মতামত

কত অজানারে জানাইলা তুমি!

একটা কথা শুনেছিলাম, যখন কোথাও যাবে নিজের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ধারণ করবে কিন্তু মনটা নতুনকে জানার জন্য, ভালো কিছু গ্রহণের জন্য খোলা রাখবে। অন্যের সংস্কৃতি জানতে চেষ্টা করবে এর পেছনের মূল্যবোধ থেকে। অর্ধেক মন দেশে রেখে ভীন দেশে বা স্থানে চোখ বন্ধ করে কাটালে সময়টাকেও উপভোগ করা যায় না, জ্ঞান আহরণের সুন্দর সুযোগও হারাতে হয়।

Advertisement

আমরা পুরাতন বন্ধুকে দেখে খুশি হয়ে বলি, ‘তুই একদম একই রকম আছিস! একটুও পাল্টাসনি’ । মানুষের মৌলিক প্রকৃতি আদতে পাল্টায়ও না। কিন্তু যদি আজকের আপনি চিন্তা চেতনায় উত্তরণে ২০ বছর পরেও অপরিবর্তিত থেকে যান তো আপনার জীবনের ২০ বছর স্রেফ নষ্ট হয়েছে। আপনার জানার গন্ডি বাড়বে, শিখবেন, নিজেকে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ঘ্টাবেন।

আমার নিজের উপলব্ধি, অদ্যাবধি অতিবাহিত জীবনের তিন চতুর্থাংশ দেশে কাটিয়ে বাকি এক অংশ জাপানে আছি, কিন্তু আমার জানার দাঁড়িপাল্লা বেশির ভাগ ভারী হয়েছে এই শেষ অংশেই। মাত্র বড়দিন চলে গেল। বড়দিনের নিমন্ত্রণের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করার আগে আমন্ত্রণকারী খ্রিস্টান বন্ধু পরিবারের ভূমিকা দেয়া অত্যাবশ্যক। তারা আমেরিকান টেক্সান। আমাদের ধারণা ওয়াস্টার্নদের জীবনযাপনে মদ্যপান পানির চেয়েও আবশ্যিক অংশ। হতভম্ব হয়েছিলাম জেনে তারা খ্রিস্টধর্মের এক গোষ্ঠি, মরম্যান, যারা নেশাদ্রব্য এড়াতে ক্যাফেইন ( চা, কফি) পর্যন্ত পান করে না।

ক্যাথলিক চার্চের মত তাদের ফাদার বা নানদের বিবাহ নিষিদ্ধ তো নয়ই, উল্টা তাদের বিবাহ আবশ্যিক। এবং অধিক সন্তান ধারণে সবসময় উদ্বুদ্ধ করা হয়। যেন পৃথিবীতে মরম্যানরা সংখ্যায় বেড়ে যায়। আবার বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক পুরোপুরি নিষিদ্ধ। বিয়ের আগে প্রেমও এরা গ্রহণ করে না, পাছে শারীরিক কোন সংস্পর্শে এসে যায়। আমাদের পরিচিত বন্ধু পরিবারটি আমাদের সাথে কিউশ্যু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষক কোয়ার্টারে আমাদের কাছাকাছি সময়েই এসেছিল। তাদের ছিল ৪ ছেলে মেয়ে। প্রথম তাদের সাথে দেখা হয়েছিল ওয়ার্ড অফিসে। নিজেরাই এসে আলাপ করলো।

Advertisement

আলাপের সময় খটকা লাগলো তাদের সাথে থাকা তিনটা বাচ্চা তিন রকম। একটা একেবারেই সাদা, মেঝটা ভিয়েতনামীদের মত, অন্যটা ব্ল্যাক আমেরিকান বা প্রচলিত বিশেষণে ব্ল্যাক, যে কিনা আফ্রিকান বংশোদ্ভূতই হবে। ওদের বড় ছেলে আমার বড় ছেলের সমবয়সী হওয়ায় আমার দুই ছেলের সাথে ওদের তুমুল দোস্তি হয়ে গেলো। এছাড়াও ওদের গোটা পরিবারের সাথে আমাদের নিত্যদিনের মেলামেশা চলতো। জানতে পারলাম জাপানের চিকিৎসা ব্যবস্থা খুব উন্নত এবং বিশেষ করে বন্ধ্যাত্ব মোকাবেলায় এদের শীর্ষস্থানীয় সুনাম থাকায় খুবই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী সেই দম্পতি অনেক বছর ধরে এখানে আসা যাওয়া করে চিকিৎসা চালিয়ে গেছে। বিফল হয়েই ৪টা বাচ্চা পালক নিয়েছে।

