বিদায়ী ২০১৭ বছরজুড়ে নারী নির্যাতন অব্যাহতভাবেই ছিল। তুলনামূলক বেড়েছে ধর্ষণ ও শিশু হত্যা। পারিবারিক কোন্দলে নিহতের সংখ্যাও আগের বছরের তুলনায় বেশি। আত্মহত্যাও বেড়েছে। মানুষের পারিবারিক, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় বাড়ছে, যা দেশের উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতি গত বছরের তুলনায় কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার পর্যালোচনায় এমনটি দাবি করা হয়েছে।
Advertisement
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার ২০১৭ সালের পর্যালোচনা সেল থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, শিশু হত্যা ও নির্যাতন : বিগত কয়েক বছরের মধ্যে ২০১৭ সালেই শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। এ বছর ৩৫২ জন শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে মা-বাবার হাতে নিহত হয় ৪২ জন শিশু। এছাড়াও বছরজুড়ে নির্যাতনের শিকার হয় ২১১ জন শিশু।
সংস্থার পর্যালোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জে অপহরণের পর দুই শিশুকে হত্যা করে প্রতিবেশী। পারিবারিক কলহের কারণে ছোট তিন ভাইবোনকে হত্যা করে আপন বড় ভাই। এপ্রিলে ঢাকার আশুলিয়ায় মাদকাসক্ত এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে পাঁচ বছরের এক শিশুকে যন্ত্রচাপা দিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠে। সেপ্টেম্বরে গাজীপুরে চুরির অভিযোগ এনে এক কিশোরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সিলেটে সাত বছরের এক শিশুকে গলা টিপে হত্যা করেন সৎমা।
ধর্ষণ : ২০১৭ সালে মোট ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭৯৫ জন নারী ও শিশু। এদের মধ্যে ৩২০ জন নারী ধর্ষিত হয়, গণধর্ষণের শিকার হয় ১১৭ জন ও ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ২৮ জনকে। অার শিশু ধর্ষিত হয় ৩৩০ জন। জানুয়ারিতে কুমিল্লায় চিকিৎসা সেবা নিতে এসে ধর্ষণের শিকার হয় এক প্রতিবন্ধী নারী। তাছাড়া ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে ছয় বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণ করে এক যুবক। সেপ্টেম্বরে গাজীপুরে ১৩ বছরের এক কিশোরীকে বিয়ে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া যায়। রাজধানীতে ৭০ বছরের এক বৃদ্ধ ধর্ষণ করে ১০ বছর বয়সী এক শিশুকে।
Advertisement
যৌতুক : ২০১৭ সালে যৌতুকের জন্য প্রাণ দিয়েছেন ৬০ জন নারী এবং যৌতুকের কারণে আহত হন ৬২ জন নারী। এ আধুনিক যুগে এসেও যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতন ও হত্যার বিষয়টি বেশ উদ্বেগের সৃষ্টি করে জনমনে। জানুয়ারিতে রাজবাড়ীতে যৌতুকের দাবিতে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বৃষ্টি আক্তার হ্যাপিকে পিটিয়ে ও বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করেছে পাষণ্ড স্বামী। চট্টগ্রামে যৌতুকের জন্য এক গৃহবধূকে হত্যা করে শ্বশুরবাড়ির লোকজন।
