দেশজুড়ে

মুক্তিযোদ্ধা জোয়াহেরের গল্প

মহান মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার খ্যাত জেলা টাঙ্গাইল। সতের হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও ১৮ হাজার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নিয়ে গঠিত মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক কাদেরিয়া বাহিনী এ জেলার গর্ব। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শহীদ হন কাদেরিয়া বাহিনীর ১৫৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং আহত হয় ৫০০ মুক্তিযোদ্ধা। অসাধারণ ভূমিকা রেখে এই বাহিনীর ১৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা পেয়েছেন বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীকের মতো রাষ্ট্রীয় খেতাব।

Advertisement

মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথা ইতিহাসের ওই কাদেরিয়া বাহিনীর একজন সম্মুখযোদ্ধা ছিলেন যুদ্ধাহত জোয়াহের আলী (৬৭)। তিনি কালিহাতী উপজেলার নাগবাড়ী পাকুটিয়া গ্রামের মৃত কসিমউদ্দিনের ছেলে। বীর উত্তম উপাধিপ্রাপ্ত দেশের একমাত্র বেসামরিক ব্যক্তি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনীর অসংখ্য সম্মুখ যুদ্ধের অকুতভয়ী সৈনিকও তিনি।

এ জেলায় পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি অসংখ্য যুদ্ধ সংগঠিত হলেও এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গোপালপুর উপজেলার ভেঙ্গুলা যুদ্ধ। এ যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী অতর্কিত হামলায় কাদেরিয়া বাহিনীর ৮৫ জন সদস্যের ৪ মুক্তিযোদ্ধা নিহত হওয়াসহ আহত হন বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। এই ভেঙ্গুলা যুদ্ধে বুকে গুলিবিদ্ধ আহত হন জোয়াহের। মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করতে পারলেও অভাব অনটন আর দারিদ্রতায় ভরপুর জীবনযুদ্ধে মুমূর্ষু প্রায় অকুতভয়ী সৈনিক জোয়াহের।

তবুও পরাজয় মেনে না নিয়ে এ সৈনিক জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যেতে গড়ে তুলেছেন ফুটপাতে পান বিড়ির দোকান। অর্থ, বিত্ত আর উচ্চ শিক্ষাহীন এ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা অনাহার আর অর্ধাহারের মাঝে চালিয়ে যাচ্ছেন এক মেয়ে, দুই ছেলে, স্ত্রী ও তিনিসহ ৬ সদস্যের পরিবার। অবর্ণনীয় দারিদ্রতা আর সহায় সম্বলহীন ব্যক্তি হওয়া স্বত্তেও ৭১ এর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জোয়াহের চলছেন আত্মসম্মান বজায় রেখে। সাহায্যের হাত নিয়ে ঘুরছেন না কারো দ্বারে দ্বারে।

Advertisement

একান্ত সাক্ষাৎকারকালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জোয়াহের আলী জানান, মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল বাড়ি থেকে পালিয়ে কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দেন তিনি। এ দিন যোগদান করেই কাদেরিয়া বাহিনীর টাঙ্গাইল জেলার সখীপুরের বহেড়াতৈল প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে ১ মাসের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে সখীপুর উপজেলার পাথরঘাটা কালিয়ানের তৎকালিন কমান্ডার গোলাম মোস্তফার নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর সদস্য হন তিনি।

১৯৭১ সালের ২৬ জুন টাঙ্গাইল সদর উপজেলার শাহজানী পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পে অবস্থানরত ৭০ জন পাক সেনার ওপর অতর্কিত হামলা চালায় জোয়াহের আলীসহ কাদেরিয়া বাহিনীর তৎকালিন কমান্ডার গোলাম মোস্তফার নেতৃত্বাধিন ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা যুদ্ধ চালায় মুক্তিযোদ্ধারা। এ যুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর কোনো যোদ্ধা নিহত বা আহত না হলেও পাক হানাদার বাহিনীর ১৭ জন সেনা সদস্য নিহত হয়।

জীবিত সেনারা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যান। এ হামলায় বিজয়ী হয়ে কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা নদীপথ ধরে গোপালপুর উপজেলার হেমনগরে অবস্থান নেন। সেখানে ৩ জুন উপজেলার ঝাওয়াইল ভেঙ্গুলা গ্রামের তৎকালিন চেয়ারম্যান বাড়িতে দুপুরে খাবারের দাওয়াত পান তারা। ওই দাওয়াতে যান কাদেরিয়া বাহিনীর তৎকালিন কমান্ডার গোলাম মোস্তফার নেতৃত্বাধিন ৮৫ জন মুক্তিযোদ্ধা। এ বাহিনীর সদস্য ছিলেন জোয়াহের আলী। দুপুরের খাওয়া শুরু করার পরপরই ভেঙ্গুলা অবস্থানকারী ওই কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর প্রতিশোধমূলক হামলা চালায় টাঙ্গাইল সদর উপজেলার শাহজানী পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পের জীবিত পাক সেনারাসহ প্রায় দেড়শ সেনা সদস্য।

