জাতীয়

মাতৃত্বকালীন ছুটি : ছয় বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা

‘আমার সহোদর দুই ভাই প্রতিষ্ঠিত গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিচালনার সঙ্গে আমি বহু বছর যাবত জড়িত। সত্যি কথা বলতে এ দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একটিতেও কর্মজীবী মায়েদের মাতৃত্বজনিত ছুটি প্রদান ও বেতনভাতা দেয়ার নিয়ম পূর্ণাঙ্গরুপে পালিত হচ্ছেনা। অথচ মা ও নবজাতক শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে শিশুটির জন্মের পর ছয়মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানোর সুযোগ করে দেয়ার জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি দেয়া প্রয়োজন।’সোমবার জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান (আইপিএইচএন) এর সম্মেলন কক্ষে বিশ্ব  মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ-২০১৫ উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্রেস্টফিডিং ফাউন্ডেশন (বিবিএফ) আয়োজিত নীতি নির্ধারকদের এক বৈঠকে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের পরিচালক (ম্যাটারনাল অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ) ডা. মোহাম্মদ শরীফ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে কর্মজীবী মায়েদের মাতৃত্বকালীন ছুটি না পাওয়ার বিষয়টি অকপটে স্বীকার করে এ সব কথা বলেন। শুধু ডা. শরীফ একাই নন, প্রাক প্রস্তুুতি হিসেবে আয়োজিত নীতি নির্ধারকদের সভায় উপস্থিত বিবিএফ, স্বাস্থ্য অধিদফতর, বিভিন্ন আন্তজার্তিক দাতা সংস্থা-বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, বিশ্ব  খাদ্য সংস্থা ও সেভ দি চিলড্রেন, ব্রাক, থান ফাউন্ডেশন, স্প্রিং বাংলাদেশ, ম্যাক্স ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন এনজিও’র প্রতিনিধিদের বক্তব্যে ঘুরে ফিরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে মাতৃত্বকালীন ছুটি ও বেতনভাতা পরিশোধ না করার বিষয়টি ঘুরে ফিরে আলোচনায় উঠে আসে। বক্তারা বলেন, মাতৃত্বকালীন ছুটি না পাওয়ায় শ্রমজীবী মায়েরা সঠিকভাবে শিশুর পরিচর্যা করতে পারছেন না। সংসার চালাতে সন্তান প্রসবের কিছুদিনের মধ্যে কর্মস্থলে যোগদান করতে বাধ্য হচ্ছেন শ্রমজীবী মায়েরা।তারা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছয় বছর আগে ২০০৯ সালে বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহের উদ্বোধনকালে ছয় দফা ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন। ঘোষণাপত্রে  মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয়মাসে উন্নীত, প্রত্যেক সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালত, শপিং মল, ব্যাংক, ইনসুরেন্স, হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পৃথক ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপন ছিল অন্যতম। কিন্তু বাস্তবতা হলো ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার বাস্তবায়ন হয়নি।জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান ও বিবিএফের যৌথ উদ্যোগে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আগামী ২ আগস্ট থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত জাতীয়ভাবে বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ পালিত হবে। রাজধানীসহ সারাদেশের মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলাসদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও নার্সিং ইনস্টিটিউটে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে শিশুকে বুকের দুধ পানে মায়েদের উৎসাহিত করতে সপ্তাহব্যাপী প্রচার প্রচারণা চালানো হবে। সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য প্রস্তাবিত বাজেট প্রায় দুই কোটি টাকা।