রাজধানীর পল্টন মোড়ে একটি রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার শেষে জারের পানি পান করছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী তৌহিদুল ইসলাম। ‘আপনি কী জানেন এই পানি কতটুকু নিরাপদ?’ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ‘নিরাপদই তো! এটা ফিল্টার করা। এছাড়া এসব পানি যারা দিয়ে যায় তারা ফিল্টারিং এর মাধ্যমে খাওয়ার উপযোগী করে তারপর বিক্রি করে।’
Advertisement
একইভাবে মতিঝিলে ফুটপাতের টং দোকানে চা খাওয়ার আগে স্ট্যান্ডে রাখা এক গ্লাস জারের পানি পান করে নিলেন শিক্ষার্থী বেলায়েত হোসেন। তার কাছেও একই প্রশ্ন করা হলে উত্তরে তিনি বলেন, ‘দোকানদাররা তো এটা বিশুদ্ধ ফ্লিটার পানি বলেই আমাদের কাছে বিক্রি করে। তাহলে এই পানি তো নিরাপদই!’
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। রাজধানীতে বাণিজ্যিকভাবে সরবরাহকৃত ৯৭ ভাগ জারের পানিতে ক্ষতিকর মাত্রায় মলের জীবাণু ‘কলিফর্ম’ পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের গবেষকরা। ফলে সুস্থ থাকতে এসব জারের পানি পান না করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
পল্টন মোড়ের চা দোকানকার এরশাদ আলীও জারের ফিল্টার পানি প্রতি গ্লাস এক টাকার বিনিময়ে বিক্রি করছিলেন। জারের পানিতে মলের জীবাণু বিষয়টি উল্লেখ করলে তিনি আঁতকে ওঠেন। বলেন, ‘আমরা তো প্রতিটা জার ৩০ টাকা করে কিনি। বিভিন্ন কোম্পানি এসব পানি নিরাপদ বলে আমাদের দোকানে দিয়ে যায়। আমরাও সরল বিশ্বাসে এসব কিনে নেই। কাস্টমারও সরল বিশ্বাসে খায়। জারের পানিতে যদি সত্যিই জীবাণু থাকে তাহলে আর এসব বিক্রি করবো না। প্রয়োজনে পানি ফুটিয়ে কাস্টমাদের খাওয়াবো।’
Advertisement
শুধু চাকরিজীবী তৌহিদুল ইসলাম বা শিক্ষার্থী বেলায়েত হোসেনই নয় রাজধানীতে বসবাসরত অধিকাংশ মানুষই জানেন না তারা দোকান, হোটেল বা রেস্টুরেন্টে ফিল্টার করা পানি মনে করে যা পান করছেন তা কতটা ক্ষতিকর।
এ বিষয়টি নিয়ে কথা হয় কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পুষ্টি বিভাগের পরিচালক ড. মনিরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রায় ৩৫টি পানির জার কোম্পানির পানি গবেষণার জন্য আমাদের গবেষক দল ২৫০টি নমুনা সংগ্রহ করেন। সেই গবেষণায় ঢাকার বাসাবাড়ি, দোকান, প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা ৯৭ ভাগ জারের পানিতে ক্ষতিকর মাত্রায় মানুষ ও প্রাণির মলের জীবাণু কলিফর্ম পাওয়া গেছে।’
গবেষকরা ঢাকার মতিঝিল, বাসাবো, মালিবাগ, রামপুরা, মহাখালী, গুলশান, বনানী, উত্তরা, এয়ারপোর্ট, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, গাবতলী, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, এলিফ্যান্ট রোড, নিউ মার্কেট, চকবাজার, সদরঘাট, কেরানিগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী, আমিনবাজার, আশুলিয়া ও সাভার এলাকা থেকে এই পানির নমুনা সংগ্রহ করেন।
তিনি বলেন, 'পানিতে টোটাল কলিফর্ম ও ফিকাল কলিফর্মের পরিমাণ শূন্য থাকার কথা থাকলেও ৯৭ ভাগ জার পানিতে দুটোর উপস্থিতি রয়েছে যা স্বাস্থ্যের জন্য মারত্মক ক্ষতিকর।'
Advertisement
গবেষকদের মতে, স্যুয়ারেজ লাইনে ছিদ্রসহ বিভিন্নভাবে ওয়াসার পানিতে মলমূত্রের জীবাণু মিশে যায়। আর সেগুলো কিছুটা শোধন করে বা শোধন ছাড়াই জারের পানিতে বিক্রি করা হচ্ছে। সে কারণে জীবাণু থেকেই যাচ্ছে।
গবেষণায় দেখা যায়, সংগ্রহ করা নমুনাগুলোতে মোট কলিফর্মের ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ মিলিলিটার পানিতে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ মাত্রা পাওয়া গেছে যথাক্রমে ১৭ ও ১৬০০ এমপিএন এবং ফিকাল কলিফর্মের ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ মিলিলিটার পানিতে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ মাত্রা ছিল যথাক্রমে ১১ ও ২৪০ এমপিএন।
'জারের পানিতে মলের জীবাণু' বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের এ গবেষণা প্রতিবেদনের বিষয়ে একাধিক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, এই পানি পান করার ফলে সাধারণ মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছেন। এর প্রভাব মানুষের শরীরে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়বে। কলিফর্ম বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও প্রোটোজোয়ার মতো প্যাথোজেন সৃষ্টিতে উৎসাহ যোগায়। কলিফর্ম গোত্রের অণুজীব মানবদেহে দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া, মাথা ব্যথা, বমিভাব, পেট ব্যথা, জ্বর-ঠাণ্ডা, বমির মতো নানা উপসর্গ সৃষ্টির পাশাপাশি ক্রমাগত মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
এই রোগের কারণে ক্রমান্বয়ে লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস হয়ে যায় এবং অনেক ক্ষেত্রে কিডনিতে মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। তাই এসব পানি পান করা থেকে বিরত থেকে ফোটানো পানি পানের পরামর্শ দেন তারা।
জারের পানিতে স্বাস্থ্যঝুঁকি এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় উল্লেখ করে কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পুষ্টি বিভাগের পরিচালক ড. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথমত সাধারণ মানুষকে এই জারের পানি পান থেকে বিরত থাকতে হবে। এই পরিস্থিতিতে সবার ফোটানো পানি পান করা উচিত। ফোটানো পানিই সবার জন্য বেশি নিরাপদ।’
এছাড়া জারের পানিকে নিরাপদ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত নিয়মিত মনিটরিং করা এবং প্রয়োজন হলে সেসব জার সরবরাহকারী কোম্পানির নিবন্ধন বাতিল কার্যক্রম পরিচালনা করে জারের পানির মান নিশ্চিত করারও পরামর্শ দেন তিনি।
এএস/এসএইচএস/জেআইএম