দেশজুড়ে

গবাদিপশুতে সাড়ে চার বছরে পাচার ১০ হাজার কোটি টাকা

গত সাড়ে চার বছরে রাজশাহী অঞ্চলের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ঢুকেছে প্রায় ২০ লাখ গবাদিপশু। গড়ে ৫০ হাজার টাকা করে এসব পশুর মূল্য পরিশোধ বাবদ ভারতে পাচার হয়েছে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, এখানো গবাদিপশু আমদানিতে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় কোনো লেনদেন নেই। পুরোটাই হচ্ছে চোরাচালানি-টু-চোরাচালানির মধ্যে। বিনিময়ে কখনো স্বর্ণ আবার কখনো হুন্ডিতে পাচার হচ্ছে অর্থ।

Advertisement

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সীমান্ত পথে ভারত থেকে গবাদিপশু আসে চোরাচালানের মাধ্যমে। মালিক থাকলেও কাগজ-কলমে মালিকবিহীন দেখিয়ে বিজিবি এসব পশু জব্দ দেখায়। পরে মালিক দাবি করে ৫০০ টাকা রাজস্ব দিয়ে বৈধ করে দেশের মধ্যে চালান করা হয়।

গরু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারতে একটি মাঝারি মানের গরুর দাম পড়ে ২০ থেকে ২৫ হাজার ভারতীয় রুপি। ছোট গরুর দাম অন্তত ১৫ থেকে ২০ হাজার রুপি। আর বড় গরু বা মহিষ একটি কিনতে গুনতে হয় ৩০ থেকে ৪০ হাজার ভারতীয় রুপি। ওপারের রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সিন্ডিকেট এ কারবার চালাচ্ছে। এ সিন্ডিকেট এজেন্টকে প্রতিটি গরু-মহিষে ঘুষ দিতে হয় ২০ হাজার টাকা করে।

সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আসার পর বিভিন্ন সিন্ডিকেটকে গরু প্রতি চাঁদা দিতে হয় আরো ৫ হাজার টাকা। কেনা থেকে শুরু করে সবমিলিয়ে প্রতিটি গরু- মহিষের দাম বাংলাদেশি টাকায় পড়ে ৫০ হাজার টাকা।

Advertisement

রাজশাহী কাস্টমস কমিশনার দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত রাজশাহী অঞ্চলের ৯টি করিডর দিয়ে সীমান্ত পথে ভারত থেকে গবাদি পশু এসেছে ১৮ লাখ ৮৫ হাজার ৩৮৯টি। একই সময় করিডর বা খাটালকে বাইপাস করে গবাদিপশু এসেছে আরো তিন লাখের উপরে। সবমিলিয়ে এতে ভারতে পাচার হয়েছে অন্তত দশ হাজার কোটি টাকা।

আর প্রতিটি ৫শ টাকা হিসাবে ১৮ লাখ ৮৫ হাজার ৩৮৯ গবাদিপশু থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ১শ কোটি ৭৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬শ টাকা। তবে দ্বিপাক্ষিয় লেনদেন অথবা টাকা পাঠানোর বৈধ চ্যানেল থাকলে রাজস্ব আয় বাড়তো আরো কয়েক গুন।

ব্যবসায়ীরা জানান, চোরাচালানে ওপারে বাংলাদেশি টাকার লেনদেন নেই। ফলে গবাদিপশুর মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে স্বর্ণ দিয়ে। এছাড়া অবৈধ অর্থ লেনদেনে এ অঞ্চলে হুন্ডি ব্যবসা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত বিভিন্ন সীমান্ত, হাট-ঘাটসহ গরুর হাটে দেড় শতাধিক হুন্ডি কারবারি প্রকাশ্যেই চালাচ্ছে টাকা পাচারের কাজ। অন্তত ১৫টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে প্রতিদিনই জমা হচ্ছে কয়েকশ কোটি হুন্ডির টাকা। চট্টগ্রাম ও দুবাই হয়ে এসব টাকা পাচার হচ্ছে ভারতে।

কথা ছিলো- বাংলাদেশ ব্যাংক যেকোনো আমদানি পণ্যের মূল্য পরিশোধ সংক্রান্ত নিয়মনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। নিয়ন্ত্রণ করবে অর্থ পাচার। অথচ হুন্ডিতে টাকা পাচারকারী ব্যাংকগুলোর সম্পর্কে জেনেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে শেকড় গভীরে গেছে অবৈধ এ কারবারের।

Advertisement

গত ১১ ডিসেম্বর রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে ১৫০ ভরি ওজনের ১৫টি স্বর্ণর বারসহ লিটন আলী শেখ (৩০) নামের এক পাচারকারীকে গ্রেফতার করা হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর রাজশাহী সদর ‘ক’ সার্কেলের একটি দল সীমান্তবর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জগামী যাত্রীবাহী বাস থেকে লিটনকে গ্রেফতার করে। পাচারের উদ্দেশে যাত্রীবেশে ঢাকা থেকে শরীরে বেঁধে স্বর্ণ নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।