বিবিএফের বোর্ড অব ট্রাস্টির সভাপতি ড. এস কে রয় জাগো নিউজকে বলেন, শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিশ্বের ১৮০টি দেশ কাজ করছে। বাংলাদেশে সরকারি সহযোগিতায় প্রতিবছর জাতীয়ভাবে সপ্তাহব্যাপী মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ পালিত হওয়ার কারণে জনসচেতনতা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। তিনি জানান, ৯০’র দশকে ছয় মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ খাওয়ার হার ছিল মাত্র শতকরা ৪ ভাগ। দুই বছর পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ানোর শতকরা হার ছিল সারাদেশে মাত্র ১২ ভাগ। কিন্তু ২০১১ সালে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস) জরিপে এ হার যথাক্রমে শতকরা ৪৩ ও ৬৪ ভাগে উন্নীত হয় মাতৃদুগ্ধ সেবনের হার শতকরা ৬৪ ভাগে উন্নীত হয়। যদিও ২০১৪ সালের বিডিএইচএসে এ হার কিছুটা কমেছে। সামগ্রিকভাবে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে এটি সম্ভব হয়েছে। এ হার বৃদ্ধির ফলে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার কমেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। ইউনিসেফ কর্মকর্তা ডা. মো. মোহসিন আলী বলেন, কর্মজীবী মা বিশেষ করে গার্মেন্টস সেক্টরে যারা কাজ করছেন তাদের মাতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিতসহ জন্মের পর শিশুকে ছয়মাস পর্যন্ত শিশুকে শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ ও ছয়মাসের পর থেকে মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি পরিপূরক খাবার খাওয়ানোর ব্যাপারে সচেতন করতে কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। ইউনিসেফ খুব শিগগিরই গার্মেন্টস সেক্টরে এ নিয়ে কাজ করবে বলে জানান তিনি।ট্রেনিং অ্যান্ড এসিস্ট্যানাস ফর হেলথ অ্যান্ড নিউট্রেশন (টিএইচএএন) ফাউন্ডেশনের সভাপতি ডা. রুকসানা হায়দার বলেন, কর্মজীবী মায়েরা বিশেষ করে গার্মেন্টস সেক্টরে কর্মরত মায়েরা মাতৃত্বকালীন ছুটি পাননা। গার্মেন্টস মালিকরা সন্তান প্রসবের দুই মাস আগে বিনা বেতনে ছুটি দেন এবং সন্তান হওয়ার দুমাস পর কাজে যোগদানের নির্দেশ দেন। তাদের কোন প্রকার আর্থিক সুবিধা দেয়া হয়না। ড. এস কে রয় উপস্থিত বিভিন্ন আন্তজার্তিক দাতা সংস্থা ও এনজিওদের কাছে বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ পালনের ব্যাপারে সহযোগিতা চাইলে সকলেই কমবেশি আর্থিক ও অন্যান্য সহযোগিতার আশ্বাস দেন। জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ডা. মো. কামরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রাক প্রস্তুুতিমুলক বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) ও পুষ্টি বিষয়ক জাতীয় কমিটির ফোকাল পার্স রোকসান কাদের। প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি বলেন, মাতৃদুগ্ধপানে মায়েদের সচেতন করতে সরকারি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, শুধু দিবস বা সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠান পালনই নয়, সারা বছরের জন্য কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে কাজ করতে হবে। আগামী বছর বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ পালনের আগে কাজের মূল্যায়ন পর্যালোচনা করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. শাহনেওয়াজ বলেন, শিশুর সঠিক পরিচর্যা ও বিকাশে গোল্ডেন থাউজেন ডেজ (১ হাজার দিন) খুব গুরত্বপূর্ণ। এ সময় শিশুকে মায়ের বুকের দুধ ও পরিপূরক খাবার খাওয়ানো নিশ্চিত করতে হবে।  অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্মকর্তা নাসরিন খান, স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা (পিএইচসি) ডা. হাবিব আবদুল্লাহ সোহেল, চিকিৎসা শিক্ষা শাখার উপ-পরিচালক আশীষ কুমার সাহা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডা. ফারজানা, স্প্রিং বাংলাদেশের তনিমা শারমিন, ব্রাকের ডা. রিফাত, ম্যাক্স ফাউন্ডেশনেনর আফরোজা বেগম প্রমুখ। এমইউ/এসএইচএস/আরআইপি

Advertisement