প্রথম জন আর শেষ জনকে আমেরিকা থেকেই নিয়েছিল সদ্যোজাত অবস্থায়। বাচ্চাগুলির বায়োলজিকাল বাবা মায়ের বিয়ে হয়নি এবং সন্তানকে রাখতে ইচ্ছুক না। মেঝ জনকে ভিয়েতনামি দেখতে মনে হলেও সে আসলে জাপানি বালিকা, কিছুটা তামাটে বর্ণের। এবং আমাদের সাথে সাক্ষাতের পরেই ৬ বছরের আরেক জাপানি মেয়েকেও তারা পালক নিল, তুমুল যুদ্ধ করে। যুদ্ধের কারণ, মেয়ে সিংগেল মায়ের সন্তান এবং মা মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। খুব স্বাভাবিকভাবেই এমন ডিস্টার্ব শিশুবেলায় বেড়ে ওঠা সেই বাচ্চা ভয়ানক কম্প্লিকেটেড স্বভাবের ছিল। এমন অবাধ্য টারজান বেবিকে কি করে সাধনা আর ধৈর্য্য দিয়ে তারা বশ মানালো না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন!

আমি হতবাক হয়ে তাদের অন্যের বাচ্চা পালনের সাধনা দেখতাম, আর টের পেতাম আমরা নিজের গর্ভজাত বাচ্চার জন্য আসলে তেমন কিছুই করিনি। আমরা বাচ্চাদের কোন অভ্যাস বা আচরণ দেখে বুঝি এটা বাবার থেকে, মায়ের থেকে, দাদার থেকে পেয়েছে; কাজেই সেইভাবে ট্রিট করতে হবে। কিন্তু এদের একেক বাচ্চার একেক অদ্ভুত স্বভাবের কোন পূর্বাপর ধারণাই এদের নাই। উল্লেখ্য, স্রেফ মরম্যানদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য এই সাধনার দরকার নাই। চার্চে ব্যাপটাইজ করালেই হলো। কিন্তু তারা সত্যি তাদের আদর যত্নের সীমা অতিক্রম করে তাদের মন মেজাজ বুঝে কোনটাকে জাপানি স্কুল, কোনোটাকে ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে দিচ্ছে, আবার পাল্টাচ্ছে।

স্বামী স্ত্রীর শিক্ষকতা জীবনের সমস্ত আয় উপার্জন আর সময় দিয়ে তারা বাচ্চাগুলোকে পড়ালেখা ধর্মচর্চা গান বাজনা সাহিত্যচর্চা সব করাচ্ছে। এর মধ্যেই বিভিন্ন উপলক্ষে দাওয়াত করে, যেটা জাপানে শুধু বাঙালিরাই নিজেদের ভেতরে করে থাকি। বাচ্চাগুলিকেও একদম ছোট থেকেই ঘরের কাজ ভাগ করে করতে শিখিয়েছে, নিজের নাস্তা বানাতে শিখিয়েছে। এমন দাওয়াত পর্বেও একেকজন একেক ডিশ করে মাকে সাহায্য করে। বড়দিনের দাওয়াত পর্বে পানীয় হিসেবে আপেল জ্বাল দিয়ে দারচিনি গুঁড়া আর কিছু মশলা দিয়ে তৈরি করে উষ্ণ ও দারুণ সুস্বাদু এক পানীয়। কারণ তাদের চা কফি সোডা সব নেশাদ্রব্য বারণ।

Advertisement

প্রতি বড়দিনেই তাদের বাসায় সাক্ষাত পাই মিশনারীর কাজে আমাদের শহরে অবস্থানরত কিছু সিস্টার, ব্রাদারদের। তাদের বয়স ১৯ থেকে ২১, ২২ এর ভেতরে। ইউনিভার্সিটি থেকে ১ বছর গ্যাপ নিয়ে তারা বিভিন্ন দেশে,শহরে অবস্থান করে তাদের ধর্মীয় জ্ঞান বিতরণ করে, প্রশিক্ষণ লাভ করে। এবং এদের সংযমের কথা শুনে আমাদের দেশের মাদ্রাসার চেয়ে খুব পার্থক্য পেলাম না। এদের ইন্টারনেট ব্যবহার নিষিদ্ধ, সপ্তাহে একদিন পরিবারকে ইমেল বা ফোন করতে পারবে। বাইবেল ছাড়া কোন বই নিষিদ্ধ , টিভি দেখা , গান শোনাও নিষিদ্ধ। থ খেয়ে গেলাম আজকের যুগে আমেরিকান সমাজে বেড়ে ওঠা , টেকনোলজির তুমুল সংস্রবে বড় হওয়া এসব ছেলে মেয়েরা ১৯/ ২০ বছরে এসে এই সংযম কি করে করে!