লিটন জিজ্ঞাসাবাদে জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের রামচন্দ্রপুর গরুর হাটে এক হুন্ডি ব্যবসায়ীর কাছে এই স্বর্ণ হস্তান্তরের কথা ছিল। বিষয়টি তদন্তাধীন বলে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানাতে চাননি মাদক নিয়ন্ত্রণ বিভাগের কর্মকর্তারা। তাদের ভাষ্য, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত এখন স্বর্ণ পাচারের অন্যতম রুট। গরুর বদলে স্বর্ণ যাচ্ছে এই দুই জেলার সীমান্ত পথে।

একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, রাজশাহীর সিটি হাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জের রামচন্দ্রপুর হাট ও গোদাগাড়ীতে দেড় শতাধিক হুন্ডি কারবারি টাকা পাচারে যুক্ত। এরা গবাদিপশু বিক্রির টাকা জমা নিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় হুন্ডি চ্যানেলে টাকা দিচ্ছেন। পরে ভারতের মুর্শিদাবাদের উমরপুর, জঙ্গিপুর, লালগোলাসহ ও কলকাতায় গিয়ে জমা হচ্ছে এসব টাকা। সেখান থেকে টাকা তুলে চোরাচালানিরা গবাদিপশু কিনে দেশে পাঠাচ্ছেন। গবাদিপশু চোরাচালান বন্ধ না হলে হুন্ডি অথবা স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধ করা অসম্ভব।

এদিকে, রাজশাহী কাস্টমস কমিশনার দফতর জানিয়েছে, এখনো গবাদিপশু আসছে রাজশাহীর সুলতানগঞ্জ, রাজাবাড়ি, শ্যামপুর ও চারঘাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট, ভোলাহাট ও বাখেরআলী, নওগাঁর খঞ্জনপুর এবং জয়পুরহাটের কড়িয়া করিডর হয়ে। এর মধ্যে বাখেরআলী করিডর চালু ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে বন্ধ রয়েছে কড়িয়া করিডর।

এ ক'বছর সবচেয়ে বেশি ৮ লাখ ২০ হাজার ৪০০ গবাদিপশু এসেছে সুলতানগঞ্জ করিডর দিয়ে। এরপর যথাক্রমে কানসাটে ৬ লাখ ৭ হাজার ৮০০, রাজাবাড়িতে এক লাখ ৫৪ হাজার, ভোলাহাটে এক লাখ সাড়ে ৮ হাজার, খঞ্জনপুরে ৯৪ হাজার, শ্যামপুরে ৩৭ হাজার ৭০০, কড়িয়ায় ৩১ হাজার, বাখেরআলীতে ১৫ হাজার ৩০০ এবং চারঘাটে সাড়ে ১৪ হাজার গবাদিপশু ঢুকেছে।

কাস্টমস জানিয়েছে, গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এ নয় করিডোর হয়ে এসেছিল এক লাখ ৭ হাজার ৬৭৭টি পশু। তা থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৫ কোটি ৩৫ লাখ ৫০০ টাকা। পরের অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৮ কোটি ৮৬ লাখ ১৬ হাজার ৬০০ টাকা। সেবার পশু এসেছে এক লাখ ৭৭ হাজার ৭৮৯টি।

২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৬ লাখ ৭৯ হাজার ৬০৯টি পশুর বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয় ৪০ কোটি ৫৯ লাখ ১২ হাজার ৪০০ টাকা। পরের অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২৬ কোটি ১৩ লাখ ৫৭ হাজার ৪০০ টাকা। সেইবার পশু এসেছে ৫ লাখ ২২ হাজার ৭৬৪টি। গত জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের এ চার মাসে পশু এসেছে ৩ লাখ ৯৭ হাজার ১০৮টি। এর বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৯ কোটি ৮৫ লাখ ৫৯ হাজার ৭০০ টাকা।

এবিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক মাহমুদুল হাসান বলেন, গবাদিপশু কেনার টাকা কিভাবে ভারতে যাচ্ছে সেটা আমরা জানি না। তবে তা যে বৈধভাবে আনা হচ্ছে না, সেটা সবাই জানে। আইনের দৃষ্টিতে বিবেচনা করলে পুরোটাই অবৈধ। এতে দেশের টাকা বিদেশে যাচ্ছে।

দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে টাকা পাচারের কথা স্বীকার করেন রাজশাহী বিভাগীয় কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বলেন, গরু আমদানি হচ্ছে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তে। কিন্তু ওপারে এ কারবার পুরো অবৈধ। ফলে লেনদেনের স্বীকৃত কোনো মাধ্যম নেই। অবৈধভাবেই টাকা ভারতে পাচার হচ্ছে, এটা সবাই জানে। এখানে আমাদের কিছুই করার নেই।

ফেরদৌস সিদ্দিকী/এফএ/জেআইএম