সালতামামি

সিলেটের আলোচিত ঘটনা আতিয়া মহলের অভিযান

২০১৭ সালে সিলেটে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি পাঠানপাড়াস্থ ‘আতিয়া মহলে’ জঙ্গিবিরোধী শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান। সেই অভিযানে গুলি-বোমার শব্দে কেঁপে উঠেছিল সিলেট। সেনা কমান্ডোদের অভিযানে নিহত হয়েছিল চার জঙ্গি।

Advertisement

এ বছরের ২৪ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত চলে ওই অভিযান। এরপর র্যাব ১০ এপ্রিল পর্যন্ত অপারেশন ক্লিয়ারিং পরিচালনা করে। অভিযান চলাকালে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন র্যাবের পরিচালক ও পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৭ জন। দেশের ইতিহাসে সব চেয়ে বড় ও দীর্ঘস্থায়ী ১৭ দিন ব্যাপী র্যাব-সেনা ও পুলিশের জঙ্গিবিরোধী অভিযানের খবর আর্ন্তজাতিক গণমাধ্যমগুলোতেও বেশ গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়। অভিযান চলাকালে দুই দফার এ বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা পরিস্থিতিকে করে তোলে আতঙ্কময়, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার।

সিলেট মহানগরের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি পাঠানপাড়াস্থ চার ও পাঁচ তলা দুটি ভবনের সমন্বয়ে আতিয়া মহল। ভবনের মালিক উস্তার আলী সিলেট আমদানি-রফতানি অফিসে ক্লার্ক হিসেবে যোগ দিয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে অবসরে যান। ঘটনার চার বছর আগে নিজের স্ত্রীর নামে ‘আতিয়া মহল’ নির্মাণ করেন তিনি।

২০১৭ সালের শুরুর দিকে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে দুই জঙ্গিকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের কাছ থেকেই সিলেটে জঙ্গি আস্তানা থাকার বিষয়টি জানতে পারে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট (সিটিটিসি)। সে সূত্র ধরেই সিলেটে কাজ শুরু করেন গোয়েন্দারা।

Advertisement

সিলেট নগরের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি পাঠানপাড়াস্থ পাঁচ তলা আতিয়া মহলে জঙ্গিদের আস্তানা থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হন গোয়েন্দারা। জঙ্গি আস্তানা থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই চলতি বছরের ২৪ মার্চ (২৩ মার্চ দিবাগত রাত ৩টার দিকে) আতিয়া মহল ঘিরে ফেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জঙ্গিদের ফ্ল্যাটের ফটকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় তালা। শুরু হয় বাংলাদেশে এ যাবৎকালে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা শ্বাসরুদ্ধকর জঙ্গিবিরোধী অভিযান।

অভিযান শুরুর দিন শুক্রবার সকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি টের পায় আতিয়া মহলের নিচ তলার একটি ফ্ল্যাটে থাকা জঙ্গিরা। সকাল ৭টার দিকে বিস্ফোরণ ঘটায় তারা। সকালে পুলিশের সঙ্গে যোগ দেয় র্যাব, ডিবি, এসবি, পিবিআইয়ের সদস্যরা। আতিয়া মহলের চার তলা ভবনের বারো ফ্ল্যাটের সকল বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু পাঁচ তলা ভবনটির নিচ তলায় জঙ্গি আস্তানা থাকায় ওই ভবনের বাকি ২৯টি ফ্ল্যাটে থাকা বাসিন্দাদের সরিয়ে আনা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ।

ভবনের ভেতরে থাকা জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ করতে অভিযান শুরুর দিনই পুলিশ একাধিকবার হ্যান্ড মাইকে আহ্বান জানায়। তবে জঙ্গিরা সাড়া দেয়নি আহ্বানে। ওইদিন বেলা একটার পর জঙ্গিদের ফ্ল্যাট থেকে নারী ও পুরুষ কণ্ঠে উচ্চস্বরে বলা হয়, ‘তোমরা (পুলিশ) শয়তানের পথে আছো, আমরা আল্লাহর পথে। দেরি কেন, দ্রুত সোয়াত পাঠাও। আমাদের সময় কম।’

আতিয়া মহলে অভিযান চালাতে ওই দিন বিকেলে ঢাকা থেকে আসে বিশেষায়িত বাহিনী ‘সোয়াত’। পুরো ভবন ঘিরে রেখে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন সোয়াত সদস্যরা। ওইদিন রাত ৮টার দিকে সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডো ইউনিটের একটি দল ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ফিরে যায়। রাতভর ছিল উৎকণ্ঠা। চূড়ান্ত অভিযান চালানো হতে পারে, এমনটা ধারণা করা হয়েছিল। তবে সে রাতে অভিযান আর হয়নি।

Advertisement

পরদিন (২৫ মার্চ, শনিবার) সকাল ৮টার দিকে সেনাবাহিনীর শতাধিক প্যারাকমান্ডো আসেন শিববাড়িতে। কমান্ডোদের ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ শুরু হয় সোয়া ৯টায়। অভিযানের শুরুতেই পাঁচতলা ভবনে ২৯টি ফ্ল্যাটে আটকা পড়া ৭৮ জন নিরীহ মানুষকে উদ্ধার করা হয়।