মাদ্রাসার শিশুদের মত তারা আজন্ম এই অভ্যাসে বেড়ে ওঠা নয়, কিংবা আদৌ দারিদ্রপীড়িত নয়! উল্লেখ্য, জেহোভাদের (খ্রিস্টান মিশনারি) স্যুটেড বুটেড হয়ে ঘরে ঘরে গিয়ে দরজায় দাড়িয়ে ঘন্টা ধরে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের নিরলস ধৈর্য্য জাপানে এসে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না! মনে হতো, আহা এভাবে ধোপদুরস্ত অমায়িক কেউ ঘরে ঘরে যদি কোরানের মূল বাণী প্রচার করতো! আমাদের দেশে এখন শিশু কিশোরদের চোখের সামনে থেকে গ্যাজেট সরানো যায় না, সাহিত্য চর্চা তো দূরের কথা। সেখানে এই পরিবারে দেখি প্রাইমারিতে পড়া ছোটটা এখনও ট্যাব নেবে কিনা, খেলতে পারবে কিনা, পারলে কতক্ষণ তা অনুমতি চেয়ে নিচ্ছে। শিষ্টতা!

আজকে আমার নিজের ছেলেরাও দেখি বাঙালি গেদারিং এ যেতে চায় না, বাসায় পার্টি হলে অতিথিদের সাথে বসতে চায় না। কারণ আড্ডার টপিক্সে জ্ঞান আহরণের কিছু পায় না। সময়ের তো কোন নিয়ম কানুনই নেই। যেমন ওদের বাসায় দেখলাম সময় মেনে কাটায় কাটায় ৬টায় যেতে হলো, সাড়ে ৬ টায় ভোজ, ৮টায় ডেসার্ট, গ্রুপ ফটো তুলে সাড়ে ৮টায় বিদায়। এবং এই সামান্য সময়েই অনেক কোয়ালিটি আড্ডা হলো। কোন পরচর্চা না। সমাজ, দেশ, দর্শন, শিশুপালন, ওদের ভালোমন্দ মতামত শোনা, গুরুত্ব দেয়া।

সবসময়েই নানাবিধ কাজে যুক্ত স্বামী-স্ত্রী সদ্য নতুন আরেক চর্চা শুরু করেছে যেটাতে আমাকে ৩য় ব্যক্তি হিসেবে যোগ দিতে ধরলো। রাজিও হয়ে গেলাম। চর্চাটা হলো মাসে একদিন বসে যে কোন ৩টা ক্লাসিক বা ভালো বই নিয়ে চর্চা। ১ মাস পরে মিলিত হয়ে পাঠ প্রতিক্রিয়া, কিছু অস্প্ষ্টতা নিয়ে আলোচনা। আবারো নতুন ৩ বই হাতে নেয়া। একসময় বই ছাড়া রাতে ঘুমোতে পারতাম না, পরীক্ষার সময়েও ঘুমানোর আগে কয়েক পাতা পড়তেই হতো। অতি ব্যস্ততায় সব যেন হারিয়ে ফেলেছিলাম। জ্ঞান আহরণ করতে চাইনা, খালি নিজের জানাটাই চর্বিত চর্বণ করে যাই। এখন আবারো নতুন করে বই পড়া চর্চা শুরু হবে।

জাপানে মোটামুটি ভালো সময় ধরে বাস করেও এখনো বেশিটাই যেন অজানা। আমার বন্ধুরা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। ওদের কাছেও শুনি জীবনের কত রং, কত আকৃতি! শুধু বাইরের দেশ না, নিজের দেশে নিজের আশেপাশেও এমন অনেকেই আছেন যাদের সামান্য চেহারার পেছনে অসামান্য একেকটা গল্প লুকিয়ে আছে। সুতরাং নিজস্বতা ধারণ করেই মনটাকে খুলে দিন অভিজ্ঞতা, জ্ঞানলাভের জন্য, অধিকন্তু এসব পর্যালোচনায় নিজের জীবনটাকেই সুন্দর করার জন্য। একটাই জীবন- অনেক অজানা পড়ে আছে। পরচর্চা আর পরশ্রীকাতরতার মত অপচয়ের সময় আমাদের কারোই নাই। একেবারেই নাই।

লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান।neeta2806@yahoo.com

এইচআর/আইআই