পারিবারিক কলহ : চলতি বছর বেশকিছু পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা অলোচিত ছিল। পারিবারিক কলহে ২০১৭ সালে নিহত হয় ৪০৭ জন ও আহত হয় ১২০ জন। এর মধ্যে নারী নিহত হন ২৯৩ জন। ডিসেম্বরে পারিবারিক কলহের জের ধরে নারায়ণগঞ্জে ভাইয়ের হাতে খুন হন ভাই। পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, রাগ, পরকীয়াসহ বিভিন্ন পারিবারিক কারণে এসব মৃত্যু সংগঠিত হয়।
খুন : ২০১৭ সালে সারাদেশে সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয় ৮৯৭ জন ও আহত হয় ৫৯২ জন। এপ্রিলে ঢাকার ধামরাইয়ে জুবেদা আক্তার নামের এক কলেজছাত্রীকে চোখ উপড়ে ও শ্বাসরোধে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। রাজধানীর গুলশানে নিজ বাড়িতে এক ব্যবসায়ীকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। আগস্ট মাসে ঝিনাইদহে দিনেদুপুরে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ফিরোজ হোসেরকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা । পটুয়াখালীতে একই পরিবারের তিনজনকে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করে। জানুয়ারিতে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ আসনের আওয়ামী লীগের এমপি মুঞ্জুরুল আলম লিটন দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন। খুলনায় ঘরের মধ্যে হাত-পা বেঁধে মাথায় আঘাত করে এক কলেজ শিক্ষককে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
ক্রসফায়ারে নিহত : ২০১৭ সালে ক্রসফায়ারের নামে মৃত্যু হয় ১৪৯ জনের, এর মধ্যে পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হয় ১০৭ জন, র্যাবের ক্রসফায়ারে ৩৯ জন ও অন্যান্য বাহিনী কর্তৃক ৯ জন নিহত হয়। এছাড়া পুলিশ ও জেল হেফাজতে মৃত্যু হয় ৪৬ জনের।
Advertisement
আত্মহত্যা : এ বছর আত্মহত্যা করেছে মোট জন ৬৫৩। এদের মধ্যে ১৯৪ জন পুরুষ ও ৪১৭ জন নারী ও ৪২ জন শিশু রয়েছে। পারিবারিক দ্বন্দ্ব, প্রেমে ব্যর্থতা ও যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
সামাজিক অসন্তোষ : প্রলম্বিত বিচার পদ্ধতি, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব সবকিছু মিলেই দেশের মানুষের মানসিক ও মানবিক চিন্তা-চেতনার অবক্ষয়, তাতে বেড়ে গেছে সামাজিক অসন্তোষ আর এ সামাজিক অসন্তোষের শিকার হয়ে এ বছর নিহত হয়েছেন ১৭১ জন,আহত হয়েছেন ৫ হাজার ৭৮১ জন। এপ্রিলে লারমনিরহাটে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক প্রতিবেশী নারীকে হত্যা করে আরেক প্রতিবেশী। আর এ ঘটনায় আহত হন ৫ জন। আগস্টে হবিগঞ্জের বাহুবলে ইমাম পরিবর্তন নিয়ে কথা কাটাকাটির জেড়ে সংঘর্ষে নিহত হয় ২ জন। গ্রামবাসীদের মধ্যে আহত হয় অন্তত ১০০ জন।
রাজনৈতিক সহিংসতা ও মাকদ এবং গণপিটুনি : ২০১৭ তে রাজনৈতিক সহিংসতায় আহত হয়েছে ২ হাজার ১৭৭ জন ও নিহত হয়েছেন ৩৩ জন। আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডার বাণিজ্য, এলাকা দখল, চাঁদাবাজি নিয়নন্ত্রণ ও ক্ষমতার দাপট প্রদর্শনের এ আহত-নিহতের কারণ ।