ওইদিন (২৫ মার্চ) বেলা ২টার দিকে জঙ্গিদের ফ্ল্যাট ঘিরে শুরু হয় প্যারা-কমান্ডোদের অভিযান। আতিয়া মহলের আশপাশ থেকে সরিয়ে দেয়া হয় সাংবাদিক, উৎসুক জনতাসহ সবাইকে। অভিযানের শুরু থেকেই শোনা যায় গোলাগুলির শব্দ। দফায় দফায় গুলি আর বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো শিববাড়ি এলাকা।

সেদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় অভিযানের বিষয়ে প্রেস ব্রিফিং করেন সেনা সদর দফতরের গোয়েন্দা পরিদফতরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান। তার ব্রিফিং শেষ হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই আতিয়া মহলের প্রায় আড়াইশ গজ দূরে প্রচণ্ড শব্দে দুই দফা বোমা বিস্ফোরণ হয়, ঘটনাস্থলেই নিহত হন চার জন। পরে হাসপাতালে মারা যান আরো দুজন। নিহতের মধ্যে ছিলেন পুলিশের দুই কর্মকর্তাও। বিস্ফোরণে র্যাব সদর দফতরের ইন্টিলিজেন্স উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ গুরুতর আহত হন। পরে তিনিও মারা যান। এছাড়া বিস্ফোরণে আরও অর্ধশতাধিক আহত হন।

দুই দফার এ বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা পরিস্থিতিকে করে তুলে আতঙ্কময়, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার। শনিবার দিবাগত রাতে দফায় দফায় গুলি-বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে আতিয়া মহল। সেদিন মধ্যরাতেই আতিয়া মহলের আশপাশের প্রায় দুই তিন বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা।

পরদিন (২৬ মার্চ) রোববার সকাল ৯টা ৫৭ মিনিট থেকে ফের বিস্ফোরণ আর গুলির শব্দ শুরু হয়। ওইদিন বেশ কয়েকবার আতিয়া মহলে প্যারা-কমান্ডোর বুলেট প্রুফ আর্মারড ভেহিক্যাল ঢুকতে ও বেরোতে দেখা যায়।

বিকেলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, আতিয়া মহলে দুই জঙ্গি নিহত হয়েছে। ভেতরে আরো এক বা একাধিক জীবিত জঙ্গি থাকতে পারে। জঙ্গিরা ভবনের ভেতর বিস্ফোরক ছড়িয়ে রাখায় অভিযানে সময় লাগছে।

২৬ মার্চ দিবাগত রাতে আতিয়া মহল কিছুটা শান্ত ছিল। কিন্তু পরদিন (২৭ মার্চ) সকাল সাড়ে ৬টা থেকে ফের শুরু হয় গোলাগুলি। এদিন কয়েকবার আতিয়া মহল থেকে গোলাগুলি-বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে। দুপুর নাগাদ ভবন থেকে ধোয়াও উড়তে দেখা যায়।

সন্ধ্যায় প্রেস ব্রিফিংয়ে ফখরুল আহসান জানান, সেনা কমান্ডোদের অভিযানে চার জঙ্গি নিহত হয়েছে। এরমধ্যে পুরুষ তিন জন, মহিলা একজন। ভেতরে আর জীবিত জঙ্গি নেই। নিহত দুই জঙ্গির মরদেহ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাকি দুজনের মরদেহ উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। তাদের গায়ে সুইসাইডাল ভেস্ট লাগানো। এরপর থেকে পুরো শান্ত আতিয়া মহল। কোনো গোলাগুলি, বিস্ফোরণ কিছুই আর শোনা যায়নি। সেনা কমান্ডোরা আতিয়া মহলের বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয়করণ ও দুই জঙ্গির মরদেহ উদ্ধারের চেষ্টা চালান।

পরদিন (২৮ মার্চ) বিকেলে পুলিশের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয় আতিয়া মহল। শেষ হয় ৬ দিনব্যাপী সেনা কমান্ডোদের ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’। ২৮ মার্চ সন্ধ্যায় জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্টে প্রেস ব্রিফিংয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান আনুষ্ঠানিক ভাবে সেনা অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করে বলেন অভিযান সফলভাবে সমাপ্ত হয়েছে। এ অভিযান মাইলফলক হয়ে থাকবে।

গত ২৮ মার্চ সেনাবাহিনী পরিচালিত ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ শেষ হওয়ার পর ভবনটিতে প্রচুর বিস্ফোরক থাকায় গত ৩ এপ্রিল থেকে এ অভিযান শুরু করে র্যাব। ১০ এপ্রিল আতিয়া মহলে র্যাবের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের ‘অপারেশন ক্লিয়ারিং’ শেষ হয়। পরদিন ১১ এপ্রিল ঝাঁজড়া হয়ে যাওয়া ভবনটিতে বসবাসকারী ভাড়াটিয়াদের ঢুকতে দেয় র্যাব।

আর এর মধ্যদিয়ে শেষ হয় দেশের ইতিহাসে সব চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ১৭ দিন ব্যাপী র্যাব-সেনা ও পুলিশের জঙ্গিবিরোধী অভিযান।

ছামির মাহমুদ/এফএ/এমএস