেন। জীবন যাপন নিরাপদ হোক সবার।’
প্রসঙ্গত, ইলিয়াস কাঞ্চন ২৪ ডিসেম্বর ১৯৫৬ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার আশুতিয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা নাম হাজি আব্দুল আলী, মাতার নাম সরুফা খাতুন। তিনি ১৯৭৫ সালে কবি নজরুল সরকারি কলেজ থেকে এইসএসসি পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শুরু করলেও শেষ করেননি।
Advertisement
স্কুল জীবনেই অভিনয়ের সঙ্গে জড়িত। যোগ দেন থিয়েটারেও। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থাতেই চলচ্চিত্রে ডাক পান। সুভাষ দত্তের ‘বসুন্ধরা’ দিয়ে অভিষিক্ত হওয়া চিরসবুজ এই নায়ক প্রায় ৩৫০টিরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তিনিই একমাত্র নায়ক যিনি সত্তর দশকের নায়িকা শাবানা থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর পপি- এই চার প্রজন্মের নায়িকাদের বিপরীতে নায়ক হয়ে অভিনয় করেছেন। চম্পা, অঞ্জু ও দিতির সঙ্গে তার জনপ্রিয় জুটি গড়ে ওঠেছিল। তবে রোজিনা, রানী, সুনেত্রা, সুচরিতা, অরুণা বিশ্বাস, মৌসুমীদের সঙ্গেও সুপারহিট ছবি উপহার দিয়েছেন ইলিয়াস কাঞ্চন।
সর্বশেষ তার অভিনীত ‘হঠাৎ দেখা’ নামের একটি ছবি মুক্তি পায়। এই ছবিতে তার বিপরীতে অভিনয় করেছেন কলকাতার নন্দিত অভিনেত্রী দেবশ্রী রায়। যৌথ প্রযোজনার এই ছবিটি রবি ঠাকুরের হঠাৎ দেখা কবিতা অবলম্বনে নির্মাণ করেছেন রেশমী মিত্র ও সাহাদাত হোসেন।
রেশমী মিত্র, সাহাদাত হোসেন বিস্তারিত পড়ুন: http://www.bmdb.com.bd/movie/753/কপিরাইট © বাংলা মুভি ডেটাবেজপ্রযোজক হিসেবেও সফল ছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন। আর ‘বা আমার বাবা’ এবং ‘মায়ের স্বপ্ন’ নামে দুটি ছবি পরিচালনাও করেছেন ইলিয়াস কাঞ্চন।
এলএ