তাছাড়া এ বছর মাদকের প্রভাবে বিভিন্ন কারণে আহত হয়েছে ৮৪ জন ও নিহতের সংখ্যা ৫৫ জন। এসিড নিক্ষেপের শিকার হয় ৩৭ জন। তাছাড়া পানিতে ডুবে, অসাবধানতা, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে ৯৮১ জন। এ বছর চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হয় ৭৬ জনের। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৪ হাজার ১৪০ জন ও নিহত হয় ২ হাজার ২৫০ জন। গণপিটুনিতে মৃত্যু হয় ৫১ জনের, আহত হয় ৬৬ জন। বিদায়ী বছরে বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজনৈতিক অজুহাতে গণগ্রেফতার হয়েছে ৫ হাজার ৬৩১ জনেরও মানুষ।
২০১৭ এবং ২০১৬ সালের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার তুলনামূলক চিত্র
ক্র নং
বিষয়
২০১৬
২০১৭
মন্তব্য
১
গণগ্রেফতার
১৩,৭৯৭
৫,৬৩১
কমেছে
২
এসিড নিক্ষেপে আহত বেড়েছে
৩০
৩৭
বেড়েছে
৩
সন্ত্রাসীর হাতে আহত কমেছে
৮৩৯
৫৯২
কমেছে
৪
সন্ত্রাসীর হাতে নিহত
১,০৫২
৮৯৭
কমেছে
৫
বিএসএফের নির্যাতনে আহত
৩৩
১৫
কমেছে
৬
বিএসএফর গুলিতে নিহত
৩৪
২৯
কমেছে
৭
বিএসএফ কর্তৃক অপহরণ
৮
২৬
বেড়েছে
৮
পারিবারিক কলহে আহত নারী ও পুরুষ
৩১৩
১২০
কমেছে
৯
পারিবারিক কলহে নিহত নারী ও পুরুষ
৩৮৪
৪০৭
বেড়েছে
১০
যৌতুকের কারণে হত্যা
৯৪
৬০
কমেছে
১১
যৌতুকের জন্য নির্যাতন
৬১
৬২
কমেছে
১২
সামাজিক সহিংসতায় নিহত
২২০
১৭১
কমেছে
১৩
সামাজিক সহিংসতায় আহত
৬,৫৫৩
৫৭৮১
কমেছে
১৪
গণপিটুনিতে নিহত
৫০
৫১
বেড়েছে
১৫
বোমা হামলায় নিহত
১৮
৬
কমেছে
১৬
বোমা হামলায় আহত
৩৪
২৭
কমেছে
১৭
নির্যাতনে সাংবাদিক আহত
৩৬
২১
কমেছে
১৮
নির্যাতনে সাংবাদিক নিহত
৪
২
কমেছে
১৯
নিখোঁজ
1১৮২
১১৭
কমেছে
২০
নারী ধর্ষণ
১৪১
৩২০
বেড়েছে
২১
ধর্ষণের পর হত্যা
৩৩
২৮
কমেছে
২২
শিশু ধর্ষণ
১৫৬
৩৩০
বেড়েছে
২৩
গণধর্ষণ (নারী)
৭৭
১১৭
বেড়েছে
২৪
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত
২,৪০৪
২২৫০
কমেছে
২৫
সড়ক দুর্ঘটনায় আহত
৪,৯৬৭
৪১৪০
কমেছে
২৬
র্যাবের-পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত
১৫৭
১৪৯
কমেছে
২৭
পুলিশ হেফাজতে নিহত
৪৪
৪৬
বেড়েছে
২৮
চিকিৎসকের অবহেলায় মৃত্যু
৬৫
৭৬
বেড়েছে
২৯
মরদেহ উদ্ধার (নারী)
৫৭
৮৪
বেড়েছে
৩০
মরদেহ উদ্ধার (পুরুষ)
৪১
32
কমেছে
৩১
রাজনৈতিক সহিংসতায় আহত
২,৪২০
২১৪৪
কমেছে
৩২
রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত
৬৪
৩৩
কমেছে
৩৩
নির্যাতনে গৃহপরিচারিকা আহত
১৩
১২
কমেছে
৩৪
নির্যাতনে গৃহপরিচারিকা নিহত
১১
১৪
বেড়েছে
৩৫
অপহরণ (নারী)
৩৭
৪৩
বেড়েছে
৩৬
অপহরণ (পুরুষ)
২০০
১৬৮
কমেছে
৩৭
আত্মহত্যা (পুরুণ)
১৭৮
১৯৪
বেড়েছে
৩৮
আত্মহত্যা (নারী)
৩৩৬
৪১৭
বেড়েছে
৩৯
সংখ্যালঘু নির্যাতন
৩২
২৭
কমেছে
৪০
শ্রমিক অসন্তোষে আহত
৩৩২
১২২
কমেছে
৪১
শিশু আত্মহত্যা
৪২
৪২
শিশু হত্যা
১৯৭
৩৫২
বেড়েছে
৪৩
শিশু নির্যাতন
১৯৯
২১১
বেড়েছে
৪৪
অস্বাভাবিক মৃত্যু
১,২৫০
৯৭১
কমেছে
৪৫
জঙ্গি হামলা (জঙ্গিসহ নিহত)
৬৩
৫৬
কমেছে
এফএইচ/জেডএ/জেআইএম