মুক্তিবাহিনী প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও এ হামলায় কাদেরিয়া বাহিনীর ৪ সদস্য বাসাইল উপজেলার কামুটিয়া গ্রামের মোস্তাফিজুর রহমান, সখীপুর উপজেলার বুড়িচালা গ্রামের অজয় সিং, কালিহাতী উপজেলা নাগবাড়ী গ্রামের শাহজাহান, ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া গ্রামে অজ্ঞাত এক মুক্তিযোদ্ধা নিহত ও জোয়াহের আলী, রবিউল গেরিলাসহ বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন।

Advertisement

ভেঙ্গুলায় এ হামলা চালিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে পাক সেনারা। বুকে গুলিবিদ্ধ আহত অবস্থায় রাতে পাশের এক বাড়িতে আশ্রয় নেন জোয়াহের। ওই বাড়ির বৃদ্ধার সহায়তায় পরের দিন ভোরে ভূঞাপুর পৌঁছান তিনি। কাদেরিয়া বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ক্যাম্প সখীপুরের মহানন্দপুরে নেয়া হয় তাকে। সেখানে ১৩ দিনের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে তৎকালিন কমান্ডার মনি’র নেতৃত্বে পুনরায় যুদ্ধে ফিরে আসেন তিনি। ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয় টাঙ্গাইল।

নিজের জীবন প্রসঙ্গে তিনি জানান, ১৯৬৮ সালে মেট্রিকুলেশন পাস করার পর আর কলেজে পড়া হয়নি। এরপর শুরু হয় দেশ স্বাধীনের যুদ্ধ। যুদ্ধ শেষে ১৯৭২ সালে ২৮ জুন বাংলাদেশ বিএডিসিতে নিম্নমান সহকারী পদে ঢাকায় চাকরি পান তিনি। এরপর ১৯৯২ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। একই সঙ্গে চাকরির বদলি সুবিধা গ্রহণ করে টাঙ্গাইলে বসবাস শুরু করেন তিনি। আকস্মিক ১৯৯৫ সালের ১১ জুন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ার অজুহাতে স্বেচ্ছায় তিনিসহ অসংখ্য কর্মকর্তা কর্মচারীকে অবসরে পাঠানো হয়। অবসরকালে তাকে পৌনে দুই লাখ টাকা দেয় বিএডিসি। এ টাকা সম্বল নিয়ে জীবন সংসার পরিচালনা করতে থাকেন তিনি।

এরই মাঝে ১৯৯৪ সালে জন্মগ্রহণ করে তার প্রথম সন্তান মোর্শেদা আক্তার। পরবর্তীতে জন্ম নেয় দ্বিতীয় সন্তান কামরুজ্জামান বাপ্পি ও সর্বশেষ জন্মগ্রহণ করে জুনায়েত জামান। বর্তমানে মেয়ে মোর্শেদা আক্তার (২১) সরকারি কুমুদিনী মহিলা কলেজের স্নাতক তৃতীয় বর্ষ, ছেলে কামরুজ্জামান বাপ্পি (১৯) সরকারি সা’দত বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিতে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ ও ছোট ছেলে জুনায়েত জামান (৮)দ্বিতীয় শ্রেণিতে অধ্যায়নরত।

পৈত্রিক জমি জমা আর কোনো সহায় সম্বল না থাকায় কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী (বীরউত্তম) এর সুপারিশে ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২০১০ সালে সহায় সম্বলহীন ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জোয়াহের আলীকে টাঙ্গাইল পৌর এলাকার পাড় দিঘুলিয়া মৌজার নিরালা মোড়স্থ পিয়াসী হোটেলের পেছনের খতিয়ান-১ এর দাগ-৩৭৭ এর ৫ শতাংশ ভূমি স্থায়ী বন্দোবস্ত দেন তৎকালিন জেলা প্রশাসক।

এ ভূমির কিছু অংশে কোনো রকমে একটি ছাপড়া ঘর নির্মাণ করে বসবাস করছেন এ পরিবার। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হওয়া স্বত্বেও তিনি পাচ্ছেন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধার মতো নির্ধারিত মাসিক ১০ হাজার টাকা ভাতা। এ কারণে মাসের আয় বলতে মুক্তিযোদ্ধা ভাতার ১০ টাকা দিয়ে সন্তানদের লেখাপড়াসহ খাওয়া দাওয়া চালানো অসম্ভব হয়ে উঠায় ফুটপাতে তিনি এ পান বিড়ি বিক্রির দোকান নিয়ে বসেছেন।

আরিফ উর রহমান টগর/এমএএস/এমএস